প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সরকারি চাকরি প্রত্যাশীদের এই সুযোগ দেওয়া হচ্ছে বলে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন মঙ্গলবার সাংবাদিকদের জানিয়েছেন।
এর আগে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে যাদের সরকারি চাকরির বয়স পার হয়েছে, তাদের বিষয়টি বিবেচনা করতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রস্তাব পাঠাবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
একজন কর্মকর্তা জানান, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাব অনুমোদন দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। গত ২৫ মার্চ যাদের বয়স ৩০ বছর পূর্ণ হয়েছে তাদের সরকারি চাকরিতে আবদন করার সুযোগ দিতে বলেছেন সরকারপ্রধান।
গত ২৫ মার্চ যাদের বয়স ৩০ বছর পার হয়েছে তাদের কত মাস পর্যন্ত সরকারি চাকরিতে আবেদনের সুযোগ দেওয়া হবে, তা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সার্কুলারের মাধ্যমে নির্ধারণ করে দেবে বলে জানান ওই কর্মকর্তা।
বাংলাদেশে কোভিড-১৯ এর বিস্তার বাড়তে থাকায় গত ২৬ মার্চ থেকে টানা ৬৬ দিন সাধারণ ছুটির মধ্যে কোনো নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেনি সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)। তার আগে গত ডিসেম্বর থেকে চাকরিতে নিয়োগের নতুন কোনো বিজ্ঞপ্তি দেয়নি কমিশন।
তবে ৩০ মে সাধারণ ছুটি শেষে জুনের প্রথম সপ্তাহে নন-ক্যাডারে বেশ কয়েকটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে পিএসসি। সেখানে বয়সের সর্বোচ্চ সীমা ৩০ বছর নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে গত ১ জুন পর্যন্ত।
শিক্ষার্থীদের চাওয়া
মহামারীর মধ্যে ৩০ বছর পার হওয়াদের চাকরির আবেদনের সুযোগ দেওয়াই এই ক্ষতি পোষানোর জন্য যথেষ্ট নয় বলে দাবি করছেন অন্যান্য চাকরি প্রত্যাশীরা।
এই দাবির পক্ষে যুক্তি হিসেবে তারা বলছেন, করোনাভাইরাস সংকটের মধ্যে চাকরির বিজ্ঞাপন বন্ধ থাকায় শুধু ৩০ বছরের প্রান্তে যারা ছিলেন তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হননি, ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছে সবাইকে। তাই সবার জন্যই চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা ‘কিছুটা হলেও বাড়ানো উচিত’।
এই যুক্তিতে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর দাবিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরব হয়েছেন অনেকে।
এই মহামারীতে ক্ষতিগ্রস্ত সানজিদা ইসলামের চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা শেষ হয়ে যাবে আগামী ডিসেম্বর।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করার পর কয়েক বছরের প্রস্তুতি শেষ সময়ে কাজে লাগাতে না পারায় হতাশ সানজিদা জানান, করোনাভাইরাসের কারণে ছাত্র পড়াতে না পারায় বাধ্য হয়ে অনলাইনে ব্যবসা শুরু করেছেন তিনি।
“জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশন জটের কারণে পড়াশুনা শেষে চাকরির প্রস্তুতির জন্য সময় খুব কম থাকে। আবার মহামারীতে সার্কুলার বন্ধ থাকায় অ্যাপ্লাইয়েরও সুযোগ পেলাম না। বাকি তিন মাসে তেমন বিজ্ঞাপন দেওয়া হবে কি না, তাও জানি না।”
সরকারি চাকরির প্রস্তুতির জন্য বেসরকারি চাকরি ছেড়েছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করা তাসনোভা হোসাইন। সরকারি চাকরিতে আবেদনের জন্য এক বছর সময় হাতে আছে তার।
জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলো নষ্ট হতে থাকায় হতাশ তাসনোভা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পাঁচ মাস তেমন কোনো সরকারি চাকরির বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়নি। আমাদের অনেকগুলো সময় নষ্ট হয়ে গেছে। বিসিএসসহ বিভিন্ন সরকারি চাকরির প্রস্তুতি নিতেই অনেক সময় লেগে যায়। আর ৩০ বছরের পরতো আমি চাইলেও আবেদন করতে পারব না।
“ক্ষতি সব শিক্ষার্থীদেরই হয়েছে। সরকার যদি বয়স সীমা এক বছর বাড়ায় তাহলে সবারই ভালো হবে।”
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উদ্ভিদবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর করা জান্নাতুন নাঈম জেনিথ মনে করেন, সেশন জটের কারণে পড়াশোনা শেষ করে চাকরির বয়স খুব বেশি থাকে না।
“প্রায় ছয় মাসের মতো চাকরির বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়নি। কবে থেকে সরকারি চাকরির পরীক্ষাগুলো নিয়মিত হবে তা নিশ্চিত না। কিন্তু বয়স শেষ হওয়ার আশঙ্কা তো বাড়ছেই।”
গত মাসেই নির্ধারিত বয়সসীমা শেষ হয়ে গেছে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগ থেকে পাস করা মাহফুজুল ইসলামের।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সেশন জট ও থিসিসের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়েই সাড়ে তিন বছর পিছিয়ে পড়ার পর করোনাভাইরাস এসেছে দুঃস্বপ্ন হয়ে।
“কয়েকটি সরকারি চাকরির পরীক্ষায় চান্স হয়েছে, এগুলোর রিটেন-ভাইভা নিয়েও এখন চিন্তায় আছি। মার্চ থেকে সার্কুলারগুলো আটকে না গেলে হয়ত ভালো কোথাও হয়ে যেত। এখন কোথাও না হলে সারা জীবন একটা আক্ষেপ থাকবে। কারণ আমরা যারা চাকরিপ্রত্যাশী তারা কিন্তু শেষদিকেই বেশি টিকছি।
“অনেক দিন ধরেই দাবি উঠছে সরকারি চাকরিতে বয়স বাড়ানোর। এখন যেহেতু পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে, এটা ৩২ বছর যেন করা হয়।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই শিক্ষার্থী বলেন, “গড় আয়ু বেড়েছে, কিন্তু সরকারি চাকরির বয়সসীমা বাড়ানো হচ্ছে না। এখন যেহেতু দাবি উঠেছে, তাই সরকারি চাকরিতে আবেদনের বয়স বাড়ানো উচিত।”
গত মার্চে বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর পিএসসি ছাড়াও অন্যান্য সরকারি চাকরির বিজ্ঞাপনও বন্ধ হয়ে যায়। গত মে মাসে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক-এডিবির এক জরিপ প্রতিবেদনে বাংলাদেশে মার্চ-এপ্রিল মাসে আগের বছরের তুলনায় চাকরির বিজ্ঞপ্তি অনেক কমে যাওয়ার তথ্য দেওয়া হয়।
“বাংলাদেশের জব পোর্টালগুলোতে এপ্রিল মাসে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির পরিমাণ আগের বছরের একই মাসের তুলনায় ৮৭ শতাংশ কমেছে। তার আগে মার্চ মাসে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি এসেছে গত বছরের মার্চ মাসের চেয়ে ৩৫ শতাংশ কম।”
এখন দ্রুত বড় কয়েকটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি এলে চাপ কিছুটা কমবে বলে মনে করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর করা আল হেলাল রুশদী।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সরকারি চাকরির আশায় অন্য কোথাও অ্যাপ্লাই করিনি। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে আমার বয়স শেষ হয়ে যাবে। এখন অনেক পরীক্ষা হচ্ছে, রিটেন-ভাইভা দিচ্ছি। এই সময়টায় আরও সার্কুলার হলে হয়ত একটা চান্স হয়ে যেত। এখন সরকার বয়সে একটু ছাড় দিলে উপকৃত হব।”
এই পরিস্থিতিতে চাকরিপ্রার্থীদের সুযোগ দিতে বয়স বাড়ানোর বিষয়ে সরকার ভাবতে পারে বলে মত দিয়েছেন কয়েকজন অধ্যাপক।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান এ কে আজাদ বলেন, “সারা বিশ্বেই কঠিন একটি পরিস্থিতি চলছে। চাকরিপ্রার্থীরাও পিছিয়ে গেছে। সেজন্য তাদের ৬ মাস সময় বাড়িয়ে দেওয়া উচিত। যদি মহামারী আরও প্রলম্বিত হয়, সেক্ষেত্রে আরও কিছু সময় বাড়ানো যেতে পারে। কেউ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।”
সরকারি চাকরির বিজ্ঞাপনগুলো চলমান রাখাই এ সমস্যার সহজ সমাধান হতে পারে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক।
তিনি বলেন, “আমি মনে করি, সবার সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। এখন যাদের ৩০ বছর চলছে, বা ২-৩ মাসের মধ্যে হয়ে যাবে তাদের সুযোগ পাওয়া দরকার।
“প্রজাতন্ত্রের সকলকে সমান সুযোগ দেওয়ার লক্ষ্যে প্রজাতন্ত্রের সকল কর্মকাণ্ড হওয়া উচিত। বিশেষ করে সামনে যে চাকরিগুলো আছে, সেখানে তাদের সমান সুযোগ দেওয়া উচিত।”
আরেফিন সিদ্দিক বলেন, “যেহেতু একটি বিপর্যয় চলছে, সে কারণে পরীক্ষা বা সাক্ষাৎকার নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না- সেটি আমরা বুঝি। কিন্তু শূন্য পদের বিপরীতে বিজ্ঞাপনগুলো যেন বন্ধ না থাকে।
“কিছু দিন যাদের বয়স আছে তারাও তাহলে আবেদন করতে পারবে, সিস্টেমে অন্তভুর্ক্ত হবে। ৬ মাস পরে হলেও পরীক্ষা দিতে পারবে। এ নীতিটা সরকার গ্রহণ করলে তেমন সমস্যা হবে না। বিজ্ঞাপন যেন সচল থাকে সেটা দেখা উচিত। এটি সহজ সমাধান, সরকার চিন্তা করলে করতে পারে।”
তবে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলছেন, চাকরিতে প্রবেশের নির্ধারিত বয়সসীমা বাড়ানোর সুযোগ নেই।
প্রশ্নের জবাবে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “২৬ মার্চ থেকে ৩১ মে পর্যন্ত সাধারণ ছুটি ছিল। ওই সময়ে যে পরীক্ষাগুলো হওয়ার কথা ছিল, ওগুলো তো হয়নি। যেগুলোর বিজ্ঞাপন আগে দেওয়া হয়েছিল, সেসব ক্ষেত্রে তো কোনো সমস্যা নাই, কারণ বিজ্ঞাপন অনুযায়ী সেগুলো হবে।
“২৬ মার্চ থেকে অগাস্ট পর্যন্ত যে বিজ্ঞপ্তিগুলো দেওয়ার কথা ছিল, কিন্তু দেওয়া হয়নি, সেগুলো আগামীতে যখন দেওয়া হবে তখন বয়স উল্লেখ করবে ২৫ মার্চে ৩০ বছর হতে হবে। তাহলেই বঞ্চিতরা সুযোগ পাবে। প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে আমরা এ বিষয়ে সম্মতি নিয়েছি, উনি আমাদের নির্দেশনা দিয়েছেন।”
প্রতিমন্ত্রী বলেন, “সরকারি চাকরির বয়স ৩০ বছরই থাকবে। যেহেতু করোনাভাইরাসে বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষকে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে, এখানেও এভাবে চাকরিপ্রত্যাশীদের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হবে। আর বিসিএস প্রতি বছরই নভেম্বরে হয়। এখন যেহেতু নভেম্বর আসেনি, তাই সেখানে তো কোনো সমস্যা নেই।”
[প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রতিবেদক কাজী নাফিয়া রহমান]