যাদের এসব দেখার কথা, তারা রোগ সারানোর চেষ্টার কথা বলছেন। তবে সেজন্য অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে কেবল।
বুড়িগঙ্গার পানির রঙ কালচে হওয়ায় একটি বড় কারণ নগরের পয়ঃবর্জ্য। ঢাকা ওয়াসা বলছে, নদীকে সেই দূষণ থেকে পুরোপুরি রক্ষা করতে আরও অন্তত নয় বছর অপেক্ষা করতে হবে।
তবে এভাবে সময় বেঁধে দেওয়াটাকে ‘অবাস্তব’ বলছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা। আর নদী রক্ষা আন্দোলনকর্মীরা বলছেন, দূষণ কমাতে কর্তৃপক্ষের ‘সদিচ্ছার অভাব’ দেখছেন তারা।
জলাশয়ে পয়ঃবর্জ্য ফেলা নিয়ে ওয়াসার বিরুদ্ধে অভিযোগ দীর্ঘদিনের। ঘণবসতিপূর্ণ এই শহরের পয়ঃবর্জ্য শোধন করতে ২০৩০ সালের দিকে তাকিয়ে আছে প্রতিষ্ঠানটি। তারা বলছে, ওই সময়ের মধ্যে নতুন পাঁচটি পয়ঃশোধনাগার তৈরি হয়ে গেলে বদলে যাবে ঢাকার পয়ঃবর্জ্য ব্যবস্থাপনার চিত্র।
রায়েরবাজার পয়ঃশোধনাগারের কাজ শুরু করতে কিছুটা সময় লাগবে। অনুদান ও সরকারি অর্থায়নে এসব শোধনাগার নির্মাণ করা হবে। এসব শোধনাগার চালু হওয়ার আগ পর্যন্ত ঢাকার পয়ঃবর্জ্য জলাশয়েই মিশবে।
কবে মিলবে এ থেকে পরিত্রাণ?
ঢাকা ওয়াসার পরিচালক (কারিগরি) এ কে এম শহীদ উদ্দীন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে ডটকমকে বলেন, “ঢাকা শহরে আমাদের স্যুয়ারেজ কাভারেজ ২০ শতাংশ। বাকিটা পানিতে মিশছে। পাঁচটি প্ল্যান্ট করার আমাদের যে পরিকল্পনা, সেটা বাস্তবায়ন হলে পুরো পয়ঃবর্জ্য শোধনাগারে যাবে। তখন নদীর পানির দূষণ কমে যাবে।”
আরও নয় বছর, অর্থাৎ ২০৩০ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো উপায় কি নেই?
শহীদ উদ্দীন বললেন, “আসলে নয় বছর না, আশা করছি, ২০২৭ সালের মধ্যে আমরা কাজ শেষ করতে পারব।”
তবে ওয়াসার পরিকল্পনার ধরনকে ‘অবাস্তব’ আখ্যায়িত করে বিআইপির সাধারণ সম্পাদক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, “ওয়াসা সবসময় প্ল্যান্টের কথা বলছে। কিন্তু মূল চ্যালেঞ্জটা হচ্ছে এই প্ল্যান্টের সাথে সংযোগ স্থাপন। ঢাকার মত ঘনবসতিপূর্ণ শহরে সুয়ারেজ লাইনগুলোর সঙ্গে শোধনাগারের কানেকশন করা বড় চ্যালেঞ্জ। সেটা কিভাবে করবে? সময় বেঁধে দিলেই তো হবে না।”
ওয়াসার কাছে এই নগর পরিকল্পনাবিদের প্রশ্ন: “শোধনাগার করাই যায়; কিন্তু যে আসল কাজ, সেটা করতেই অনেক সময় লাগবে এবং সেটা ঢাকার মত শহরের জন্য কতটা বাস্তব? কারণ এখানে সেন্ট্রালি কোনো স্যুয়ারেজ সিস্টেম নেই। তাহলে কানেকশন কীভাবে করবে?”
‘বেশি দায়ী’ শিল্পবর্জ্য
‘আরবান রিভার পলিউশন ইন বাংলাদেশ ডিউরিং লাস্ট ফরটি ইয়ারস: পটেনশিয়াল পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইকোলজিক্যাল রিস্ক, প্রেজেন্ট পলিসি অ্যান্ড ফিউচার প্রসপেক্টস টুওয়ার্ডস স্মার্ট ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট’ শীর্ষক এক গবেষণা বলছে, হাজারীবাগ, তেজগাঁও ও ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-ডেমরা নদী রক্ষা বাঁধ ঘিরে প্রায় সাত হাজার ছোট-বড় কারখানা গড়ে উঠেছে, যেগুলোর বর্জ্য সরাসরি পড়ছে বুড়িগঙ্গা নদীতে।
ঢাকার কেরানীগঞ্জের শতাধিক ওয়াশিং কারখানা মালিক সমিতির তথ্য অনুযায়ী, প্রতিদিনি ২৫-৩০ হাজার লিটার পানি ব্যবহার হয় এসব কারখানায়। কাপড় রং করার পর এসব পানি গিয়ে পড়ে বুড়িগঙ্গায়। এ হিসেবে এখানকার কারখানাগুলো থেকে প্রতিদিন অন্তত ১৮ লাখ লিটারের বেশি বিষাক্ত তরল বর্জ্য মিশছে বুড়িগঙ্গায়।
শ্যামপুর শিল্প এলাকার শতাধিক প্রিন্টিং, নিট, ডায়িং কারখানা থেকে প্রতিদিন বের হয় ৩০ হাজার ঘনমিটারেরও বেশি অপরিশোধিত তরল বর্জ্য, যা নদীতে যাচ্ছে সরাসরি। এর সঙ্গে প্রতিনিয়ত ক্ষতিকর রাসায়নিক ও ভারী ধাতু যাচ্ছে পানিতে।
দূষণ রোধে হাজারীবাগের ট্যানারি কারখানাগুলো হেমায়েতপুরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেখানে গিয়ে এ শিল্প খাত নতুন করে দূষিত করছে ধলেশ্বরী নদীকে।
গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইটিপি) নির্মাণ করা হলেও তা সঠিকভাবে পরিশোধন করতে পারছে না। একই অবস্থা ইপিজেডগুলোর সিইটিপির। টঙ্গী এলাকার ডায়িং ও ওয়াশিং কারখানার অপরিশোধিত বর্জ্য দূষিত করছে তুরাগ নদকে।
পরে বুড়িগঙ্গা দূষণকারী ওয়াশিং প্ল্যান্টে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়ার বিষয়ে মার্চ মাসে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের চেয়ারম্যানের ব্যাখ্যা জানতে চায় হাই কোর্ট।
দূষণ থেকে ঢাকার নদীগুলো রক্ষায় সরকারের পরিকল্পনা জানতে চাইলে নৌ পরিবহন মন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, “নদী দূষণ নিয়ে আমাদের একটি টাস্ক ফোর্স আছে। সেখানে পরিবেশ অধিদপ্তর, সিটি কর্পোরেশন, নৌ মন্ত্রণালয়, ওয়াসাসহ অন্যান্য আছে। তারা নিজ নিজ কম্পোনেন্ট নিয়ে কাজ করছে।
“ওয়াটার ক্লিনিং ভ্যাসেল কেনার জন্য ডিপিপি করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী অলরেডি বলেছেন, এগুলো সংগ্রহ করতে। শিগগিরই আমরা কিনে ফেলব। দূষণটা যে করেই হোক কমাতে হবে। সে লক্ষ্যেই আমরা কাজ করছি।”
তবে এটা রাতারাতি করে ফেলা ‘সম্ভব নয়’ জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, “আমাদের সদিচ্ছা আছে। আমি যেটা মনে করি ২০২৫ সালের মধ্যে ঢাকাবাসী পানির স্বচ্ছতা দেখতে পাবে।”
“সরকারকে আন্তরিক হয়ে কাজ করতে হবে। অনেকে বলেন, ঢাকা সিঙ্গাপুর করে দেবে। আমরা সিঙ্গাপুর চাই না। বুড়িগঙ্গাকে বুড়িগঙ্গা হিসেবেই চাই। দূষণ বন্ধ করার জন্য সেরকম কোনো কাজ তো দেখছি না।”
“দূষণ প্রতিরোধে যারা কাজ করছে, তাদের আরেকটু সিরিয়াস হতে হবে। এর কোনো শর্টকাট পথ নেই। সাংগঠনিকভাবে যা যা করা দরকার সবাই আছে। কিন্তু এখন যেটা করতে হবে এই কাজটাকে প্রায়োরিটি দিতে হবে।
“যদি আইন করতে হয়, তবে করতে হবে। তবে সেই আইন নদী রক্ষা কমিশনের আওতায় করতে হবে। আমার ধারণা, কমিশনের হাতে এক্সিকিউটিভ এবং এনফোর্সমেন্ট ক্ষমতা থাকতে হবে। আমরা পরামর্শ দিচ্ছি, কিন্তু বাধ্য তো করতে পারছি না।”