র্যাবের কর্মকর্তারা বলছেন, এই চক্রের ‘হোতা’ আশরাফুল ইসলাম রাফি। ভারতে গ্রেপ্তার হওয়া ‘টিকটক হৃদয় বাবু’ এই ব্যক্তির অন্যতম সরবরাহকারী ও এজেন্ট।
মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, রাফি ৫ বছর আগে নারী পাচারের সঙ্গে জড়িত হয় এবং এই পর্যন্ত ৫০০ নারীকে পাচারের কথা স্বীকার করেছেন।
তিনি বলেন, “দুই বছর পূর্বে রাফির সঙ্গে টিকটক হৃদয়ের পরিচয় ঘটে। হৃদয়ের মাধ্যমে প্রায় ৫০ জন তরুণীকে পাচার করেছে।“
ভারতের বেঙ্গালুরুতে সম্প্রতি বাংলাদেশের এক তরুণীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ভিডিও ভাইরাল হয়। শারীরিক নির্যাতনের সময় ২২ বছরের ওই তরুণীকে দল বেঁধে ধর্ষণও করা হয় বলে এনডিটিভি জানায়।
ওই ঘটনায় ভারতের বেঙ্গালুরু পুলিশ ছয় জনকে গ্রেপ্তার করে। এদের মধ্যে টিকটক হৃদয় বাবুসহ দুজন পালানোর সময় গুলিবিদ্ধ হয়েছে বলে জানিয়েছে ভারতের পুলিশ। তারা সবাই বাংলাদেশি বলে ধারণা করা হচ্ছে।
মানবপাচারের এই চক্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট চারজনকে সম্প্রতি ঝিনাইদহ সদর, যশোরের অভয়নগর ও বেনাপোল থেকে র্যাব সদরদপ্তরের গোয়েন্দা ও র্যাব-৩ গ্রেপ্তার করে।
তারা হলেন- মো. আশরাফুল ইসলাম ওরফে রাফি (৩০), সাহিদা বেগম (৪৬), মো. ইসমাইল সরদার (৩৮) ও মো. আব্দুর রহমান শেখ ওরফে আরমান শেখ (২৬)।
মঙ্গলবার বিকালে কারওয়ান বাজার মিডিয়া সেন্টারে র্যাবের পরিচালক কমান্ডার মঈন এসব তথ্য তুলে ধরে আরো বলেন, “প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা মানবপাচার চক্রের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে।“
তিনি বলেন, “চক্রটি বিভিন্ন প্রতারণার ফাঁদে ফেলে ও প্রলোভন দেখিয়ে নারী ও তরুণীদের পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার করত।
“দেশি-বিদেশিসহ প্রায় ৫০ জন এ সংঘবদ্ধ চক্রের সাথে জড়িত রয়েছে, যাদের মূলহোতা আশরাফুল ইসলাম রাফি (৩০)।“
আট বছর বেঙ্গালুরুতে থাকার সময় মানবপাচারের এই চক্রের সঙ্গে জড়িত হন রাফি এবং দেশে নিজেই একটি চক্র গড়ে তোলেন বলে গ্রেপ্তারের পর তাদের কাছে স্বীকার করেছেন বলে জানান র্যাবের এই কর্মকর্তা।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, রাফিকে এই চক্রের সদস্যরা 'বস' রাফি বলে ডাকে।
ভারতে তরুণীকে নির্যাতনের অভিযোগে গ্রেপ্তার টিকটক হৃদয় বাবুসহ তার আরও কয়েকজন এজেন্ট বা সরবরাহকারী রয়েছে বলে প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে।
বাংলার পাশাপাশি তামিল ভাষাতেও পারদর্শী রাফি বেঙ্গালুরুতে গাড়ি চালাতেন ও চাকরি করতেন। সেখানে কাপড়ের ব্যবসাও ছিল তার।
কমান্ডার মঈন বলেন, পাশ্ববর্তী দেশ বা উন্নত দেশে বিভিন্ন মার্কেট, সুপারশপ, বিউটি পার্লারসহ বিভিন্ন ধরনের ভালো বেতনের চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে রাফিরমা দেশের নারীদের চক্রটির কাছে নিয়ে আসত।
এরপর তাদেরকে মূলত যৌনবৃত্তিতে নিয়োজিত করার উদ্দেশ্যে দক্ষিণাঞ্চলের সীমান্ত দিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার করা হত জানিয়ে তিনি বলেন, “এরপর নারীদের বিভিন্ন জাতীয় মাদকদ্রব্য সেবন করিয়ে জোরপূর্বক অশালীন ভিডিও ধারণ করে ব্ল্যাকমেইল করা হতো। এবং যৌনবৃত্তির কাজে বাধ্য করত।
“তরুণীদের বৈধ বা অবৈধ উভয় পথেই সীমান্ত পার করত এবং কয়েকটি ধাপে পাচার করত।“
এসব এলাকার সীমান্তবর্তী বিভিন্ন স্থানে পাচারের উদ্দেশ্যে তাদের রাখা হত।
সেখান থেকে সুবিধাজনক সময়ে 'লাইন-ম্যানের' মাধ্যমে অরক্ষিত এলাকা দিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশের এজেন্টদের কাছে হস্তান্তর করত। সেখান থেকে পরে কলকাতায় পাঠানো হত।
র্যাব কর্মকর্তা মঈন পাচার করা তরুণীদের চক্রটি কিভাবে কলকাতা থেকে বেঙ্গালুরুতে পৌঁছে দিত সে বর্ণনা করে বলেন, “বেঙ্গালুরু পৌঁছানোর পর রাফি তাদের বিভিন্ন স্থানে রাখত এবং ব্ল্যাকমেইল ও মাদকাসক্তে অভ্যস্থসহ অমানবিক নির্যাতনের মাধ্যমে এই পেশায় বাধ্য করা হতো।
“তাদের হেফাজত থেকে ১০ থেকে ১৫ দিনের জন্য বিভিন্ন জনের কাছে পাঠানো হত। তারা নিজেরাই বিশেষ নিরাপত্তা সংবলিত কিছু জায়গা গড়ে তোলে।“
রাফি ভাষাগত দক্ষতার কারণে এক পর্যায়ে এই চক্রের লিডার হয়ে যায় উল্লেখ করে তিনি জানান, এজেন্টরা তাকে জনপ্রতি ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা কমিশন দিত।
দুইজন নারীকে পালাতে সহায়তার শাস্তি ওই ভিডিও
সংবাদ সম্মেলেন র্যাব কর্মকর্তা মঈন জানান, বেঙ্গালুরুতে নির্যাতিত ওই তরুণীকে শাস্তি দিতেই নির্যাতনের পর ভিডিও অনলাইনে আপলোড করা হয়েছে বলে গ্রেপ্তারের পর তাদের কাছে স্বীকার করেছে।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে রাফি র্যাবকে জানায়, এই কারণে ওই তরুণীকে নির্মমভাবে অত্যাচার করা হয় এবং তাকেও বলা হয় সে যদি পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে তাহলে ভিডিওটি তার স্বজনদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে ।
কমান্ডার মঈন বলেন, “সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া ভিডিওর ভিকটিমকে পাচারের উদ্দেশ্যে টিকটক হৃদয়কে রাফি প্রলুব্ধ করে।
“তারপর হৃদয় ওই তরুণীকে পাচার করে বেঙ্গালুরুতে নিয়ে সবুজ নামে আরেকজনের বাড়িতে রাখে। পরে তাকে নির্যাতনের পর ভিডিওটি ধারণ করা হয়।“
বেঙ্গালুরুতে তরুণীদের আটকিয়ে রাখার কয়েকটি স্থান রয়েছে বলে রাফি জানিয়েছে।
গ্রেপ্তার হওয়া অন্যদের মধ্যে সাহিদার একাধিক (৩) বিয়ে হয়েছিল জানিয়ে ওই র্যাব কর্মকর্তা বলেন, “সে এবং তার দুই মেয়ে সোনিয়া ও তানিয়া পাচার চক্রের সঙ্গে জড়িত, যারা এখন বেঙ্গালুরুতে অবস্থান করছে বলে সাহিদা জানিয়েছে।“
আরও পড়ুন