বাসিন্দা নিয়ামুলের অভিযোগ, সংকট স্থায়ী রূপ নিয়েছে। তবে সেটি তীব্র হয়েছে বছর দুই ধরে। এখন ঘোলা পানির সঙ্গে পোকাও আসে।
Published : 12 May 2024, 01:22 AM
“ওয়াসার পানিতে এখনও তীব্র দুর্গন্ধ। খাওয়া যায় না, রান্নায়ও ব্যবহার করা যায় না। সরবরাহ কিছুটা বেড়েছে। পানির মানে কোনো পরিবর্তন হয়নি।”
হতাশা আর ক্ষোভের কথা বলছিলেন রাজধানী ঢাকার জুরাইনের বাসিন্দা মিজানুর রহমান, যিনি ২০১৯ সালের ২৩ এপ্রিল বিশুদ্ধ পানির দাবি নিয়ে স্ত্রী-সন্তানসহ দাঁড়িয়েছিলেন ঢাকা ওয়াসার সামনে।
বছরের পর বছর পাইপলাইনে নোংরা ও দুর্গন্ধযুক্ত পানি সরবরাহের প্রতিবাদে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালককে জুরাইনের পানি দিয়ে বানানো শরবত খাওয়াতে চেয়েছিলেন তিনি।
মিজানুরের প্রতিবাদ সে সময় আলোচনার জন্ম দিয়েছিল। এরপর কেটে গেছে পাঁচটি বছর। বদলে গেছে রাজধানীর অনেক এলাকার চেহারা। শুধু বদলায়নি জুরাইনে সরবরাহ করা ওয়াসার পানির গুণমান।
জুরাইনের বিভিন্ন অলি গলির মত পাশের মুরাদপুর ঘুরেও দেখা গেছে ওয়াসার পানির একই দুর্দশা। খাওয়ার অযোগ্য, সাদা কাপড় ধুলে কালচে হয়ে যায়।
পূর্ব জুরাইন এলাকার কমিশনারের মোড়ে মনোয়ারা বেগমের বাসা। বছরের পর বছর খাবার ও রান্নার পানির কষ্টে ভুগতে হচ্ছে তাকে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বললেন, “বাসায় যে পানি আসে তা ঘোলা, তীব্র দুর্গন্ধ। এ জন্য পানি কিনে খেতে হয়।
“এখন তো পানি একটু কম ঘোলা। তবে মাঝে মাঝে কাদার মত ঘোলা পানি আসে। এ দিয়েই রান্না করতে হয়। খাওয়ার জন্য পানি কিনে আনি। দিনে ২০ টাকার পানি লাগে।”
স্থানীয় বাসিন্দা নিয়ামুল হকের অভিযোগ, কয়েক বছর ধরে এ এলাকায় পানি সংকট স্থায়ী রূপ নিয়েছে। তবে সেটি তীব্র হয়েছে দুই বছর ধরে। এখন ঘোলা পানির সঙ্গে পোকাও আসে।
পানির জন্য বাড়তি খরচ
একটু বিশুদ্ধ পানির জন্য বাড়তি খরচ করতে হচ্ছে জুরাইন ও মুরাদপুরের বাসিন্দাদের; সময়ও যাচ্ছে অনেক। এ দুই ব্যয় মেনে নিয়েই দৈনন্দিন অন্য কাজের মত বাসিন্দাদের লাইন ধরে দাঁড়াতে হচ্ছে স্থানীয় মসজিদের গভীর নলকূপে।
ওই এলাকায় দিনের বেলা গিয়ে দেখা যায়, মসজিদ ঘিরে পানির জন্য আনাগোনা করছেন বাসিন্দারা। পানির বোতল, জার বা কলসি হাতে অপেক্ষা করছিলেন লোকজন। কেউ পানি নিয়ে বাসায় ফিরছিলেন, তো কেউ আনতে যাচ্ছিলেন।
>> ঢাকা ওয়াসার আওতাধীন এলাকায় বর্তমানে দৈনিক পানি উৎপাদন ক্ষমতা ২৮০ কোটি লিটার। >> গরমকালে দৈনিক পানির চাহিদা ২৭০ থেকে ২৭৫ কোটি লিটার। >> পুরোনো পানির লাইন প্রতিস্থাপনে ২০১০ সাল থেকে কাজ করছে ঢাকা ওয়াসা। ঢাকা ওয়াটার সাপ্লাই নেটওয়ার্ক ইমপ্রুভমেন্ট প্রকল্পের আওতায় পুরো নগরীকে ১৫৬টি ডিএমএতে (ডিস্ট্রিক্ট মিটার্ড এরিয়া) ভাগ করা হয়েছে। >> এরমধ্যে ১১৪টি ডিএমএ এর কাজ শেষ হয়েছে। ডিএমএ পদ্ধতি হল- পানি সরবরাহের একটি নেটওয়ার্ক যাতে নির্দিষ্ট এলাকার পানি অন্য এলাকায় যাবে না। |
পূর্ব জুরাইনের কুসুমবাগ জামে মসজিদে প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে বেলা সাড়ে ১১টা এবং আসরের নামাজের পর থেকে রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত এলাকাবাসী পানি নিতে পারেন। এ জন্য মসজিদ কর্তৃপক্ষকে কিছু টাকা দিতে হয়।
এখানে এক বোতল বা এক জগ পানি ১ টাকা, ৫ লিটারের বোতল দুই টাকা, ১০ লিটারের বোতল বা কলসি তিন টাকা এবং জার ভরে পানি নিলে পাঁচ টাকা দিতে হয়।
মারকাযুস সুন্নাহ মাদ্রাসা ঢাকা-সংলগ্ন মসজিদ থেকে ১ লিটার এক টাকায়, ৫ লিটার দুই টাকায়, বড় গ্যালন বা মাঝারি কলসি ৩ টাকায়, বড় কলসি পাঁচ টাকায় এবং জার ভরলে ৬ টাকায় পানি নেওয়া যায়।
এমন নোটিস মসজিদের দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। এলাকাবাসী পানি নিলে দাম কেমন হবে, তা নির্ধারণ করে দেওয়া আছে জুরাইন ও মুরাদপুরের মসজিদে।
মসজিদগুলো পানি না দিলে এলাকার মানুষের খাবার পানি পাওয়ার কোনো উপায় থাকত না বলে মনে করেন স্থানীয় বাসিন্দা ওমর ফারুক।
তিনি বলেন, “ওয়াসার পানি দিয়ে গোসলও করা যায় না। এগুলো (মসজিদ) আছে বলে আমরা পানি খেতে পারছি। ঢাকা ওয়াসার পানির যে অবস্থা, যদি কেউ সাদা কাপড় ধোয়, সেটা নোংরা হয়ে যায়। এ পানি দিয়ে বাচ্চাদের গোসল করালে চুলকানি হয়। এ জন্য আমি বালতিতে পানি রেখে স্যাভলন-ডেটল মিশিয়ে দেই, যেন বাচ্চাদের চর্মরোগ কম হয়।”
জুরাইনে মসজিদ থেকে বাসা-বাড়িতে টাকার বিনিময়ে পানি পৌঁছে দেওয়ার মানুষও আছে। এমন একজন নাসিমা বেগম। দৈনিক ১১ গ্যালন পানি কয়েকটি বাসা-বাড়িতে পৌঁছে দেন তিনি।
তিনি বলেন, “আমাদের এলাকায় কোনো বাসাবাড়িতেই ওয়াসার লাইনের পানি খাওয়া যায় না। আমি পাঁচটা বাসায় কাজ করি। এসব বাসার জন্য পানি আনতে হয়। আরও তিনটা বাসার জন্য পানি নিই। এতে মাসে আমার ১৮০০ টাকা আয় হয়।”
সাধারণ মানুষের এই যে ভোগান্তি, সেই একই কথা শোনা গেল স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং ওয়াসার সংশ্লিষ্ট কর্তকর্তাদের মুখেও।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৫৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মীর হোসেন মীরু বলেন, “এই এলাকায় পানির সমস্যা দীর্ঘদিনের। দুর্গন্ধযুক্ত পানি আসে, যা খাওয়া যায় না।
“এ কারণে মসজিদ থেকে পানি নিয়ে যায় মানুষ। ওই পানি ভালো, গন্ধ নেই। বিষয়টা প্রায়ই মেয়র মহোদয়কে বলি, ওয়াসার ইঞ্জিনিয়ারদের সঙ্গেও আলাপ করি। ওয়াসা এখন নতুন পাইপ বসাচ্ছে।”
ঢাকা ওয়াসার উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে এম সহিদ উদ্দিন বলছেন, জুরাইন-মুরাদপুরের পানি সরবরাহ লাইন প্রায় ৫০ বছরের পুরোনো। লাইনগুলো মাটির অন্তত ২০ ফুট নিচে পড়ে গেছে। বিভিন্ন স্থানে পাইপ ছিদ্র হয়ে গেছে, যেখান দিয়ে নোংরা পানি ঢুকে পড়ছে। এ কারণে বাসা-বাড়ির পানির কলে দুর্গন্ধযুক্ত ও ময়লা পানি আসছে।
“পুরো লাইনটাই ছিদ্র হয়ে গেছে। কত জায়গায় ঠিক করব? ঠিক করতে গেলেও সমস্যা, সরু রাস্তায় ২০ ফুট নিচে গিয়ে কাজ করতে গেলে পাশের ভবন ভেঙে যাওয়ার শঙ্কা থাকে। এ পরিস্থিতি দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে।”
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, ঢাকা শহরে পানির লাইন প্রতিস্থাপন প্রকল্পের আওতায় জুরাইন-মুরাদপুরেও নতুন লাইন বসানোর কথা ছিল। লাইন বসাতে সড়ক খননের জন্য সিটি করপোরেশনের অনুমতি প্রয়োজন হয়। সে কারণেই পানির লাইন বসাতে দেরি।
“সম্প্রতি আমরা সড়ক খননের অনুমতি পেয়েছি। কয়েকটি জায়গায় লাইন বসানোর কাজও শুরু হয়েছে। নতুন লাইন বসলে পানিতে আর দুর্গন্ধ থাকবে না।”