মহামারী যত দীর্ঘ হচ্ছে, ভবিষ্যত নিয়ে ততই শঙ্কা বাড়ছে চাকরিপ্রত্যাশীদের। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি আসছে না, কিন্তু বেড়ে যাচ্ছে বয়স; তাতে চাপে পড়ছেন তরুণরা।
Published : 19 May 2021, 01:23 PM
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০১৮ সালে স্নাতকোত্তর করা বাবুল আফ্রাদের মত যারা সরকারি চাকরির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তাদের কাছে এখন চাকরির চিন্তার চেয়েও ‘বয়সসীমার দুশ্চিন্তা’ ভর করছে বেশি।
মহামারীতে সব স্থবির থাকলেও 'বয়স বেড়ে চলার' হতাশায় থাকা এই চাকরিপ্রত্যাশী বলেন, “গত কিছুদিন ধরে সার্কুলারও হচ্ছে না। মহামারীর আগে চাকরির বয়স হাতে ছিল ৩ বছর। পরীক্ষাগুলো দিতে পারলে এতদিনে একটা চাকরি হয়ত হয়ে যেত। কিন্তু এখন আর দেড় বছর সময় আছে। খুব দুশ্চিন্তায় আছি এটা নিয়ে।"
এমন অনিশ্চয়তার মধ্যে অর্থনৈতিক সঙ্কটও সামলাতে হচ্ছে বাবুলের মত তরুণদের। পরিবার তাকিয়ে আছে- লেখাপড়া শেষ করে কবে তারা সংসারে ভূমিকা রাখবে, কিংবা নিজে সংসার করবে।
“মাস্টার্সের পরে টিউশনি করে চলতাম। করোনায় সেটাও বন্ধ হয়ে গেছে। যে সময়টায় বাবা-মাকে চাকরি করে সাপোর্ট করার কথা, তখন ফ্যামিলি আমাদের বোঝা হিসেবে টানছে,” বললেন বাবুল।
সরকারি চাকরিতে প্রবেশের প্রান্তসীমা ৩০ বছর থেকে বাড়ানোর দাবি বেশ কয়েক বছর ধরেই রাজপথে আছে, আছে সোশাল মিডিয়ায়। বাবুলও মনে করেন, এই প্রান্তসীমা বাড়িয়ে অন্তত ৩২ বছর করা উচিত।
মহামারী দীর্ঘ হওয়ায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর করা আরাফাত হোসেন এখন সরকারি চাকরির আশা ছেড়ে তুলনামূলক কম বেতনের অন্য চাকরি খুঁজছেন।
বয়স নিয়ে অনিশ্চয়তার কারণে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, "সেশন জটের কারণে চাকরির প্রতিযোগিতায় ঢুকতেই আমাদের অনেক বয়স হয়ে যায়। এর মধ্যে করোনা আবার সময়গুলো খেয়ে নিচ্ছে। এখন এমন সব বিজ্ঞপ্তি দেখছি, যেগুলোতে আগে আবেদন করতাম না।
"সরকার এ বিষয়ে ক্লিয়ার করলে, আমাদের দোটানায় থাকতে হত না। মন দিয়ে প্রস্তুতি নিতে পারতাম।"
তাদের মত চাকরির খোঁজে থাকা সদ্য সাবেক শিক্ষার্থীরা বলছেন, মহামারীকালে সরকারি ছাড়াও বেসরকারি খাতের নিয়োগের সংখ্যা কমে আসায় তারা কাঙ্ক্ষিত সুযোগ পাচ্ছেন না।
এমনকি রাষ্ট্রীয় মালিকানার ব্যাংকগুলোর বড় একটি নিয়োগের পরীক্ষা স্থগিত হওয়ায় চাকরি প্রত্যাশীদের অনেকে কাজ ছাড়াই ঘরবন্দি সময় কাটাচ্ছেন।
আবার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চূড়ান্ত পরীক্ষা শুরু না হওয়ায় স্নাতক শেষ বর্ষে আটকে থাকা শিক্ষার্থীরা আবেদনই করতে পারছেন না। সে কারণে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর দাবি জোরালো হচ্ছে।
তবে বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘমেয়াদে বয়স বাড়ানোর পক্ষে নন। সঙ্কট সমাধানে তারা সময়িকভাবে অল্প দিনের জন্য ছাড় দিতে বলছেন।
মহামারীর কারণে গতবছরের ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ রয়েছে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। অনলাইনে ক্লাস হলেও পরীক্ষা নেওয়ার জটিলতায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা এক বছরের বেশি সময়ের জটে পড়েছেন।
ফাঁকা এসব পদের সংখ্যা, ওই সময়ের মোট পদের ২১ দশমিক ২৭ শতাংশ।
মহামারীর মধ্যে সেসব পদ পূরণের কাজটি থমকে গেছে। গত বছর মার্চ থেকে মে পর্যন্ত সাধারণ ছুটির সময় সব ধরনের নিয়োগ বন্ধ ছিল। পরে কিছু প্রক্রিয়া শুরু হলেও সংখ্যায় তা সামান্য।
মহামারীর মধ্যেই গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ৪২তম এবং ১৯ মার্চ ৪১তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা হয়। আগামী ৬ অগাস্ট ৪৩তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা হওয়ার কথা রয়েছে।
শিক্ষার্থীদের ক্ষতি পোষাতে গত বছরের সেপ্টেম্বরে বয়সের ক্ষেত্রে এক দফা ছাড় দেয় সরকার। তাতে ২০২০ সালের ২৫ মার্চ যারা ৩০ বছর পেরিয়ে গেছেন, তারাও চাকরির জন্য আবেদন করতে পেরেছেন।
তারপর পেরিয়ে গেছে আরও আট মাস। সরকারের তরফ থেকে নতুন কোনো সিদ্ধান্ত এখনো না আসায় চাকরিপ্রত্যাশীদের উদ্বেগ বাড়ছে।
গেল জানুয়ারিতে স্নাতক তৃতীয় বর্ষের চূড়ান্ত পরীক্ষা দেওয়া ঢাকা কলেজের ইকরাম হোসাইন বলেন, "ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাত কলেজ এমনিতে পিছিয়ে আছে। এখন করোনার কারণে ভুগছি। বয়স না বাড়ালে আমরা সেভাবে কম্পিটিশন করতে পারব না।"
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী নূর ইসলাম টিপু জানান, স্নাতক সপ্তম সেমিস্টারের পরীক্ষা জুনে এবং অষ্টম সেমিস্টারের পরীক্ষা নভেম্বরে হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি।
"পরীক্ষা না হলে তো বিসিএসের জন্য চেষ্টাই করতে পারব না। সময় হিসেবে এক বছর লস হলেও, মানসিক দিক দিয়ে অনেক বেশি লস হয়ে গেছে।”
তবে কেউ কেউ দীর্ঘমেয়াদে বয়সসীমা বাড়ানোর পক্ষে নন। তাদেরই একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০২০ সালে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করা নম্রতা তালুকদার অর্পা। অবশ্য তিনিও মহামারীতে সরকারি-বেসরকারি নিয়োগ প্রক্রিয়া থমকে থাকায় হতাশ।
“আমার মনে হয় এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি খারাপ পরিস্থিতিতে আছি আমরাই। রেজাল্টও হয়ে গেল, আবার সরকারি কোনো চাকরির পরীক্ষাও হচ্ছে না। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর চাকরির ক্ষেত্রেও এর প্রভাব পড়ছে।”
ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সরকারি চাকরির বয়স না বাড়িয়ে এখন যারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তাদের জন্য সার্কুলারগুলোতে সময় বাড়িয়ে সুযোগ দেওয়ার পক্ষে অর্পা।
একই মত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব বিভাগের স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষার্থী ফয়সাল বারির।
“সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় মনে হয় না যে, চাকরির বয়স বাড়ানোর প্রয়োজন আছে। ৩০ বছর কিন্তু অনেক সময়। সেটা ৩২ করা উচিত হবে না। বরং যেসব চাকরিপ্রত্যাশীরা এই সময়টায় রয়েছেন, তাদের জন্য যে সময়টা প্রাসঙ্গিক মনে হয়, সেটুকু বাড়িয়ে দেয়া দরকার।”
২০১৯ সালের শুরুতে স্নাতকোত্তরের ক্লাস শুরু করা এই শিক্ষার্থী গত বছরের ১৫ মার্চ একটি বিষয়ের চূড়ান্ত পরীক্ষা দিতে পেরেছেন। এরপরই বন্ধ হয়ে যায় বিশ্ববিদ্যালয়।
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন
এখন যেহেতু প্রতিবছর বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি আসছে, ফলে মহামারীর জটিলতায় বিসিএস চাকরিপ্রত্যাশীদের ‘বেশি ক্ষতি হবে না’ বলেই মনে করছেন সরকারি কর্ম কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ সাদিক।
তিনি বলেন, “একজন শিক্ষার্থী অনার্স পরীক্ষা না দেওয়া পর্যন্ত বিসিএস পরীক্ষার যোগ্য হয়ে ওঠেন না। মহামারীর কারণে এটা তো বিশ্বব্যাপী একটা ক্ষতি। পড়াশুনার ক্ষতি হচ্ছে, মানুষের জীবনযাপনের ক্ষতি হচ্ছে। এরকম পরিস্থিতিতে কিছু ক্ষতি যে হচ্ছে, তা তো অস্বীকার করার উপায় নাই।
“তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এর সমাধান করে নিতে হবে। পিএসসি প্রতি বছরই বিজ্ঞপ্তি দিচ্ছে। স্নাতক যারা সম্পন্ন করেছেন তারা সেটাতে আবেদন করতে পারছেন। এটি একটি ইতিবাচক দিক। যদি এমন হতো যে, পিএসসি বিজ্ঞপ্তিটা দুই-তিন বছর পরপর দিচ্ছে, তাহলে সমূহ ক্ষতির আশঙ্কা ছিল।”
সাবেক এই শিক্ষা সচিব বলেন, “যে বিজ্ঞপ্তিগুলো চলমান রয়েছে, এতে যারা আবেদন করেছেন তাদের বয়স নিয়ে দুশ্চিন্তার কোন কারণ নেই। পরীক্ষা যখনই অনুষ্ঠিত হোক, তারা সেই পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারবেন।”
আরও ইতিবাচক দিক রয়েছে উল্লেখ করে মোহাম্মদ সাদিক বলেন, “করোনাভাইরাসের কারণে নিয়োগ প্রক্রিয়া বিলম্বিত হওয়ায় অনেক পদ খালি হচ্ছে এ সময়টায়। ফলে পরবর্তীতে অনেক বেশি পদের বিজ্ঞপ্তি আসতে পারে। এর একটি সুবিধা চাকরিপ্রত্যাশীরা পাবেন বলে আশা করছি।”
পরিস্থিতি বিবেচনায় কিছু ছাড় দেওয়া গেলেও দীর্ঘমেয়াদে বয়স বাড়ানোর পক্ষে নন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক আমিনুল হক।
“মহামারী কত বছর ধরে চলবে এটা কেউ জানে না। এটা একটা দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার। এটা যদি ৫ বছর চলে তাহলে বয়স কী ৫ বছর বাড়িয়ে দেওয়া হবে?”
এক বছরের জন্য সময় বাড়িয়ে দেওয়ার বিবেচনা করা যেতে পারে মত দিয়ে তিনি বলেন, “কিন্তু লম্বা সময় করা মুশকিল।”
দেশে সাড়ে চার কোটি শিক্ষার্থী পড়ালেখা করছেন জানিয়ে অধ্যাপক আমিনুল বলেন, “এর মধ্যে চার থেকে পাঁচ লাখ শিক্ষার্থী বিসিএস বা অন্যান্য চাকরির জন্য চেষ্টা করে। ৩৫ বছর পর্যন্ত যদি এসব শিক্ষার্থী বসে থাকে, তাহলে তারা এক পর্যায়ে পরিবার ও সমাজের জন্য বড় ধরনের বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।
“যারা বয়সসীমা বাড়ানোর দাবি করছে, তাদের জন্য সারা বছরে ৩০ থেকে ৪০ হাজার পোস্ট রয়েছে। ফলে বয়সসীমা পর্যন্ত অপেক্ষা করলেও বাকিদের বাদ দিতেই হবে। তাই তাদের এত বয়স পর্যন্ত অপেক্ষা না করে, অন্য কোনো কাজে জড়িত হওয়া উচিত।"
চাকরির বয়সসীমা নিয়ে সরকারের পরিকল্পনা জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব ইউসুফ হারুন মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন।
তবে প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেনকে একাধিকবার ফোন করেও পাওয়া যায়নি। এসএমএস পাঠিয়েও সাড়া মেলেনি।