ভুলিয়ে সীমান্ত পার, এরপর ‘টিকটক হৃদয়’ চক্রের নির্যাতন

ঢাকার একটি বুটিকের দোকানে খুব অল্প বেতনের বিক্রয়কর্মী ছিলেন মেয়েটি। মহামারীর ধাক্কায় চলতি বছর চলে যায় চাকরিটি। ঘরে বাবা অসুস্থ। মেয়েটি শরণাপন্ন হয় পূর্ব পরিচিত বন্ধু রিফাদুল ইসলাম ওরফে টিকটক হৃদয় বাবুর।

লিটন হায়দারও গোলাম মর্তুজাবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 June 2021, 05:23 PM
Updated : 3 June 2021, 04:29 AM

সমব্যথী সেজে হৃদয় মেয়েটিকে ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে যান ভারতে। সীমান্ত পার হওয়ার পরই বেরিয়ে আসে হৃদয়ের ‘নিষ্ঠুর’ চেহারা, যে চেহারায় তাকে দেখা গেছে ভারতের বেঙ্গালুরুতে আরেক বাংলাদেশি তরুণীকে নির্যাতনের ভাইরাল ভিডিওতে।

বাংলাদেশ পার হওয়ার পরই শুরু হয় মারধর। প্রবল নির্যাতনের মুখে একদিনে ১৯ জনের যৌন চাহিদাও মেটাতে বাধ্য করা হয় মেয়েটিকে। দুই মাসের অবর্ণনীয় নির্যাতনের পর গত ৭ মে কৌশলে পালিয়ে দেশে ফিরতে সক্ষম হয় মেয়েটি।

নির্যাতনের এই বর্ণনা দিয়ে মেয়েটি মঙ্গলবার রাতে হৃদয়সহ ১২ জনের বিরুদ্ধে ঢাকার হাতিরঝিল থানায় মামলা করেছেন।

বুধবার সংবাদ সম্মেলন করে ঢাকা মহানগর পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন, “পাচারকারী চক্রের খপ্পরে পড়ার পর থেকে পালিয়ে দেশে ফেরা পর্যন্ত তার উপর লোমহর্ষক নির্যাতন চালানো হয়।”

ভারতের বেঙ্গালুরুতে সম্প্রতি বাংলাদেশের এক তরুণীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ভিডিও ভাইরাল হয়। শারিরীক নির্যাতনের সময় ২২ বছরের ওই তরুণীকে দল বেঁধে ধর্ষণের ঘটনায় বেঙ্গালুরু পুলিশ ছয়জনকে গ্রেপ্তার করে।

এদের মধ্যে টিকটক হৃদয় বাবুসহ দুজন পালানোর সময় গুলিবিদ্ধ হয় বলে জানিয়েছে ভারতের পুলিশ।

এই ঘটনায় হৃদয়সহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে মানব পাচার ও পর্নোগ্রাফির অভিযোগে সম্প্রতি ঢাকার হাতিরঝিল থানায় মামলা করেছেন নির্যাতিত তরুণীর বাবা।

ভাইরাল হওয়া ভিডিওর নির্যাতিত মেয়েটির সহায়তায় পালিয়ে আসা এই মেয়ে মঙ্গলবার ঢাকায় হৃদয়সহ অন্যদের বিরুদ্ধে মামলা করেন।

মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে করা এই মামলার এজাহারে মেয়েটি প্রতারণার শিকার হওয়া থেকে শুরু করে দিনের পর দিন ভয়ঙ্কর অত্যাচারের শিকার হওয়ার বর্ণনা দিয়েছেন বলে জানান পুলিশ কর্মকর্তারা।

উপ-কমিশনার শহীদুল্লাহ বলেন, “চলতি বছরের ১৯ ফেব্রুয়ারি কুষ্টিয়ায় বাউল লালন শাহ মাজারে আয়োজিত ‘টিকটক হ্যাংআউটে’ নিয়ে যাওয়ার কথা বলে মেয়েটিকে বাসা থেকে ডেকে নেয় হৃদয় বাবু।

“এরপর আন্তর্জাতিকভাবে সক্রিয় মানব পাচারকারী চক্রের অন্যান্য সহযোগীদের সহায়তায় কৌশলে ওই কিশোরীকে ভারতে পাচার করেন তিনি (হৃদয় বাবু)।“

মামলার এজাহারের বরাত দিয়ে একজন পুলিশ কর্মকর্তা জানান, ২০১৯ সালের মার্চে হাতিরঝিলের মধুবাগ সেতুতে বান্ধবীসহ ঘুরতে গিয়েছিল এই কিশোরী। সেখানেই হৃদয় বাবুর সঙ্গে তার পরিচয় হয়। কিছুদিন পর ঢাকার বসুন্ধরা শপিং কমপ্লেক্সে চাকরির জন্য গেলে তাদের আবার দেখা হওয়া থেকে শুরু করে গত বছর আবার মৌচাক র্মাকেট সাক্ষাৎ হওয়ার বর্ণনা দিয়েছে মেয়েটি।

বসুন্ধরা শপিং মলে দ্বিতীয়বারের সাক্ষাতে হৃদয় বাবু মেয়েটির কাছ থেকে ফোন নম্বর নেন। মাঝেমধ্যেই তাকে ফোন করতেন। গত বছরের শুরুতে মেয়েটি মৌচাক এলাকার একটি বিপণিবিতানে কাজ নেন।

মামলার এজহারে বলা হয়, কয়েকদিন পর হৃদয় সেই দোকানে গিয়ে হাজির হন। মেয়েটির জন্য সমবেদনা জানিয়ে হৃদয় বলেন, সামান্য বেতনে মেয়েটি এখানে কাজ করছে দেখে তার খুবই কষ্ট হচ্ছে। তিনি আরও ভালো কাজের লোভ দেখান।

এরপর প্রেমের প্রস্তাব থেকে শুরু করে ফেইসবুকে বন্ধুত্ব এবং গত বছরের ফেব্রেুয়ারিতে নারায়ণগঞ্জের অ্যাডভেঞ্চার ল্যান্ড পার্কে ৭০-৮০ জনকে নিয়ে 'টিকটক হ্যাংআউট' পার্টির যোগ দেওয়ার কথা জানিয়েছে মেয়েটি।

এজাহারে বলা হয়েছে, একটি রিজার্ভ করা বাসে অন্যদের সঙ্গে ওই পার্টিতে গিয়ে মেয়েটি জানতে পারে, ‘টিকটক তারকাদের’ মধ্যে হৃদয় বেশ পরিচিত। এরপর গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর গাজীপুরের আফরিন গার্ডেন রিসোর্টে ৭০০-৮০০ জন তরুন-তরুণীকে নিয়ে এই গ্রুপের পুল পার্টিতে যোগ দেওয়ার কথাও বলেছে মেয়েটি।

এতে যোগ দিতে হাতিরঝিল মোড়েলবাড়ি মোড় থেকে একসঙ্গে ১২টির মতো বাস গাজীপুরের উদ্দেশে রওনা দেয়। তবে হদয় একটি এসি মাইক্রোবাসে ওঠেন। সেখানে আরও আটজন মেয়ের সঙ্গী হয় ভুক্তভোগী ওই কিশোরীটিও। পার্টিতে ৭/৮ শ’ তরুণ- তরুণীর মধ্যে প্রায় দুইশ কিশোরী ও তরুণী ছিল।

এক ‘বড় ভাই’র আয়োজন করা সেই পার্টিতে বিনামূল্যে নেশাদ্রব্য বিতরণ করা হয়েছিল বলেও জানায় মেয়েটি।

এজাহারে বলা হয়েছে, চলতি বছর মেয়েটি চাকরি হারালে একটি কাজের জন্য হৃদয়ের সহযোগিতা চান। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি হৃদয় জানায় কুষ্টিয়ায় একটি ‘টিকটক হ্যাং আউটের’ আয়োজন করা হয়েছে, আরও অনেকেই সেখানে যাচ্ছেন।

এই আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে ১৯ ফেব্রুয়ারি সকালে মেয়েটি কুষ্টিয়া যাওয়ার জন্য বাসা থেকে বের হয়। কিন্তু বাস ছাড়ার জায়গায় গিয়ে আর কাউকে দেখতে পায়নি মেয়েটি। পরে ফোন করলে হৃদয় নানা কথায় ভুলিয়ে মেয়েটিকে তার সঙ্গে একা কুষ্টিয়া যেতে রাজি করান।

ঘটনার বর্ণনা দিয়ে এজাহারে আরও বলা হয়, এরপর তারা শ্যামলী থেকে একটি বাসে ওঠেন। সন্ধ্যায় বাসটি শেষ গন্তব্যে পৌঁছানোর পর মেয়েটি জানতে পারেন তারা কুষ্টিয়া নয়, সাতক্ষীরায় এসেছেন। তখন হৃদয় মেয়েটিকে বোঝায় সে ভুল করে সাতক্ষীরার বাসে উঠে পড়েছিল। এরপর হৃদয় জানায়, তার কাছে মোটে ৩০০ টাকা রয়েছে। উত্তেজিত হয়ে কয়েকজনের সঙ্গে কথাও বলে।

মেয়েটি বলেছে, এসময় একজন মোটরসাইকেল চালক এসে তাদের সাহায্য করতে চায়। হৃদয় ওই চালককে রাতটা থাকার মতো ব্যবস্থা করে দিতে বলে। তারপর ওই মোটরসাইকেলে চেপে তারা দুজনে একটি টিনশেড বাসায় যান।

হদয় তাকে বোঝায় এখানে পরিবারের সঙ্গে তারা রাতে আলাদা থাকবে, তাতে নিরপত্তা বাড়বে।

এজাহারের বর্ণনা অনুযায়ী, এরপর ওই বাড়িতে আরও তিন তরুণ ও এক তরুণী আসেন। ওই তরুণী ও মেয়েটিকে এক কক্ষে থাকতে দেওয়া হয়। মধ্যরাতে দরজা ধাক্কাতে শুরু করেন হৃদয়। এসময় তার সঙ্গে আনিস নামের একটা লোক ছিল। তিনি মেয়ে দুটিকে দেখেই চলে যান।

এজাহারে এরপর মেয়েটিকে ফাঁদে ফেলতে পুলিশের তল্লাশির মিথ্যা তথ্য দেওয়া থেকে শুরু করে সীমান্তের ওপারে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা বর্ণনা করা হয়।

ওপারের মনোরম প্রকৃতি, টিকটক ভিডিও ধারণসহ নানা কথা বলে মেয়েটিকে সীমান্তের ওপারে নিয়ে যেতে রাজি করিয়েছিলেন টিকটক এবং সেখানে আসা আবদুল কাদের (মঙ্গলবার গ্রেপ্তার হওয়া) নামের একজন।

কাদেরের ছেলে মেহেদি হাসান বাবুসহ (মঙ্গলবার গ্রেপ্তার) কয়েকজনের সঙ্গে হৃদয় ও মেয়েটি প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা হেঁটে সীমান্তের একটা জায়গায় গিয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন বলে এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে।

সীমান্ত পার হতেই নির্যাতন শুরু

এজাহারে সীমান্ত পার হওয়া থেকে শুরু করে দীর্ঘপথ হেঁটে ও মোটরসাইকেলে করে রাতে কয়েকটি বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার বর্ণনা করা হয়।

এতে আরো বলা হয়, বকুল ওরফে ছোট খোকন বলে একজনের সঙ্গে মোটরসাইকেলে ওঠেন হৃদয় ও মেয়েটি। এরপর ওই রাতে তাদের একাধিক বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। রাতেই মেয়েটিকে দুই দফায় ধর্ষণ করে হৃদয় ও বকুল।

এ সময় তাকে ভয় দেখানো হয়, সে বিনা পাসপোর্টে ভারতে এসেছে, তাদের কথা মতো না চললে তাকে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়া হবে। পুলিশ ধরলেই মেয়েটির ২০ বছর জেল হবে। এরপর সেখান থেকে বিমানে করে মেয়েটিকে ব্যাঙ্গালুরুতে নেওয়া হয়।

এজাহারে বলা হয়েছে, ভারতের দক্ষিণের এই শহরে আনন্দপুরা এলাকায় একটি বাড়িতে মেয়েটিকে রাখা হয়। ওই বাড়িতে আগে থেকেই সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া নির্যাতিত মেয়েটিসহ আরও দু’জন মেয়ে ছিলেন।

নির্মম নির্যাতনের মুখে একটি মেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টাও চালায় বলে ঢাকায় পালিয়ে আসা মেয়েটির এজাহারে উল্লেখ রয়েছে।

ঘটনার বর্ণনায় মেয়েটি আরো বলেন, সেখান থেকে সবুজ নামে একজন প্রচণ্ড মারধর করে অন্য বাড়িতে নিয়ে যায়। ৪-৫ দিন পর তাকে জানানো হয় ‘কাজে যেতে’ হবে। অস্বীকৃতি জানালে তাকে হৃদয়, সাগর ও সবুজ মিলে আবার মারধর করে।

বেঙ্গালুরুতে সেই বাংলাদেশি তরুণীকে নির্যাতনের ভাইরাল ভিডিওতে যশোরের আলামিন ও তানিয়াকে দেখা গেছে হৃদয়ের সঙ্গী হিসেবে  

মেয়েটি চিৎকার করে কাঁদতে থাকলে সেখানেই তাকে ধর্ষণ করে সবুজ। সাগর ও হৃদয় ভিডিও ধারণ করে বলে এজাহারে দাবি করে মেয়েটি বলেন, এরপর হদয় তাকে জানায় তাদের কথা মতো না চললে, এই ভিডিও সবাইকে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।

৩-৪ দিন পর মেয়েটিকে মাইক্রোবাসে করে চেন্নাইয়ের একটি হোটেলে নেওয়া হয়। সেখানে একদিনে ১৯ জনের সঙ্গে যৌনকর্মে লিপ্ত হতে বাধ্য করা হয় মেয়েটিকে। অসুস্থ হয়ে হোটেলের কর্মীদের হাত-পা ধরে কান্নাকাটি করেও ছাড়া পাননি বলে জানায় মেয়েটি। কয়েকদিন পর প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে আবার আনন্দপুরার সেই বাসায় ফিরিয়ে নেওয়া হয়।

সেই বাসায় ঢুকে মেয়েটি দেখে হৃদয় ঢাকা থেকে আরও চার তরুণীকে নিয়ে এসেছেন। ওই মেয়েরা তার সঙ্গে একই ধরে থাকত। এক রাতে ধর্ষণে বাধা দিলে একটি মেয়ের মাথায় মদের বোতল দিয়ে আঘাত করেন হৃদয়। মেয়েটির ক্ষতস্থানে চারটি সেলাই দিতে হয়।

এরপর তাকে একটি ‘ম্যাসাজ পারলারে’ কাজের জন্য ঢাকায় ফিরে আসা মেয়েটিকে পাঠানো হয়। এক রাতে বেঙ্গালুরু ও হায়দ্রাবাদ থেকে দুটি মেয়ে পালিয়ে যান।

এই মেয়েটিও পালানোর চেষ্টা করেন, তবে ধরা পড়ে যান। সেখানে ‘কাজ করা’ অবস্থাতেই মেয়েটি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে পারলারের লোকজন তাকে আনন্দপুরার বাসায় রেখে যায়।

‘সেই নির্যাতিতার’ সহায়তায় পলায়ন

আনন্দপুরার ওই বাসা থেকেই মগবাজারের সেই নির্যাতিতা মেয়েটির সহায়তায় পালিয়ে যায় আরও দুটি মেয়ে। আর ওই মেয়েটিকে রেখে আসা হয় চেন্নাইয়ের একটি হোটেল।

দুদিন পর ওই হোটেল থেকে পালাতে সক্ষম হয় মেয়েটি। ৭ মে তিনি বাংলাদেশের সীমানায় প্রবেশ করেন। হৃদয়ের গ্রেপ্তারের খবরে সাহস পেয়ে মেয়েটি মামলা করেছেন।

গত মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব জানায়, এদের পালাতে সহায়তা করার কারণে মগবাজারের ওই মেয়েটিকে নির্যাতন করে ভিডিও করা হয়।

বুধবার পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার মো. শহীদুল্লাহ বলেন, “চক্রটির বিষয়ে ভারতের বেঙ্গালুরু সিটি পুলিশের সঙ্গে তাদের আনঅফিসিয়াল চ্যানেলে যোগাযোগ হয়েছে।

“তারা চক্রের অন্যান্য সদস্যকে ধরতে কাজ করছেন। ওই চক্রের মাধ্যমে এখন পর্যন্ত সহস্রাধিক নারীকে ভারতে পাচার করার তথ্য রয়েছে।“