পড়াশোনার ক্ষতি, উদ্বেগ চাকরির বয়স নিয়েও

করোনাভাইরাসের মহামারীর মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় পড়াশোনার ক্ষতি হচ্ছে; পাশাপাশি বিভিন্ন পর্যায়ে পরীক্ষা স্থগিত থাকছে বলে সেশনজটে পড়ে চাকরির বয়স নিয়ে উদ্বেগে রয়েছেন শিক্ষার্থীরা।

সাবিকুন্নাহার লিপিসাবিকুন্নাহার লিপিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 April 2020, 09:10 AM
Updated : 21 April 2020, 10:20 AM

মহামারী ছড়ানো ঠেকাতে ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ রয়েছে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ১ এপ্রিল থেকে অনুষ্ঠেয় এইচএসসি পরীক্ষাও অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হয়েছে, যার প্রভাবে পেছাতে পারে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষাও।

উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত টেলিভিশন ও অনলাইনে ক্লাস ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা চললেও উচ্চ শিক্ষা পর্যায়ে সমন্বিত কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী খালিদ হাসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পরীক্ষার একটা প্রস্তুতি ছিল। কিন্তু দিন যত যাচ্ছে, চর্চা কমে যাচ্ছে। একটা মানসিক চাপে আছি, তাই পড়া হচ্ছে না।

“বুঝতে পারছি না এইচএসসির প্রস্তুতি নিব নাকি ভর্তি পরীক্ষার। এইচএসসির পরই ভর্তি পরীক্ষা চলে আসলে কোন প্রস্তুতিই নেওয়া হবে না।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের নিচতলায় তালাবদ্ধ সারি সারি শেণিকক্ষ। ফাইল ছবি

দেশে সেশনজটের সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি করোনাভাইরাসের কারণে আরও বাড়বে ইডেন কলেজের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী লুৎফুন্নাহার ফুরকানের আশঙ্কা।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এমনিতেই আমরা সেশনজটে আছি। সামনে পরীক্ষা ছিল। জানি না কবে এ পরিস্থিতির অবসান হবে, ততদিনে আমরা অনেক পিছিয়ে যাব। এই পিছিয়ে পরা কমাতে কর্তৃপক্ষ সঠিক সিদ্ধান্ত নিবে আশা করি।”

স্ট্যামফোর্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষার্থী আমিনুর রহমান হৃদয় বলেন, টেলিভিশন বা অনলাইনের ক্লাসে না বুঝলে নেই প্রশ্নের সুযোগও।

ক্লাসের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া, বিলম্বিত পরীক্ষা অনুষ্ঠান ও ফলাফল প্রকাশের বিষয়ে সরকারের এখনই পরিকল্পনা করা উচিত বলে তার মত।

“পরে হুটহাট সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিবে তা, আমরা চাইনা।”

করোনাভাইরাসের এক বছরের সেশনজটে পড়ার আশঙ্কা প্রকাশ করলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের শিক্ষার্থী কাজী সামিয়া রহমান।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ছয় মাস পিছিয়ে পরা মানে চাকরির ক্ষেত্রেও পিছিয়ে যাওয়া। সরকার আমাদের জন্য কি পদক্ষেপ নেবে, এ গ্যাপ কীভাবে দূর করবে? সে বিষয়ে অন্ধকারে না রেখে স্পষ্ট সিদ্ধান্ত দেওয়া দরকার।”

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী অনিমেষ রায় বলেন, “দীর্ঘ সেশনজটে পরতে হবে আমাদের। সেজন্য চাকরির বয়সসীমা বাড়ানো দরকার।”

এছাড়া চাকরির বয়সসীমা নিয়েও সরকারের কোনো ভাবনার কথা জানা না গেলেও শিক্ষার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে যতটুকু ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তার পর্যাপ্ত নয় বলে মনে করছেন শিক্ষাবিদরা।

জানতে চাইলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পরিকল্পনা হাতে নেওয়া আছে আমাদের। সংসদ টিভিতে ক্লাস নেওয়ার ব্যবস্থা নিয়েছি। ওখানে আমরা হোমওয়ার্কও দিচ্ছি।

“সামনে যেভাবে হয়, সেভাবে চিন্তা-ভাবনা করে করব। এখনও চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত আমরা নেইনি। রাষ্ট্রের সকল কিছুই পরবর্তীতে পুষিয়ে নিতে হবে আমাদেরকে।”

মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে টেলিভিশন ও অনলাইনে ক্লাস নেওয়া হচ্ছে বলে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সৈয়দ গোলাম ফারুক জানান।

ইসতিয়াক আহমেদ হৃদয় হৃদয় ও তার বন্ধুরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কুকুরদের ছাড়াও বিড়াল ও কাককেও খাবার দিয়ে থাকেন। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এভাবে আপাতত এটাকে মোকাবিলা করার চেষ্টা করছি। যদি আরো দীর্ঘায়িত হয়, তখন কি করা যায় তা ভাবব।”

তবে এই মুহূর্তে শিক্ষার ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার বিষয়টি একেবারেই ভাবছে না দেশের স্নাতক পর্যায়ের প্রায়  দুই তৃতীয়াংশ শিক্ষার্থীর ভবিষ্যতের নিয়ন্ত্রক জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

জানতে চাইলে উপাচার্য অধ্যাপক ড. হারুন অর রশিদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শিক্ষার ক্ষতির চাইতে এখন জীবন বাঁচানো বেশি জরুরি। এই দুর্যোগ মোকাবেলা করে তারপর আমরা বিশেষ পদক্ষেপ নিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করব।

“তবে এ মুহূর্তের কাজ হলো- মানুষের জীবন বাঁচানো। বেঁচে থাকলে সব করা যাবে। কাজেই এগুলো নিয়ে এখন ভাবারও সময় নেই।”

আর ২৪ মার্চ দেশের সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অনলাইনে ক্লাস নিয়ে এগিয়ে থাকার নির্দেশ দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)।

সংস্থাটির চেয়ারম্যান কাজী শহিদুল্লাহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দুয়েকটা লেকচার দিয়ে শিক্ষার্থীদের পড়াশুনার সাথে সংযুক্ত রাখা আরকি। পরে পরীক্ষা নিয়ে নিবে। পরীক্ষা তো শুক্র-শনিবারেও নিতে পারে।

“তবে বন্ধের সময় দীর্ঘতর হলে চিন্তা করে ফর্মুলা বের করতে হবে।”

এরপর ১৬ এপ্রিল অনলাইন ক্লাস পরিচালিত হচ্ছে কিনা, কোন কোন বিষয়ে ক্লাস হচ্ছে ও শিক্ষার্থী উপস্থিতির হারের বিষয়ে তথ্য ২০ এপ্রিলের মধ্যে জানতে চেয়ে ইউজিসি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে চিঠি দেওয়া হয়।

তবে এবিষয়ে কতগুলো বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইন ক্লাস চালু করেছে সেবিষয়ে সুনির্দিষ্ট হালনাগাদ তথ্য ইউজিসি চেয়ারম্যান জানাতে পারেননি।

অন্তত দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যে এখনও এধরনের কোনো উদ্যোগ নেয়নি তা উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামানের কথায় স্পষ্ট।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আমরা একটা সার্ভে করব, আমাদের শিক্ষার্থীরা কোন অঞ্চলে আছে, সেখানে ইন্টারনেট সুবিধা কতটুকু আছে; এ বিষয়গুলো নিয়ে।”

ডিজিটাল প্রযুক্তির যুগে দেড় মাসের বেশি সময় শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা থেকে দূরে রাখার সমালোচনা করেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য  অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আমরা সময়টাকে অর্থপূর্ণভাবে ব্যবহার করতে পারছি না। উন্নত দেশে দেখা যাচ্ছে অনলাইনে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রমের সাথে যুক্ত রেখেছে।

“অনেক শিক্ষার্থীর ইন্টারনেট সুবিধা নেই। তাদের ইন্টারনেটের আওতায় নিয়ে আসা বা ডাটা সাপোর্ট দেওয়া তো কঠিন কিছু না।”

তবে শুধু টেলিভিশন ও অনলাইনে কিছু ক্লাস নিয়ে ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব না বলে মনে করেন ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান একে আজাদ চৌধুরী।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এডিশনাল সময় দিয়ে, কন্ট্রাক্ট আওয়ার শিক্ষার্থীদের সাথে বাড়িয়ে এবং সিরিয়াসলি প্রোগ্রাম করে- এই যে দুমাসের মতো সময় গেল এরপরও কিছু সময় যাবে, তা প্ল্যান অনুযায়ী পুষিয়ে নিতে পারে।”