বুড়িগঙ্গা দূষণকারীদের বিরুদ্ধে মামলার নির্দেশ আদালতের

ঢাকার কেরানীগঞ্জের ৩০টি ওয়াশিং প্ল্যান্টসহ বুড়িগঙ্গার পানি দূষণের জন্য দায়ী ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও কারখানার বিরুদ্ধে মামলা করতে পরিবেশ অধিদপ্তরকে নির্দেশ দিয়েছে হাই কোর্ট।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 Jan 2021, 12:27 PM
Updated : 3 Jan 2021, 12:27 PM

বুড়িগঙ্গা দূষণ রোধে জনস্বার্থে করা এক রিট মামলার রুল শুনানির ধারাবাহিকতায় রোববার বিচারপতি গোবিন্দ চন্দ্র ঠাকুর ও মোহাম্মদ উল্লাহর হাই কোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেয়।

ঢাকা জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালককে ৩০ দিনের মধ্যে মামলা করতে বলা হয়েছে।

ওয়াশিং প্ল্যান্টগুলো হচ্ছে- আহামদ হোসেন ওয়াশিং, আমেনা ওয়াশিং, সানমুন ওয়াশিং, ইডেন ওয়াশিং, বিসমিল্লাহ ওয়াশিং, লোটাস ওয়াশিং, গ্লোবাল ওয়াশিং, রুবেল ওয়াশিং, আনুশকা ওয়াশ, সততা ওয়াশিং, চঞ্চল ওয়াশিং, আব্দুর রব ওয়াশিং, ঢাকা ওয়াশিং, আজান ওয়াশিং, নিউ সাহারা ওয়াশিং, দোহার ওয়াশিং, রিলেটিভ ওয়াশিং, নিউ নাশা ওয়াশিং, ইউনিক ওয়াশিং, মৌ ওয়াশিং, সেতু ওয়াশিং, কোয়ালিটি ওয়াশিং, জুয়েনা ওয়াশিং, কামাল ওয়াশিং, ওয়াটার কালার ওয়াশিং, পারজোয়ার ওয়াশিং, জিএম ওয়াশিং, কুমিল্লা ওয়াশিং, আছিয়া ওয়াশিং ও লিলি ওয়াশিং। 

সেই সঙ্গে কেরানীগঞ্জে বুড়িগঙ্গার পানিতে বা তীরে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যেন ময়লা-আবর্জনা ফেলতে না পারে, সে বিষয়ে তদারকির ব্যবস্থা করতে ঢাকার জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, কেরানীগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান, নির্বাহী কর্মকর্তা ও কেরানীগঞ্জ থানার ওসিকে নির্দেশ দিয়েছে আদালত।

পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষে রুল শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী আমাতুল করিম। রিট আবেদনকারী পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল কাজী মাঈনুল হোসেন।

মনজিল মোরসেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বুড়িগঙ্গায় দূষণ ঠেকাতে আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী পরিবেশ অধিদপ্তর অবৈধ বা বুড়িগঙ্গা দূষণকারী কারখানা বন্ধ করে দেয়। দুই-দুইবার কারখানাগুলো বন্ধ করা হলেও কারখানাগুলো আবার চালু করা হয়েছে। ফলে আগের মতোই দূষণের শিকার হচ্ছে বুড়িগঙ্গার পানি। কিন্তু পরিবেশ আইন অনুযায়ী দূষণকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করার বিধান থাকলেও পরিবেশ অধিদপ্তর এখনও কোনো মামলা করেনি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের আইনজীবী আমাতুল করিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, আগের আদেশ প্রতিপালন নিয়ে অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে একটি প্রতিবেদন আদালতে এদিন দেওয়া হয়। ওই প্রতিবেদনে গত বছর ২৪ নভেম্বর অভিযানের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে।

তিনি বলেন, “ওই দিন পরিবেশ অধিদপ্তরের ভাম্যমাণ আদালত ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর সহযোগিতায় কেরানীগঞ্জের বাঁশপট্টি, জিনজিয়া ও টাওয়ারঘাট এলাকায় ১৭টি ওয়াশিং প্ল্যান্টের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে কাজ বন্ধ করা হয়। কিন্তু তদারকির জন্য উপজেলা পর্যায়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের যথেষ্ট জনবল ও সক্ষমতা না থাকার সুযোগ নিয়ে কারখানার মালিকরা আবার কারখানা চালু করে ফেলে।”

মনজিল মোরসেদ বলেন, “আজ পরিবেশ অধিদপ্তরের দাখিল করা প্রতিবেদন থেকে দেখা যায় যে, ৩০টি ওয়াশিং প্ল্যান্ট রয়েছে সেখানে। সেগুলো মারাত্মক পানি দূষণ করছে। ফলে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের নির্দেশনা দেওয়া প্রয়োজন, নয় দূষণ বন্ধ হবে না। এমন আরজি জানালে আদালত এই ৩০টি ওয়াশিং প্ল্যান্টসহ যেসব ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, কারখানা বুড়িগঙ্গা দূষণের জন্য দায়ী তাদের বিরুদ্ধে মামলা করতে নির্দেশ দিয়েছেন।”

শিল্পঘন ৩ জেলায় ‘পর্যাপ্ত পদ-জনবল নেই’

পরিবেশ অদিদপ্তরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকা বিভাগের অধীন ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর জেলায় পরিবেশ দূষণ করার মতো হাজার হাজার শিল্পকারখানা থাকলেও অধিদপ্তরের ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর জেলা কার্যালয়ে একজন উপপরিচালকের নেতৃত্বে মাত্র ১৪ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর পদ রয়েছে। জনবল স্বল্পতার কারণে কোনো সময়ই ওই সকল কার্যালয়ের সবগুলো পদে জনবল পদায়ন করা সম্ভবপর হয়নি।

পরিবেশ অধিদপ্তর বলছে, এই তিনটি কার্যালয়ের অধীনে অনেক শিল্প কারখানায় ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট (ইটিপি) থাকলেও জনবল স্বল্পতার কারণে ইটিপিগুলো সার্বক্ষণিক চালু রাখা নিশ্চিতে পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃক তদারক করা এবং দায়ী শিল্প কারখানার বিরুদ্ধে এনফোর্সমেন্ট অভিযান পরিচালনা করা সম্ভবপর হচ্ছে না।

ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর জেলায় ক্রমান্বয়ে শিল্পকারখানা বাড়তে থাকায় নদ-নদী, খাল-বিল, জলাশয়, বন, কৃষিজমি, জীববৈচিত্র্য তথা প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণ ও দূষণ নিয়ন্ত্রণের পরিবেশ অধিদপ্তরের জেলা কার্যালয়গুলোকে পরিচালকের কার্যালয়ে উন্নীত করে তদারক, গবেষণাগার ও এনফোর্সমেন্টের জন্য পদ সৃষ্টি করে পর্যাপ্ত সংখ্যক জনবল নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

পদ সৃষ্টির জন্য প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে বিভিন্ন সময় প্রস্তাব পাঠানো হলেও তা বিবেচনা করা হয়নি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর।

“পরিবেশ, প্রতিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য শিল্পায়ন উপজেলায় পরিবেশ অধিদপ্তরের কার্যালয় স্থাপনের জন্য ২০১৯ সালের ১ অগাস্ট জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হলেও এখন পর্যন্ত কোনো সাড়া মেলেনি।”

বুড়িগঙ্গা নদীর পানি দূষণ রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা চেয়ে এইচআরপিবির পক্ষে ২০১০ সালে একটি রিট আবেদন করা হয়। চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০১১ সালের ১ জুন তিন দফা নির্দেশনাসহ রায় দেয় হাই কোর্ট। 

এর মধ্যে বুড়িগঙ্গায় বর্জ্য ফেলা বন্ধে অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে এবং বুড়িগঙ্গা নদীতে সংযুক্ত সব পয়ঃপ্রণালীর লাইন (সুয়ারেজ) ও শিল্পকারখানার বর্জ্য নিঃসরণের লাইন ছয় মাসের মধ্যে বন্ধ করার নির্দেশনা ছিল।

ওইসব নির্দেশনা পুরোপুরি বাস্তবায়ন না হওয়ায় ২০১৯ সালের ৩০ এপ্রিল সম্পূরক আবেদন করে এইচআরপিবি।

ওই আবেদনের ওপর শুনানির এক পর্যায়ে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এম খানকে তলব করে হাই কোর্ট।

পরে গত বছর ৪ মার্চ তাকসিম এম খান আদালতে হাজির হয়ে রায় বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দেন।

পরবর্তীকালে ১৮ অগাস্ট ও ৭ সেপ্টেম্বর ওয়াসার পক্ষ থেকে আরও দুটি প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করা হলেও রায় ও আদেশ বাস্তবায়নের কোনো অগ্রগতি না থাকায় তা গ্রহণ করেনি আদালত।

গত বছর ১৪ সেপ্টেম্বর ওয়াসার এমডি পক্ষে আরও একটি প্রতিবেদন দাখিল করা হলে আদালত সেটিও গ্রহণ করেনি।

সেদিনই আদালত পরিবেশ অধিদপ্তরের ঢাকা বিভাগের পরিচালক, ঢাকার জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার, কেরানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহি কর্মকর্তা ও থানার ওসিকে নির্দেশ দিয়ে বলেছিল, দুই সপ্তাহের মধ্যে বুড়িগঙ্গার দক্ষিণ পাশে নদী ও নদী তীরে ময়লা-আবর্জনা, বর্জ্য ফেলা বন্ধ করতে।

১৫ দিনের মধ্যে আদেশ প্রতিপালনের প্রতিবেদনও দিতে বলা হয়। সেই আদেশের ধারাবাহিকতায় আবার আদেশ দিল উচ্চ আদালত।