আর সেজন্য নদী দখলকে ‘ফৌজদারি অপরাধ’ হিসেবে গণ্য করে ‘জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইন’ সংশোধন করার উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলেছেন তিনি।
ঢাকার মোহাম্মদপুর বসিলায় তুরাগের একটি চ্যানেলটি ভরাট করে আবাসন প্রকল্প গড়ে তুলেছিল আমিন অ্যান্ড মোমিন ডেভেলপমেন্টস লিমিটেড নামের একটি কোম্পানি। সেখানে দখল উচ্ছেদ এবং খনন চালানোর পর নতুন প্রবাহ ফিরে পেয়েছে তুরাগ।
ওই উচ্ছেদ অভিযানের নেতৃত্বে থাকা বিআইডব্লিউটিএর যুগ্ম-পরিচালক এ কে এম আরিফ উদ্দিন বলেন, ওই এলাকায় তুরাগের দুটো চ্যানেল। ৮৯১ ও ৮৯২ নম্বর দাগে ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি আছে। আর মাঝখানে ৮৯০ দাগ সম্পূর্ণ নদীর, সেটি নিয়ে হাই কোর্টের রায়ও আছে।
”কয়েক বছর আগেও চ্যানেলটি প্রবাহমান ছিল। কিন্তু আমিন-মোমিন হাউজিং সম্ভবত ২০১৩ সালের দিকে ওই চ্যানেলটাকে চরের সাথে মিলিয়ে নদী ভরাট করে হাউজিংয়ে রূপান্তর করে।”
বিআইডব্লিউটিএ ও ঢাকা জেলা প্রশাসন ২০১৪ সালের অক্টোবরে সেখানে অভিযান চালিয়ে প্রায় ২৫ বিঘা জমি অবৈধ দখল থেকে মুক্ত করেছিল। কিন্তু তুরাগ তীরে উচ্ছেদ অভিযান চালাতে গিয়ে বার বার দখলদারদের বাধার মুখে পড়ার কথা জানান আরিফ।
“এবার যে উচ্ছেদ অভিযান ২৯ জানুয়ারি থেকে শুরু হল; উচ্ছেদ করতে করতে আমরা ১৯ ফেব্রুয়ারি আমিন-মোমিনে গিয়ে পৌঁছালাম। সেখানে ব্যাপক বাধা দেওয়া হল। উচ্ছেদ অভিযানের নেতৃত্বে আমি ছিলাম। আমাকে পর্যন্ত সাময়িকভাবে উইথড্র করা হল; এই যে তাদের যে প্রভাব, সে কারণে।
“ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে আবার আমি বহাল হলাম। ২০ তারিখে ব্যাপকভাবে উচ্ছেদ অভিযান হল, স্থাপনাগুলো ভেঙে দেওয়া হল।”
যারা মাটি ভরাট করে নদীর অংশ অবৈধ দখলে রেখেছিলেন, তাদের বিরুদ্ধে এখন আইনি প্রক্রিয়া চলছে বলে জানান বিআইডব্লিউটিএ’র এই যুগ্ম-পরিচালক।
তিনি বলেন, ড্রেজিংয়ের কাজে বাধা দিয়েছিল এমন ৬ জনের নামে মামলা চলছে। নদীর ওই অংশ উদ্ধার করতে যে খরচ হয়েছে, তা আদায়ের জন্যও দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
কিন্তু নদী দখলের জন্য তাদের কী শাস্তি হবে?
নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান হাওলাদার বলেন, নদীর পরিবেশ কেউ ধ্বংস করলে আইন অনুযায়ী তাকে দুই বছর পর্যন্ত জেল দেওয়া যায়। নদী তীরের কারখানা নিয়ম ভেঙে বর্জ্য ফেললে দশ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করা যায়। কিন্তু সেই তুলনায় নদী দখলের শাস্তি একেবারেই লঘু।
“নদী দখল যে করে রাখল, তাকে উচ্ছেদ করা যাবে। সিআরপিসির ১৩৩ ধারায় পাবলিক নুইসেন্স হিসেবে পাঁচ দিনের জেল দেওয়া যাবে।”
এ কারণে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানিয়ে চেয়ারম্যান বলেন, “আগামী দুই-চার মাসের মধ্যে আমাদের এটা করতে হবে। আমরা একটা ড্রাফট তৈরি করেছি। সেখানে আমরা নদী দখলকে ‘অপরাধ’ হিসেবে গণ্য করছি।”
আইন সংশোধন হয়ে গেলে দখলদারকে উচ্ছেদের পাশাপাশি দখলের বিষয়টিকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করে শাস্তি দেওয়া যাবে বলে জানান তিনি।
“ইতোমধ্যে আমরা পরিবেশ মন্ত্রণালয়কে বলেছি, যারা নদীর পানি, পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য নষ্ট করল, তাদের কেবল ফাইন করলে হবে না। সে পাঁচ লাখ টাকা ফাইন দিল, কিন্তু পাঁচ কোটি টাকার ব্যবসা করবে। ফলে পাঁচ লাখ টাকা ফাইন দিতে তো তার কোনো অসুবিধা নাই।
“সেজন্য আমরা বলছি তাদের পানিশমেন্ট দিতে হবে…; ১০ দিন, ১৫ দিন, ১ মাস তাদের জেলে ঢুকিয়ে দেন। সেই প্রভিশন কিন্তু পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে আছে। সেইটা আমরা প্রয়োগের জন্য বলেছি।একটা কঠোর প্রয়োগ হলে আমার মনে হয় চেতনা আসবে।”
তুরাগ নদের পুনরুদ্ধার করা চ্যানেলটি গত ২৫ জুলাই নৌ চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়। উৎসবমুখর পরিবেশে তা উদ্বোধন করেন নৌ প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী।
বিআইডব্লিউটিএ কর্মকর্তা আরিফ উদ্দিন বলেন, সরকারের এ সংস্থা কাজ করছে ১৯৫৮ সাল থেকে। তার মধ্যে উচ্ছেদ অভিযান চালানো হচ্ছে দুই দশক ধরে। কিন্তু ভরাট একটি চ্যানেল পুরোপুরি উদ্ধার করার ঘটনা এই প্রথম।
চ্যানেলটি দৈর্ঘ্য প্রায় ৩ হাজার ফুট, চওড়ায় ২৫০ থেকে ৪০০ ফুট। পানি প্রবাহ আনতে মোট ৭ লাখ ঘন মিটার মাটি কাটতে হয়েছে। সেজন্য খরচ হয়েছে প্রায় ৬ কোটি টাকা।
আরিফ উদ্দিন বলেন, সারা বছর পণ্যবাহী নৌযান চলতে পারবে- এরকম একটি গভীরতা রেখে চ্যানেলটি আবার খনন করা হয়েছে।
“আমাদের প্রথম থেকে অ্যাসেসমেন্ট ছিল কাজটা দুই মাসের মধ্যে শেষ করব। কিন্তু এটা বিভিন্ন কারণে, বিভিন্ন চাপ ছিল… আমরা শুধু রাতের বেলা ড্রেজিং করতাম, সয়েলটা তো আবার নদীর ওই পাড়ে নিয়ে ফেলতে হত।নানা রকম জটিলতা ছিল… এভাবে আমাদের প্রায় পাঁচ মাস সময় লেগে যায়।”
চ্যানেল উদ্ধার ছাড়াও এবার চার দফায় ৫০ কার্যদিবস অভিযান চালিয়ে বিআইডব্লিউটিএ মোট ৪৭৭২টি ছোট-বড় অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করেছে। তাতে ১২১ একর জায়গা উদ্ধার হয়েছে; যার মধ্যে তুরাগ, বুড়িগঙ্গা ও বালু নদীর তীরের জমি রয়েছে।
বিআইডব্লিউটিএ’র এই উদ্যোগকে ‘সাধুবাদ’ জানিয়ে নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান হাওলাদার বলেন, তারা ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরের প্রতিনিধিদের সঙ্গে নিয়ে তুরাগের অবস্থা ঘুরে দেখেছেন। টঙ্গী খাল থেকে শুরু করে বসিলা পর্যন্ত গেছেন।
নদী পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণে বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় রেখে কাজ করার ওপর গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন, “ইন আইসোলেশন, আলাদাভাবে এটা বাস্তবায়ন করা যাবে না। যে মাস্টার প্ল্যানে (নদী রক্ষার মহাপরিকল্পনা) ইতোমধ্যে অনারেবল প্রাইম মিনিস্টার সই করেছেন, সেটির সাথে সামঞ্জস্য রেখে, সঙ্গতি রেখে এটি করতে হবে।”
মুজিবুর রহমান জানান, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন ওই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে সমন্বয় করবে।গত ১৭ জুলাই বিষয়গুলো নিয়ে তারা আলোচনাও করেছেন। ঈদের ছুটির পর আরেকটি বৈঠক হবে।
“প্রয়োজনে রিভিজিট হবে। আমরা চাই যুতসই, একটা টেকসই এবং নদী সংরক্ষণ ও পরিবেশ রক্ষায় যেটা উপযোগী হবে সেরকম একটা প্রকল্প নিয়ে এগিয়ে যেতে।”
পানি ফিরে পাওয়া তুরাগের নতুন চ্যানেলের মাঝে একটি দ্বীপের মত ভূখণ্ড। তাতে গাছপালা আর একটি কারখানা বা গুদামের মত একটি স্থাপনা। নৌকায় ওই চ্যানেলের পাড় থেকে দ্বীপে যাওয়া-আসা করা যায়।
বিআইডব্লিউটিএর যুগ্ম-পরিচালক আরিফ জানান, ৮৯১ ও ৮৯২ দাগের ওই চর ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি হওয়ায় অভিযানে সেখানে হাত দেওয়া হয়নি।
আগামীতে ওই চর অধিগ্রহণের পরিকল্পনা রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরা চেষ্টা করছি অধিগ্রহণ করে এটাকে একটা বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে।”
তবে নদীর মাঝে ওই চরে বিনোদনকেন্দ্র গড়ে তোলার পরিকল্পনায় সায় নেই নদী রক্ষা কমিশনের।
মুজিবুর রহমান হাওলাদার বলেন, “যেখানে প্রবাহমান নদী, সেখানে আবার ইকোপার্কিং… আমরা চাই না যে নদীর মধ্যে সেই অংশটুকু থাকুক। সেই অংশটুকু তুলে দিয়ে নদীকে টোটাল প্রবাহে নিয়ে আসতে হবে।”
ইকোপার্ক করতে চাইলে নদীর তীর, ঢাল এবং প্লাবন ভূমি বাদ দেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
আরিফ উদ্দিন জানান, তুরাগের উদ্ধার হওয়া চ্যানেলের পাড় বেঁধে ধাপ করে দেওয়ার, সবুজ বেষ্টনী গড়ে তোলার এবং বেঞ্চ ও ওয়াকওয়ে করারও পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।
কিন্তু তাতে করে নদীর তীর যেন পুরোপুরি সিমেন্টের কাঠামোতে আটকা না পড়ে, সে দিকে নজর দেওয়ার তাগিদ দেন নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যনে।
তিনি বলেন, “বিআইডব্লিউটিএ যদি পাথওয়ে তৈরি করতে চায়, তাহলে এমনভাবে করা যাবে না, যাতে ফ্লাড প্লেইন (প্লাবন ভূমি) আর ফোর শোর (ঢাল) আলাদা হয়ে যায়। তাহলে তো ফ্লাডের পানি যেতে পারবে না, আটকা পড়বে। তারাও এটা বুঝেছে।”
ঢাকার চার নদী এবং চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর দূষণ ও দখল রোধের পাশপাশি নাব্যতা ফেরাতে ইতোমধ্যে ‘মহাপরিকল্পনা’ হাতে নিয়েছে সরকার।
এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের বিভিন্ন ধাপ তুলে ধরে নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, ১০ বছর মেয়াদী এই মহাপরিকল্পনার আওতায় শুরুতে এক বছরের মধ্যে সব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করতে হবে।
তারপর দুই থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে স্বল্প ও মধ্য মেয়াদী কিছু প্রকল্প থাকবে। আর পাঁচ থেকে দশ বছরের মধ্যে বাস্তবায়ন করা হবে দীর্ঘ মেয়াদী কাজগুলো।
তুরাগ রক্ষার জন্য উচ্ছেদ শেষে নদীর সীমানা নির্ধারণ করার ওপর জোর দিচ্ছেন নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান।
তিনি বলেন, সীমানা নির্ধারণের সময় এর ঢালের জায়গা এবং প্লাবন ভূমির (বর্ষায় পানি বাড়লে যে পর্যন্ত আসবে) অংশও চিহ্নিত করে তা সংরক্ষণ করতে হবে।
তুরাগের প্লাবন ভূমির অংশে ইতোমধ্যে অনেকে ব্যবসায়িক স্থাপনা তৈরি হয়েছে জানিয়ে মুজিবুর রহমান হাওলাদার বলেন, “আমরা বিআইডব্লিউটিএকে বলেছি, আপনারা এগুলো ক্যানসেল করে দিন, আপনারা কোনো পারমিশন দিতে পারবেন না।”