বাংলাদেশে সন্ত্রাস ও ধর্মীয় চরমপন্থা মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের কার্যক্রমের প্রশংসা করেছে ইউরোপের শীর্ষস্থানীয় অলাভজনক সংস্থা ইউরোপিয়ান ফাউন্ডেশন ফর সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ (ইএফএসএএস)।
Published : 28 Apr 2021, 10:32 AM
গভীর বিশ্লেষণের ভিত্তিতে তৈরি মন্তব্য প্রতিবেদনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের স্বীকৃত সংস্থাটি বলেছে, দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক প্রতিবেশী পাকিস্তান যেখানে ‘চরমপন্থি ও সন্ত্রাসীদের উৎসাহ, আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে’ সেখানে এদের দমনে বাংলাদেশের ভূমিকা যথেষ্ট ইতিবাচক।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের কট্টরপন্থি ইসলামি গোষ্ঠী হেফাজতে ইসলাম ও পাকিস্তানের কট্টরপন্থি তেহরিক-ই-লাব্বাইক পাকিস্তানের (টিএলপি) কার্যক্রম তুলে ধরে ইএফএসএএস বলেছে, এসব গোষ্ঠী এই দুই দেশে সরকারের উদ্বেগের কারণ সৃষ্টি করেছে; নিজ নিজ দেশের সরকারের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে সহিংস ও প্রাণঘাতী বিক্ষোভে জড়িয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গত মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বাংলাদেশ সফরের বিরোধিতায় পরিচালিত সহিংস বিক্ষোভের পর সরকার হেফাজতের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তার অভিযান চালায়। এই প্রেক্ষাপটে সরকারের ক্ষোভ কমাতে হেফাজত তাদের কেন্দ্রীয় কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করে।
অথচ পাকিস্তানে টিএলপি সেদেশ থেকে ফরাসি রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কারের দাবিতে বিক্ষোভ দেখিয়ে পার্লামেন্টে বিতর্ক করতে তাদের সরকারকে বাধ্য করেছে। ফ্রান্সে মহানবী হযরত মুহাম্মদের ক্যারিকেচার প্রচারের পর সম্প্রতি ফরাসি রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কারের দাবিতে রাজপথে নামে টিএলপি।
‘বাংলাদেশ অ্যান্ড পাকিস্তান: অ্যাকটিং এগেইনস্ট এক্সট্রেমিজম ভারসাস মেকিং এ শো অব অ্যাকটিং এগেইনস্ট এক্সট্রেমিজম’ শিরোনামে এ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
ইএফএসএএস বলছে, “এটা প্রমাণিত যে, যেখানে শেখ হাসিনার সরকার কট্টরপন্থি ইসলামি গোষ্ঠী হেফাজতকে মোকাবেলায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখিয়েছে, সেখানে পাকিস্তান এ ব্যাপারে নাটকীয় সংকটে পড়ে ধারাবাহিকতা রাখতে পারেনি এবং টিএলপির মতো গোষ্ঠীকে মোকাবেলায় দুর্বল বিবেচনা ও দুর্বল পদক্ষেপ বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছে।”
গত বছর অক্টোবরে ফ্রান্সে বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে মহানবীর কার্টুন প্রদর্শনের কারণে মুসলিম শিক্ষককে হত্যার পর প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর ধর্ম বিষয়ে উদার দৃষ্টিভঙ্গীর সমর্থনে করা মন্তব্যের প্রতিবাদে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে হাজারো মানুষের বিক্ষোভ দেখায় হেফাজত ও টিএলপি।
বিক্ষোভে ফ্রান্সের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার এবং আনুষ্ঠানিকভাবে ফরাসি পণ্য বর্জনে মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর সরকারের প্রতি দাবি জানানো হয়।
টিএলপির মুখপাত্রের বরাত দিয়ে রয়টার্স বলেছে, ফরাসি পণ্য বর্জনের সিদ্ধান্ত অনুমোদন করার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সরকারের সঙ্গে চুক্তি সইয়ের পর ১৭ নভেম্বর কট্টরপন্থী গোষ্ঠীটি তাদের আন্দোলনের ইতি টানে।
একই সময়ে বাংলাদেশে হেফাজতের কয়েক হাজার কর্মী ঢাকায় ফরাসি দূতাবাস ঘেরাও করতে গেলে পুলিশ তাদের বাধা দেয়। পরে সে আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়ে।
কিন্তু পাকিস্তানে টিএলপি থেমে থাকেনি। একই দাবিতে বিক্ষোভের মধ্যে সহিংসতায় কমপক্ষে চার পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হওয়ার পর এপ্রিলের শুরুতে পাকিস্তান সরকার তাদের নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে বাধ্য হয়। পরিস্থিতি এতোটাই অবনমন হয় যে এক পর্যায়ে ১১ কর্মকর্তাকে জিম্মিও করে টিএলপি।
চরমপন্থিদের চাপের কাছে নতি স্বীকার করে পার্লামেন্টে তোলা ফরাসি রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কারের প্রস্তাবের ওপর গত সপ্তাহে আলোচনা শুরু করে পাকিস্তান সরকার।
ফরাসি নাগরিকদের সাময়িকভাবে পাকিস্তান ছেড়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে ‘সেদেশে ফ্রান্সের স্বার্থ হুমকির মুখে’ বলে সতর্ক করা হয়।
নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, সামাজিক অস্থিতিশীলতা, করোনাভাইরাসের সংক্রমণের নতুন ঢেউ এবং রুগ্ন অর্থনীতির পাকিস্তানে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের প্রশাসন কতোটা নাজুক অবস্থানে আছে তা পার্লামেন্টে ওই প্রস্তাব তোলার পদক্ষেপ দেখেই বুঝা যায়।
“পাকিস্তানকে অস্থিতিশীল করে তোলার ক্ষেত্রে তেহরিক-ই-লাব্বাইক পাকিস্তান যে বড় হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারে এটাতে সে ইঙ্গিতও মেলে।”
ফ্রান্সে কার্টুন প্রদর্শনের জেরে পাকিস্তানে টিইএলের ২৬ বছর বয়সী নেতা সাদ হুসাইন রিজভি বিক্ষোভের ডাক দেওয়ার পর গ্রেপ্তার হন।
ওই ঘটনা তুলে ধরে ইএফএসএএসের প্রতিবেদনে বলা হয়, টিএলপি বেরেলভির ইসলামি মতাদর্শ অনুসারীদের সমর্থনপুষ্ট, পাকিস্তানের জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ এই মতাদর্শ সমর্থন করে।
আর বাংলাদেশে হেফাজত মূলত কওমি মাদ্রাসানির্ভর সংগঠন, যারা ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসার নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত মতাদর্শ অনুসরণ করে।
মার্চের শেষদিকে বাংলাদেশে মোদীবিরোধী বিক্ষোভ-সহিংসতার পর জাতীয় সংসদে দেওয়া বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রশ্ন তোলেন, “এখন হেফাজতে ইসলাম বিক্ষোভ করছে। শিক্ষা নেওয়ার জন্য কি তারা দেওবন্দে যায় না? এ ধরনের কর্মকাণ্ড করার পর তারা কীভাবে দেওবন্দে যাবে? তারা এটা নিয়ে ভেবেছে?”
বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের, যিনি একটি সাম্প্রদায়িকতামুক্ত দেশের স্বপ্ন নিয়ে বাংলাদেশের ভিত রচনা করেছিলেন। তার জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে ভারতের হিন্দু জাতীয়তাবাদী নেতা নরেন্দ্র মোদীর অংশগ্রহণের বিরোধিতা করে রাজপথে নেমেছিলো হেফাজত।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর মুহূর্তে এমন বিক্ষোভের মুখে দেশ ও সরকারের ভাবমূর্তি রক্ষায় শেখ হাসিনার সরকার ধৈর্য্যে নিয়ে পরিস্থিতি মোকাবেলা করে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী হেফাজতের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে এবং শীর্ষ নেতা ও সহিংসতায় জড়িত কর্মীদের গ্রেপ্তার করে।
ইসলামে নিষিদ্ধ দাবি করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য গুঁড়িয়ে দেওয়ার হুমকিদাতা হেফাজত নেতা বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন।
পুলিশের তদন্ত ও জিজ্ঞাসাবাদের বরাতে প্রতিবেদনে বলা হয়, পাকিস্তানের সন্ত্রাসীগোষ্ঠী ও রাজনৈতিক দল, সম্ভবত টিএলপির সঙ্গে হেফাজত নেতা মামুনুলের যোগাযোগ আছে কিনা তা নিশ্চিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার যুগ্ম কমিশনার মাহবুব আলম জানান, হেফাজতকে পাকিস্তানের তেহরিক-ই-লাব্বাইক এর মতো একটি গোষ্ঠী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে বাংলাদেশকে পাকিস্তান অথবা আফগানিস্তানের মতো একটি দেশে পরিণত করতে চাইছেন এসব চরমপন্থি নেতারা।
আর উপ-কমিশনার হারুনর রশিদ জানান, মামুনুল এবং তার শ্যালক মাওলানা মুফতি নেয়ামত উল্লাহ ২০০৫ সালে পাকিস্তানে তাদের ৪৫ দিনের সফরে সেখানকার জঙ্গিগোষ্ঠী ও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন মুফতি নেয়ামত। কিন্তু পরে তিনি ছাড়া পেয়ে যান।
হেফাজত নিজেদের কথিত অরাজনৈতিক গোষ্ঠী হিসেবে পরিচয় দিলেও, খেলাফত মজলিস নামে আরেকটি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মামুনুলের ‘রাজনৈতিক উচ্চাভিলাস’ রয়েছে বলে জানান উপকমিশনার হারুনুর রশিদ।
বেশ কয়েকজন শীর্ষ স্থানীয় নেতা গ্রেপ্তার হওয়ার পর হেফাজত ২৫ এপ্রিল কেন্দ্রীয় কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করে। একই দিন কওমি মাদ্রাসার কার্যক্রম দেখভালের দায়িত্বে থাকা বোর্ড এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়।
কেন্দ্রীয় কমিটি বিলুপ্ত হলেও মামুনুলের বড় সমর্থক হেফাজতের আমির জুনাইদ আহমদ বাবুনগরী এখনও এই গোষ্ঠীর শীর্ষ পদেই আছেন। নবগঠিত আহ্বায়ক কমিটিও করা হয়েছে তার মামা মুহিবুল্লাহ বাবুনগরীর নেত্বেত্বে। ফলে হেফাজত শেষ পর্যন্ত টিএলপির পথ ধরবে কিনা সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
ইএফএসএএসের মন্তব্য প্রতিবেদনে সন্ত্রাস ও চরমপন্থা মোকাবেলায় এ অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ দুই মুসলিম দেশের গৃহীত দৃষ্টিভঙ্গী ও নীতির স্পষ্ট পার্থক্যের বিষয়টিতে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
এতে বলা হয়, “নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের এই ৫০ বছরে এমন সময়ও গেছে যখন এই দেশে সন্ত্রাস ও চরমপন্থাকে আশ্রয়, প্রশ্রয় ও উৎসাহ যোগানো হয়েছে। এটা বিশেষভাবে সত্য যখন অতীতে পাকিস্তানের প্রভাব অনেকটাই এর চালিকাশক্তি ছিল।
“তবে গত এক দশকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এই দেশে একটি বিস্তৃত ও ধারাবাহিক সন্ত্রাস-বিরোধী শক্তি ক্ষমতায় আছে। অন্যদিকে পাকিস্তান ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করেছে এবং বিভিন্ন বর্ণের চরমপন্থি ও সন্ত্রাসীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বজায় রেখে চলার ব্যাপারে তাদের লক্ষ্যে অবিচল থেকেছে।
“গত সপ্তাহের ঘটনাবলী দুই দেশের দৃষ্টিভঙ্গীর মধ্যে যে বিশাল পার্থক্য আছে তা স্পষ্ট করেছে এবং সভ্য দেশগুলোর এসব ঘটনাবলীকে সন্ত্রাসবিরোধী অবস্থানের ক্ষেত্রে একটি বার্তা হিসেবে গ্রহণ করা এবং পাকিস্তানের ওপর চাপ শিথিল না করার বিষয়ে অবস্থান ধরে রাখা দরকার।”
শেখ হাসিনার সরকার ভবিষ্যতেও এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে যে সক্ষম হবে সে সেবিষয়ে আমস্টারডামভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি যথেষ্ট আশাবাদী।
“শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আন্তরিকভাবেই সন্ত্রাস ও চরমপন্থার বিরুদ্ধে অবস্থান ধরে রাখতে চায় এবং সেকারণে এখন পর্যন্ত এ ধরনের বেশিরভাগ পদক্ষেপেই তারা সফল। অথচ এর বিপরীত অবস্থানে পাকিস্তান এসব বিষয়ে সমসময়ই লুকোচুরির আশ্রয় নিয়েছে। তারা বরং বেশি আগ্রহী বিশ্বকে এমন একটি ধারণা দিতে, যে তারা সন্ত্রাস ও চরমপন্থার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে, অথচ তারা আসলে অতীতের পথই ধরে রেখেছে এবং সন্ত্রাস ও চরমপন্থা টিকিয়ে রাখার কিছু বিপদজনক নীতি ধরে রেখেছে।
“নির্ভয়ে সন্ত্রাস ও চরমপন্থা মোকাবেলায় পাকিস্তানের একইসঙ্গে নৈতিক দৃঢ়তা ও কর্তৃত্বের ঘাটতি রয়েছে। অন্যদিকে এই উদ্দেশ্য সাধনে শেখ হাসিনার আন্তরিকতা তাকে শক্তিশালী করেছে এসবের বিরুদ্ধে সফল পদক্ষেপ গ্রহণে,” এভাবেই প্রতিবেদনের সমাপ্তি টেনেছে ইএফএসএএস।