ওই মামলায় সাতক্ষীরা থেকে তিন জনকে গ্রেপ্তারের পর পুলিশ বলছে, এই চক্রের মাধ্যমে প্রায় দেড় হাজার নারী পাচারের শিকার হয়েছেন। সম্প্রতি ভারতে গ্রেপ্তার মগবাজারের ‘টিকটক’ হৃদয় বাবু এই চক্রের সমন্বয়ক।
মঙ্গলবার সকালে নিজ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান ঢাকা মহানগর পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ।
ভারতফেরত পাচার ওই কিশোরী নিজের উপর নির্যাতনের করুন কাহিনী পুলিশকে শুনিয়েছেন । মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে তার দায়ের করা মামলায় ১২ জনকে আসামি করা হয়েছে।
আসামিদের মধ্যে ৫ জন বাংলাদেশে অবস্থান করছে বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। এদের মধ্যে তিন জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
এরা হলেন- মেহেদী হাসান বাবু, আবদুল কাদের ও তার ছেলে মহিউদ্দিন।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, পাচারের শিকার কিশোরীর সাথে ২০১৯ সালে হাতিরঝিলে মধুবাগ ব্রীজে টিক টক হৃদয় বাবুর পরিচয় হয়। কখনো টিকটক স্টার বানাতে চেয়ে বা ভালো বেতনের চাকরির অফার দিয়ে কিশোরীকে প্রলুদ্ধ করার চেষ্টা করে হৃদয় বাবু।
পাচারকারী চক্রের খপ্পরে পরার পর থেকে পালিয়ে দেশে ফেরা পর্যন্ত তার অপর লোমহর্ষক নির্যাতন চালানো হয়।
পুলিশের ডিসি শহীদুল্লাহ সাংবাদিকদের বলেন, ভারতে পাচারের পর কিশোরীটিকে ব্যাঙ্গালুরুর আনন্দপুর এলাকায় পর্যায়ক্রমে কয়েকটি বাসায় রাখা হয়। বাসাগুলোতে হাতিরঝিল এলাকার আরো কয়েকজন তরুণী ও কিশোরীর সঙ্গে দেখা হয় ওই কিশোরীর।
এদের মধ্যে সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া ভিডিওর নির্যাতিত তরুণীও ছিলেন, যাদের সুপার মার্কেট, সুপার শপ বা বিউটি পার্লারে ভালো বেতনে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে পাচার করা হয় বলে তিনি জানান।
ভারতের বেঙ্গালুরুতে সম্প্রতি বাংলাদেশের এক তরুণীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ভিডিও ভাইরাল হয়। শারীরিক নির্যাতনের সময় ২২ বছরের ওই তরুণীকে দল বেঁধে ধর্ষণও করা হয় বলে এনডিটিভি জানায়।
ওই ঘটনায় ভারতের বেঙ্গালুরু পুলিশ ছয় জনকে গ্রেপ্তার করে। এদের মধ্যে টিকটক হৃদয় বাবুসহ দুজন পালানোর সময় গুলিবিদ্ধ হয়েছে বলে জানিয়েছে ভারতের পুলিশ। তারা সবাই বাংলাদেশি বলে ধারণা করা হচ্ছে।
মানবপাচারের এই চক্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট চারজনকে সম্প্রতি ঝিনাইদহ সদর, যশোরের অভয়নগর ও বেনাপোল থেকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব।
শহীদুল্লাহ বলেন, ব্যাঙ্গালুরুতে পৌঁছার কয়েকদিন পরই ভিকটিম কিশোরীকে চেন্নাইয়ের একটি হোটেলে ১০ দিনের জন্য পাঠানো হয়। ওই হোটেলে রেখে তার উপর অমানবিক শারীরিক ও বিকৃত যৌন নির্যাতন চালানো হয়। কৌশলে নেশা জাতীয় দ্রব্য খাইয়ে কিংবা জোরপূর্বক বিবস্ত্র ভিডিওধারণ করে পরিবারের সদস্য পরিচিতদের তা পাঠিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে জিম্মি করে রাখা হয়।
“ভারতে পাচারের ৭৭ দিন পর সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া নির্যাতিত ওই তরুণীর সহায়তায় আরও ২ জন বাংলাদেশিসহ এই কিশোরী পালিয়ে বাংলাদেশ আসতে সক্ষম হয়।”
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ওই কিশোরীর মামলার পর মঙ্গলবার রাতে সাতক্ষীরার সীমান্তবর্তী দাৰকপাড়া কালিয়ানী এলাকা থেকে তাকে ভারতে পাচারের ঘটনায় জড়িত ৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
তাদের কাছ থেকে পাচারে ব্যবহৃত দুটি মটরসাইকেল, একটি ডায়েরি, ৪টি মোবাইল ও একটি ভারতীয় সীম কার্ড উদ্ধার করা হয়েছে।
পুলিশ কর্মকর্তা শহীদুল্লাহ বলেন, আসামি মেহেদী হাসান বাবু প্রায় ৭-৮ বছর ধরে মানবপাচারে জড়িত। মামলার ভিকটিমসহ এক হাজারের বেশি নারী পাচারের সঙ্গে জড়িত বলে সে স্বীকার করেছে।
“তার কাছ থেকে উদ্ধারকৃত মোবাইল ও ডায়রিতে হৃদয় বাবু, সাগর, সবুজ, ডালিম ও রুবেলের ভারতীয় মোবাইল নম্বর পাওয়া গেছে। সেখানে বেঙ্গালুরুতে নির্যাতিত তরুণীর ‘আধার নম্বর’ ও ভারতে পাচারকৃত উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভিকটিমের নাম ও মানব পাচারে জড়িত ব্যক্তিদের ‘ডিটেইল’ তথ্য পাওয়া গেছে।”
তিনি বলেন, অপর দুই আসামি মহিউদ্দিন ও আব্দুল কাদের আলোচ্য ভিকটিমসহ পাঁচ শতাধিক ভিকটিমকে সীমান্তবর্তী এলাকায় পাচার করেছেন বলে স্বীকার করেছেন। এসবের জন্য ওই এলাকায় একটি ঘর তৈরি করেছেন তারা, সীমান্তে যাতায়াতের জন্য রয়েছে মটরসাইকেল। এরকম দুটি মোটরসাইকেল জব্দ করেছে পুলিশ।
এক প্রশ্নের জবাবে উপ-কমিশনার বলেন, সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী এই কিশোরী ও তরুণীরা সবাই ‘অবৈধভাবে’ ভারতে প্রবেশ করেছেন। ওখানে তারা কৌশলে ভারতীয় পরিচয় পত্র (আধার কার্ড) তৈরি করে ভেতরে ঘোরাফেরা করছেন।
পুলিশ হেফাজতে থাকা আব্দুল কাদের বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তার ছেলে সীমান্তে 'এপার-ওপার' করেন। মানুষ পারাপারের চুক্তি নেয়। তবে তিনি এসবের সঙ্গে যুক্ত নন, তিনি চাষবাস করেন।