বাংলাদেশের ইতিহাসে ‘মাইলফলক’ এই রায়ে নদী দখলকারীদের নির্বাচন করার ও ঋণ পাওয়ার অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে।
নদী রক্ষা কমিশন যাতে নদ-নদী, খাল-বিল ও জলাশয় রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা নিতে পারে, সেজন্য আইন সংশোধন করে ‘কঠিন শাস্তির’ ব্যবস্থা করতে বলা হয়েছে সরকারকে।
পাশাপাশি জলাশয় দখলকারী ও অবৈধ স্থাপনা নির্মাণকারীদের তালিকা প্রকাশ, স্যাটেলাইটের মাধ্যমে দেশের সব নদ-নদী, খাল-বিল ও জলাশয়ের ডিজিটাল ডেটাবেইজ তৈরি এবং সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিল্প কারখানায় নিয়মিত সচেতনতামূলক কর্মসূচি নিতে বলা হয়েছে হাই কোর্টের রায়ে।
তুরাগ নদী রক্ষায় একটি রিট মামলার বিচার শেষে রোববার বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের হাই কোর্ট বেঞ্চ থেকে ঐতিহাসিক এ রায় আসে।
হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের একটি রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে তুরাগ নদীর অবৈধ দখলদারদের নাম ও স্থাপনার তালিকা হাই কোর্টে দাখিল করেছিল বিচার বিভাগীয় একটি তদন্ত কমিটি। ওই তালিকায় আসা প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিরা পরে এ মামলায় পক্ষভুক্ত হন।
উভয় পক্ষের দীর্ঘ শুনানি নিয়ে হাই কোর্ট গত বুধবার নদী রক্ষায় রায় ঘোষণা শুরু করে। সেদিনই তুরাগ নদীকে ‘লিগ্যাল পারসন’ বা ‘জুরিসটিক পারসন’ ঘোষণা করা হয়, যা দেশের সব নদ-নদীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে বলে রিটকারীপক্ষের আইনজীবী জানান।
জীবন্ত সত্তা হিসেবে মানুষ যেমন সাংবিধানিক অধিকার ভোগ করে, আদালত নদীকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণা করায় নদীর ক্ষেত্রেও তেমন কিছু মৌলিক অধিকার স্বীকৃত হবে।
এ মামলার অবশিষ্ট রায় গত বৃহস্পতিবারই ঘোষণা করার কথা থাকলেও জাতীয় নদীরক্ষা কমিশন বা বিদ্যমান আইনের সঙ্গে রায়ের নির্দেশনা যেন সাংঘর্ষিক বা পরস্পরবিরোধী না হয়, সে জন্য সময় নেয় আদালত। এরপর রোববার বিস্তারিত নির্দেশনা সহ রায় ঘোষণা করা হয়।
হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের পক্ষে এ মামলার শূনানি করেন মনজিল মোরসেদ। আর রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল একরামুল হক, সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল পূরবী রানী শর্মা ও পূরবী সাহা।
সংবিধানের ১৮(ক), ১৯ ও ৩২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জনগণের জানমাল, সম্পদ, স্বাস্থ্য, পরিবেশ রক্ষার দায়িত্ব হল রাষ্ট্রের। তাই রায়ে ‘ডকট্রিন অব পাবলিক ট্রাস্ট’ কে ‘ল অব দ্য ল্যান্ড’ ঘোষণা করে আদালত চারটি সিদ্ধান্ত দিয়েছে।
রায়ে বলা হয়েছে, রাষ্ট্র দেশের সকল নদ-নদী, পাহাড়-পর্বত, সমুদ্র সৈকত, বন, খাল-বিল, জলাশয়-জলাধারের ‘মালিক’ হিসেবে ‘ট্রাস্টি’র মত দায়িত্ব পালন করবে।
“প্যারেন্স প্যট্রিয়া জুরিসডিকশনের আওতায় আদালত তুরাগ নদকে জীবন্ত সত্তা, জুরিসটিক ও লিগ্যাল পারসন হিসেবে ঘোষণা করছে।”
রায়ে বলা হয়েছে, দেশের সকল নদ-নদী খাল-বিল জলাশয় রক্ষার জন্য ‘পারসন ইন লোকো পেরেনটিস’ বা ‘আইনগত অভিভাবক’ হবে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। ফলে দেশের সকল সকল নদ-নদী খাল-বিল জলাশয়ের সুরক্ষা, সংরক্ষণ, অবৈধ দখল উচ্ছেদ, শ্রীবৃদ্ধিসহ সকল দায়িত্ব বর্তাবে নদী রক্ষা কমিশনের ওপর।
নদী রক্ষা কমিশন যাতে কার্যকর একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে সেই দায়িত্ব পালন করতে পাবে, তা নিশ্চিত করতে সরকারকে চার দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
সেখানে বলা হয়েছে, নদ-নদী, খাল-বিল জলাশয় দখলকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করে এর ‘কঠিন সাজা ও জরিমানা’ নির্ধারণ করতে হবে। এসব বিষয় যুক্ত করে ২০১৩ সালের নদী রক্ষা কমিশন আইন সংশোধন করে ছয় মাসের মধ্যে তা হলফনামা আকারে আদালতে দাখিল করতে হবে।
নদ-নদীর পাশে প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে জাতীয় নদীরক্ষা কমিশনের অনাপত্তিপত্র নিতে হবে। এ বিষয়টি সরকারের সকল বিভাগকে চিঠি দিয়ে জানাতে মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে নির্দেশ দিয়েছে আদালত।
আদালত বলেছে, স্যাটেলাইটের মাধ্যমে দেশের সকল নদ-নদী, খাল-বিল, জলাশয়ের অবস্থান চিহ্নিত ও নির্ণয় করে একটি ডিজিটাল ডেটাবেইজ তৈরি করতে হবে। সেই ডেটাবেইজ দেশের সকল ইউনিয়ন, উপজেলা, পৌরসভা, জেলা ও বিভাগে নাগরিকের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে হবে। যে কোনো নাগরিক যেন নির্দিষ্ট ফি দিয়ে নদ-নদীর ম্যাপ, তথ্য সংগ্রহ করতে পরেন, সে ব্যবস্থা করতে হবে।
# দেশের প্রতিটি জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন পরিষদকে নিজের এলাকার নদ-নদী, খাল-বিল, জলাশয়ের অবৈধ দখলদারদের চিহ্নিত করে তাদের নামের তালিকা জনসম্মুখে ও পত্রিকায় প্রকাশ করতে হবে।
# নদী বা জলাশয় দখলকারী বা অবৈধ স্থাপনা নির্মাণকারীরা ব্যাংক ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে ‘অযোগ্য’ বিবেচিত হবেন। ঋণ দেওয়ার সময় আবেদনকারীর বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ আছে কি না তা খতিয়ে দেখার যথাযথ ব্যবস্থা করবে বাংলাদেশ ব্যাংক।
# জাতীয় বা স্থানীয়- কোনো ধরনের নির্বাচনে প্রার্থীর বিরুদ্ধে নদী দখলের অভিযোগ থাকলে তাকে নির্বাচনের অযোগ্য ঘোষণা করবে নির্বাচন কমিশন। সে ব্যপারে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।
# দেশের সকল সরকারি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রতি দুই মাসে কমপক্ষে এক ঘণ্টা ‘নদী রক্ষা, সুরক্ষা, দূষণ প্রতিরোধ’, নদ-নদীর প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে সচেতনতামূলক পাঠদানের ব্যবস্থা করতে হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ নির্দেশনা বাস্তবায়ন করবে।
# দেশের সকল শিল্প কারখানার সকল শ্রমিক কর্মচারীর অংশগ্রহণে প্রতি দুই মাসে এক দিন এক ঘণ্টা সচেতনতামূলক সভা বা বৈঠক করতে হবে। শিল্প মন্ত্রণালয় এ নির্দেশনা বাস্তবায়ন করবে।
# দেশের প্রতিটি ইউনিয়ন, উপজেলা, পৌরসভা, জেলা ও বিভাগে প্রতি তিন মাসে একবার নদী বিষয়ে দিনব্যাপী সভা-সমাবেশ, সেমিনার করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ নির্দেশনা বাস্তবায়ন করবে।
বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে ‘তুরাগ নদীর অবৈধ দখলদার’ হিসেবে নাম আসায় যেসব প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি এই রিট মামলায় পক্ষভুক্ত হয়েছিলেন, তাদের অবৈধ স্থাপনা সরিয়ে নিতে ৩০ দিন সময় বেঁধে দিয়েছে আদালত।
রায়ে বলা হয়েছে, এই নির্দেশনা অনুযায়ী ৩০ দিনের মধ্যে বিবাদীরা স্থাপনা সরিয়ে না নিলে সরকার বিবাদীদের খরচেই অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের ব্যবস্থা করবে।
বিবাদীদের মধ্যে কেউ সরকারি ইজারার মাধ্যমে নদী তীরের জমি দখল করে স্থাপনা তৈরি করে থাকলে সেই ইজারাও বাতিল বলে গণ্য হবে। এর অংশ হিসেবে ফলে হামীম গ্রুপ্রের সাজিদ ওয়াশিংয়ের লিজও বাতিল ঘোষণা করেছে আদালত।
হাই কোর্ট রায় ঘোষণা করলেও তুরাগ নদী নিয়ে এই রিট মামলা একটি চলমান মামলা হিসেবে বিবেচিত হবে যেন আদালতের নির্দেশনার বাস্তবায়ন সময় সময় পর্যালোচনা করা যায়।
রায়ের একটি অনুলিপি প্রধানমন্ত্রীর কাছেও পাঠাতে বলেছে আদালত, যাতে এ রায়ের ভিত্তিতে তিনি অবৈধ দখলকারী বা স্থাপনা নির্মাণকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেন।
রায়ের পর মনজিল মোরসেদ সাংবাদিকদের বলেন, “আদালতের আগের একটি রায়ে বলা হয়েছে, নদীর সীমানার জায়গায় ক্রয়সূত্রে অন্যের মালিকানা স্বত্ত্ব সৃষ্টি হয় না। ঢাকার চার নদীর রিট মামলার রায়, সংবিধানের ১৮ (ক) অনুচ্ছেদ, পরিবেশ আইন, ১৯৯৫ এবং জলাধার আইন, ২০০০-এর বিধান অনুযায়ী নদীর সীমানা দখল সম্পূর্ণ বেআইনি এবং পরিবেশবিরোধী।”
এ রায়ের কয়েক দফা নির্দেশনা ও পর্যবেক্ষণে রাষ্ট্রপক্ষের কোনো আপত্তি আছে কিনা জানতে চাইলে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল একরামুল হক টুটুল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এ রায়ের সাথে রাষ্ট্রপক্ষের কোনো মতভিন্নতা নাই। রাষ্ট্রও দ্রুত জাজমেন্ট চাইছিল। আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী রাষ্ট্র কী কী ব্যবস্থা নিয়েছে তা আমরা ইতোমধ্যে এফিডেভিট দিয়ে বলেছি।’
তুরাগ নদের তীরে হামীম গ্রুপ্রের সাজিদ ওয়াশিংয়ের লিজ দলিল বাতিল করা হয়েছে রায়ে, যা সরকারের কাছ থেকে লিজ নিয়েছিল হামীম গ্রুপ।
রাষ্ট্রপক্ষ রায়ের এ নির্দেশনার বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নেবে কিনা- জানতে চাইলে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, “ফুল জাজমেন্টটা পাওয়ার পরে দেখে আইনগত কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার থাকলে, পরে আমরা সিদ্ধান্ত নেব। আমরাও চাই যেন বেআইনি কোনো কিছু না হয়। যা কিছু হবে, আইন মেনেই হবে।”