রক্ষা পায়নি একটি নদীও

নদীমাতৃক দেশ বাংলাদেশে নদীর সংখ্যা ৪০৬টি, এর একটিও দখলদারদের হাত থেকে রেহাই পায়নি বলে জানিয়েছে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন।

মেহেদী হাসান পিয়াসবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 Sept 2019, 04:49 PM
Updated : 22 Sept 2019, 04:52 PM

হাই কোর্টের নির্দেশে সরকারের চিহ্নিত করা দখলকারদের একটি তালিকা সম্প্রতি জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন প্রকাশ করেছে। সেখানে সারা দেশে নদী, খাল-বিল, জলাশয়-জলাধার দখলকারীর সংখ্যা প্রায় ৪৭ হাজার।

এই দখলকারীদের মধ্যে ব্যবসায়ী, প্রভাবশালী ব্যক্তি ছাড়াও রয়েছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, রাজনীতিবিদ ও শিল্প-কারখানা।

ঢাকার আশেপাশের চারটি নদী, খাল, জলাধারের দখলকারী হিসেবে উঠে এসেছে বিভিন্ন শিল্প গ্রুপ ও আবাসন প্রকল্পের নাম।

তবে এ তালিকা এখনও অসম্পূর্ণ এবং দখলদারদের চিহ্নিত করার এ প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছেন নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান হাওলাদার।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, সারা দেশে যত নদী আছে, “তার সবগুলোই কোনো না কোনোভাবে অবৈধ দখলদারদের কবলে পড়েছে। এসব দখল উচ্ছেদে বছরব্যাপী ক্র্যাশ প্রোগ্রাম পরিচালনা করছে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা।”

নদীর জায়গা দখল করে আবাসন প্রকল্প ও শিল্প কারখানা গড়ে তোলার পাশাপাশি দোকানপাট ও বাজার হয়েছে। ঘড়বাড়ি করে স্থানীয়রাও নদী-খালের জমি অবৈধভাবে দখল করেছে। দখলে পিছিয়ে নেই সরকিারি বিভিন্ন সংস্থা, প্রতিষ্ঠানও।

নদী রক্ষা কমিশনের ওয়েবসাইটে নদী দখলকারীদের বিভাগভিত্তিক যে তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে, সেখানে ৬২ জেলায় নদী, খাল-বিল, জলাশয়-জলাধার দখলকারী হিসেবে ৪৬ হাজার ৮৩৯টি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির নাম এসেছে।

এই তালিকা অনুযায়ী, ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় নদীর জমি অবৈধভাবে দখল করেছে এমন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৯৫৯। আর ২ হাজার ১৮৭ ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান বন্দরনগরী চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদী, বাকলিয়া ও চাক্তাই খালের বিভিন্ন অংশ দখল করে স্থাপনা তৈরি করেছে।

গত ১ জুলাই প্রকাশিত হাই কোর্টের এক রায়ে নদী দখলকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য করতে বলা হয়। দেশের সব নদ-নদীকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণার পাশাপাশি নদ-নদীর সুরক্ষা ও সংরক্ষণে নদী রক্ষা কমিশনকে ‘আইনগত অভিভাবক’ ঘোষণা করা হয়।

সেই রায়ের নির্দেশনা অনুযায়ীই নদী রক্ষা কমিশনের ওয়েবসাইটে দখলকারীদের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানে নোয়াখালী জেলায় সর্বোচ্চ ৩ হাজার ৫৮৩ জন দখলকারীর নাম এসেছে। আর সবচেয়ে কম ১৪ জন দখলকারীর তালিকা এসেছে লালমনিরহাট থেকে।

কমিশনের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান হাওলাদার বলেন, “ময়মনিসংহ ও পঞ্চগড় জেলা বাদে ৬২ জেলার তালিকা আমরা এ পর্যন্ত প্রকাশ করেছি। বাকিদের তালিকাও প্রকাশ করা হবে। হাই কোর্টের রায়ে স্থানীয়ভাবেও দখলদারদের নাম-ঠিকানা উম্মুক্ত স্থানে টাঙানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।”

ঢাকার নদী-খাল দখল

নদী রক্ষা কমিশন যে তালিকা প্রকাশ করেছে, সেখানে গুলশান ভূমি অফিসের দেওয়া প্রতিবেদনে ভাটারা খালের বিশাল জমি দখলকারী হিসেবে কেবল ‘বসুন্ধরা হাউজিং কোম্পানি লিমিটেড’ এর নাম রয়েছে।  

এছাড়া গুলশান সার্কেলের বাওথার তলনা খাল, ঢেলনা খাল, ডুমনী কাঁঠালদিয়া খাল, জোয়ার সাহারা কাঁঠালদিয়া খাল ও ভাটারা কাঁঠালদিয়া খালের জমি দখলেও রয়েছে বসুন্ধরা হাউজিংয়ের নাম।

মতিঝিল রাজস্ব সার্কেলের সহকারী কমিশনারের (ভূমি) দেওয়া তালিকায় উঠে এসেছে আভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিওটিএ)র নাম। কদমতলী মৌজায় বুড়িগঙ্গা নদীর জমি দখল করে বিআইডব্লিওটিএ ‘বুড়িগঙ্গা ইকো পার্ক’ গড়ে তুলেছে।

বুড়িগঙ্গার জমি দখলকারীর তালিকায় মেসার্স ম্যাক এন্টারপ্রাইজেস লিমিটেড, চান টেক্সটাইল মিল লিমিটেডসহ বিভিন্ন ব্যক্তির নাম এসেছে।

আমিনবাজার রাজস্ব সার্কেলে বেগুনবাড়ি খালের জমি দখলকারীর তালিকায় স্থানীয় ব্যক্তিদের পাশাপাশি এসেছে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম।

আর ধানমন্ডি সার্কেলের রামচন্দ্রপুর মৌজায় খালের জমি দখলে নবী নগর হাউজিং, মোহাম্মদী হাউজিংয়ের নাম রয়েছে অবৈধ দখলদারদের তালিকায়।

নদী দখলের অভিযোগের বিষয়ে বসুন্ধরা গ্রুপকে ইমেইল করা হলেও তাদের বক্তব্য বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম এখনও জানতে পারেনি।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ এসএন কৈরী বলেছেন, আমিনবাজারের ওই এলাকায় তাদের দখলে কোনো জমি নেই।

বিআইডব্লিউটিএ-এর চেয়ারম্যান কমোডর মাহবুবুল ইসলাম বলেন, “এই জমিটা বেদখল ছিল। বিআইডব্লিউটিএ সে জায়াটা উদ্ধার করেছে এবং এই জায়গাটা ফোরশোরের মধ্যে নাই। বলা হয় ঢাকা নদী বন্দরের পোর্ট লিমিটের দেড়শ ফুটের মধ্যে হল নদীর ফোরশোর। অর্থাৎ, ওই পর্যন্ত হাই ওয়াটার মার্কস। ফোরশোরের বাইরে থাকলে সে জায়গায় সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান হতেই পারে।

“আমরা এই জায়গাটায় একটা ইকো পার্ক করেছি যাতে এলাকার, বিশেষ করে ঢাকার ওই শিল্পাঞ্চল এলাকার বাচ্চারা একটা বিনোদন কেন্দ্র পায়। যেহেতু কমিশন তালিকায় বিআইডব্লিউটিএ-এর নাম প্রকাশ করেছে, আমরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে মতামত জানাব।”

এক প্রশ্নের জবাবে মাহবুবুল ইসলাম বলেন, “১৯৫৮ সালের বিআইডব্লিউটিএ অর্ডিন্যান্স ও ১৯০৮ সালের পোর্ট অ্যাক্ট অনুযায়ী ওই জমি পোর্ট লিমিটের মধ্যে থাকলে তার সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার বিআইডব্লিউটিএ-এর। যেহেতু কমিশন একটা তালিকা দিয়েছে সেহেতু আমরা কমিশনকেও জানাব।”

উচ্ছেদে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ নেই

কমিশনের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান বলেন, নদীর জায়গা অবৈধ দখলমুক্ত করতে জেলা প্রশাসকদের অধীনে প্রাথমিকভাবে এক বছর মেয়াদী ক্র্যাশ প্রোগ্রাম নেওয়া হচ্ছে।

“কমিশন থেকে সব জেলা প্রশাসককে এ বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসকরা নদী দখলমুক্ত করতে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনার জন্য যন্ত্রপাতি সংগ্রহে আর্থিক বরাদ্দ চেয়ে চিঠি দিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে। কিন্তু পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ পাওয়া যাচ্ছে না বলে আমরা জানি। এ ব্যাপারে আমরা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে (ভূমি মন্ত্রণালয়) চিঠি দিয়েছি পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ চেয়ে।”

সরে না গেলে উচ্ছেদের ব্যয় বহন করবে দখলকারীরা

তুরাগ নদীর অবৈধ দখল উচ্ছেদ মামলার আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “উচ্ছেদ করতে একটু সময় লাগবেই। তবে প্রাথমিকভাবে দখলদারদের তালিকা প্রকাশ করে নদী কমিশন একটি ভাল কাজ করেছে।”

তিনি বলেন, এই তালিকাই চূড়ান্ত তালিকা না, কারণ বিএস রেকর্ড অনুযায়ী এই তালিকা করা হয়েছে। নদী দখলকারীদের তালিকা করতে হবে সিএস ও আরএস রেকর্ড অনুযায়ী। ফলে এ তালিকা আরও বড় হবে।

দখলকারীদের যে তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে, তাদের উচ্ছেদ কীভাবে সম্ভব প্রশ্ন করলে মনজিল মোরসেদ বলেন, “প্রথমে দখলদারদের নোটিস করতে হবে, যেন তারা সরে যায়। যদি না যায় তখন তাদের উচ্ছেদ করতে হবে। সে উচ্ছেদের খরচ তখন দখলকারীদের বহন করতে হবে আদালতের রায় অনুযায়ী।

“আর যাদের নাম তালিকায় থাকবে তাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ এবং ব্যাংক ঋণ না দেওয়ার ব্যাপারেও রায়ে নির্দেশনা অছে। দখল উচ্ছেদ, নদী সংরক্ষণে কমিশনকে যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, আমি আশা করি কমিশন সে দায়িত্ব যথাযথভাবেই পালন করবে।”

বিষয়টি আদালতের নজরে আনা হবে কিনা জানতে চাইলে আইনজীবী মনজিল বলেন, “আদালতের যে নির্দেশনা আছে, সেগুলো যদি পালন না হয় বা ব্যত্যয় ঘটে তখন তো আদালতের নজরে আনতেই হবে। আমরা বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণ করছি, আদালতের নির্দেশনার ব্যত্যয় ঘটলে অবশ্যই আমরা তখন আদালতে যাব।”

ঢাকার তুরাগ নদকে ‘জীবন্ত সত্তা’ ঘোষণা করে দেশের সকল নদ-নদী, খাল-বিল ও জলাশয়কে রক্ষার জন্য জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে ‘আইনগত অভিভাবক’ ঘোষণা করে

চলতি বছর ফেব্রুয়ারিতে বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের হাই কোর্ট বেঞ্চ থেকে আসা ওই ঐতিহাসিক রায়ে বলা হয়েছে, নদী রক্ষা কমিশন যাতে নদ-নদী, খাল-বিল ও জলাশয় রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা নিতে পারে, সেজন্য আইন সংশোধন করে সরকারকে ‘কঠিন শাস্তির’ ব্যবস্থা করতে হবে।

রায়ের নির্দেশনায় বলা হয়-

# দেশের প্রতিটি জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন পরিষদকে নিজের এলাকার নদ-নদী, খাল-বিল, জলাশয়ের অবৈধ দখলদারদের চিহ্নিত করে তাদের নামের তালিকা জনসম্মুখে ও পত্রিকায় প্রকাশ করতে হবে।

# নদী বা জলাশয় দখলকারী বা অবৈধ স্থাপনা নির্মাণকারীরা ব্যাংক ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে ‘অযোগ্য’ বিবেচিত হবেন। ঋণ দেওয়ার সময় আবেদনকারীর বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ আছে কি না তা খতিয়ে দেখার যথাযথ ব্যবস্থা করবে বাংলাদেশ ব্যাংক।

# জাতীয় বা স্থানীয়- কোনো ধরনের নির্বাচনে প্রার্থীর বিরুদ্ধে নদী দখলের অভিযোগ থাকলে তাকে নির্বাচনের অযোগ্য ঘোষণা করবে নির্বাচন কমিশন। সে ব্যপারে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।

# দেশের সকল সরকারি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রতি দুই মাসে কমপক্ষে এক ঘণ্টা ‘নদী রক্ষা, সুরক্ষা, দূষণ প্রতিরোধ’, নদ-নদীর প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে সচেতনতামূলক পাঠদানের ব্যবস্থা করতে হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ নির্দেশনা বাস্তবায়ন করবে।

# দেশের সকল শিল্প কারখানার সকল শ্রমিক কর্মচারীর অংশগ্রহণে প্রতি দুই মাসে এক দিন এক ঘণ্টা সচেতনতামূলক সভা বা বৈঠক করতে হবে। শিল্প মন্ত্রণালয় এ নির্দেশনা বাস্তবায়ন করবে।

# দেশের প্রতিটি ইউনিয়ন, উপজেলা, পৌরসভা, জেলা ও বিভাগে প্রতি তিন মাসে একবার নদী বিষয়ে দিনব্যাপী সভা-সমাবেশ, সেমিনার করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ নির্দেশনা বাস্তবায়ন করবে।