একাত্তরে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের দুই হোতা আলবদর নেতা আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মুঈনুদ্দীনের বিচার শেষে মৃত্যুদণ্ডের রায় হলেও তারপর সাত বছরেও তাদের দেশে ফিরিয়ে এনে ফাঁসি কার্যকর দেখতে না পাওয়ায় আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারের সদস্যরা।
Published : 13 Dec 2020, 09:21 PM
পলাতক আশরাফুজ্জামান বর্তমানে আছেন যুক্তরাষ্ট্রে, আর মুঈনুদ্দীন যুক্তরাজ্যে।
জামায়াতে ইসলামী তখনকার সহযোগী সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের এই দুই কেন্দ্রীয় নেতা মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়জন শিক্ষক, ছয়জন সাংবাদিক ও তিনজন চিকিৎসকসহ ১৮ বুদ্ধিজীবীকে অপহরণের পর হত্যা করেন।
মানবতাবিরোধী অপরাধের এক মামলায় ২০১৩ সালের ৩ নভেম্বর এই দুই বদর নেতার মৃত্যুদণ্ডের রায় শোনায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
আশরাফুজ্জামান ও মুঈনুদ্দীন ১৯৭১ সালের ১১ থেকে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে কীভাবে আল বদর সদস্যদের নিয়ে বুদ্ধিজীবীদের অপহরণ ও হত্যার পর বধ্যভূমিতে লাশ গুম করেছিলেন, তা উঠে আসে রায়ে। আশরাফুজ্জামান খান ছিলেন সেই হত্যাকাণ্ডের ‘চিফ এক্সিকিউটর’। আর চৌধুরী মুঈনুদ্দীন ছিলেন সেই পরিকল্পনার ‘অপারেশন ইনচার্জ’।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আশরাফুজ্জামানের নাখালপাড়ার বাসা থেকে উদ্ধার করা তার ব্যক্তিগত দিনপঞ্জিতে এই হত্যা পরিকল্পনা ও একটি তালিকাও পাওয়া যায়।
এ দুই বদর নেতা ও তাদের সহযোগীদের হাতে নিহতদের মধ্যে রয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও নাট্যকার মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, ড. সিরাজুল হক খান, ড. আবুল খায়ের, ড. ফয়জুল মহিউদ্দিন, অধ্যাপক রাশিদুল হাসান, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা ও ড. সন্তোষ ভট্টাচার্য।
সাংবাদিক সিরাজ উদ্দিন হোসেন, সৈয়দ নাজমুল হক, এএনএম গোলাম মুস্তাফা, নাজিম উদ্দিন আহমেদ, সেলিনা পারভীন, শহীদুল্লাহ কায়সার এবং চিকিৎসক মো. মর্তুজা, মো. ফজলে রাব্বি ও আলিম চৌধুরীকেও হত্যার পর গুম করে তারা।
শহীদ বুদ্ধিজীবী জহির রায়হানের ছেলে অনল রায়হান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “চৌধুরী মুঈনুদ্দীনের শাস্তি বাস্তবায়ন না হলে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রক্রিয়াই তো সম্পন্ন হবে না। এই লোকটা যুক্তরাজ্যে বসে এখনও নানা কুকীর্তি চালিয়ে যাচ্ছে। জামায়াতের ফান্ড জোগানো, ইউরোপ-আমেরিকা জুড়ে জামায়াতকে সংগঠিত করা। সেখানে বাঙালি কমিউনিটির সঙ্গেও তারা মিশে গেছে। সেখানে তারা জামায়াত নিয়ে যায়, কোরান শেখাচ্ছে।
“অত্যন্ত দুঃখ পেয়েছি, জামাতের এই সুপার অ্যাকটিভ নেতা, যিনি ইউরোপ, আমেরিকাতে তৎপরতা চালাচ্ছেন। সেই জায়গাতে সরকার কেন এই লোকটাকে ছাড় দিচ্ছে? বাংলাদেশের হাই কমিশন কিছু করতে পারল না? এত টাকা থাকার পরও, এত আন্তর্জাতিক যোগাযোগ শক্ত হওয়ার পরও যেখানে সাকা চৌধুরী, নিজামীদের ফাঁসি কার্যকর হয়ে গেল; সেখানে চৌধুরী মুঈনুদ্দীনের কিসের এত ক্ষমতা?”
২০১৩ সালে ৩ নভেম্বর ফাঁসির রায় আসার পর চৌধুরী মুঈনুদ্দীন ২৪ নভেম্বর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “বিচারক ও তাদের চ্যালাচামুণ্ডারা নিজেরা উল্টো ঝুলে পড়লেও আমাকে ঝোলাতে পারবে না।”
পরে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে চৌধুরী মুঈনুদ্দীনের বিষয়ে ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড অ্যালার্ট জারি করে। তাকে ফিরিয়ে দিতে অনুরোধ জানানো হলেও তাতে সাড়া দেয়নি ব্রিটিশ সরকার।
কূটনৈতিক এই প্রক্রিয়া নিয়ে শহীদ পরিবারের অসন্তোষের কথা জানিয়ে অনল রায়হান বলেন, “এটার রাজনৈতিক সমাধান হচ্ছে না। আমার তো দীর্ঘসূত্রতা ছাড়া আর কিছু মনে হচ্ছে না। মুঈনুদ্দীন এমন কোনো ব্যক্তি না যে, ব্রিটিশ সরকার তাকে হস্তান্তর করবে না।”
চৌধুরী মুঈনুদ্দীনের ধৃষ্টতার বিষয়টি এ বছর জুলাই মাসে আবার আলোচনায় আসে। চলতি বছর জুলাই মাসে যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রীতি প্যাটেল তার মন্ত্রণালয়ের একটি প্রতিবেদন তুলে ধরে টুইটারে মুঈনুদ্দীনকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে উল্লেখ করেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে প্রীতির বিরুদ্ধে ৬০ হাজার পাউন্ড ক্ষতিপূরণ মামলা দায়ের করেন মুঈনুদ্দীন।
২০১৬ সালে ১৪ ডিসেম্বরে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, চৌধুরী মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানকে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে ‘সময়মত সুসংবাদ’ দেবেন।
এরপর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে নানা কূটনৈতিক উদ্যোগ নেওয়ার কথা শোনা গেলেও বাস্তবে তার প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ শহীদ পরিবারের।
শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরী ছেলে আসিফ মুনীর তন্ময় বলেন, “এখন তো মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার ক্ষমতায়। তাদের তো একাত্তরের দায়বদ্ধতা মনে করার কথা। যুদ্ধের পর শাহরিয়ার কবির, মুনতাসীর মামুনরা বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের হোতা কারা সেটা দেখিয়ে দিয়েছেন। নব্বইয়ের দশকে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যে গণআদালত গঠিত হল, সেখানেও তো মুঈনুদ্দীনের নামটি এসেছে, আশরাফের নাম এসেছে।
“ভিকটিম ফ্যামিলি হিসেবে আমরাও আসলে জানি না, কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে গত সাত বছরে। রায় হয়েছে ২০১৩ সালের নভেম্বরে। এই সাত বছরে সরকারের উদ্যোগটা কী ছিল কূটনৈতিক পর্যায়ের সেটা আমরা জানি না। সরকারের অন্য অনেক প্রায়োরিটি থাকতে পারে। এর মধ্যে নির্বাচন গেছে, দেশের উঠানামা অনেক গেছে। কিন্তু এটার বিষয়ে আসলে আমরা জানি না। সাত বছরের অগ্রগতি কী, জানা দরকার।”
সরকারি কর্মকাণ্ডে হতাশা ব্যক্ত করে আসিফ মুনীর বলেন, “আজকে তারা কোথায় আছে, কী করছে, সব তো সরকার জানে। তাদের ফিরিয়ে আনার বিষয়ে সরকারের পরিকল্পনাও তো তেমনই হওয়া উচিৎ ছিল। মানলাম, নব্বইতে করা যায়নি, কিন্তু আজকে ২০২০ সালে এসেও যদি সরকার একই কথা বলে; তাহলে সেটা দায়সারা ব্যাপার হল না?”
কেবল মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণার মধ্যে থেমে থাকলেই তা শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবার মেনে নেবে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
অনল রায়হানও বলেন, “বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের একটা সিগনিফিকেন্ট অংশ, এটা ছাড়া আপনি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পন্ন করতে পারেন না। হত্যাকাণ্ডের পেছনে যে ফিলোসফিক্যাল জায়গা ছিল…মাস্টার মাইন্ডরা জাতিকে কিভাবে পঙ্গু করে দিতে চেয়েছিল…সব কিছু আজ প্রমাণিত। ট্রাইব্যুনালের রায় যতদিন বাস্তবায়ন না হবে, ততদিন দেশ ও জাতি কালিমামুক্ত হচ্ছে না।”
তিনি জানান, মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের সংগঠন ‘প্রজন্ম ৭১’ কিছু দিন আগে ব্রিটিশ হাই কমিশনে গিয়ে চৌধুরী মঈনুদ্দীনকে ফেরাতে চিঠি দিয়েছেন।
সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের পক্ষ থেকেও যুদ্ধাপরাধীদের ফেরাতে চিঠি দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংগঠনের মহাসচিব হারুন হাবীব।
শহীদ বুদ্ধিজীবী আলতাফ মাহমুদের মেয়ে শাওন মাহমুদ বলেন, “আজকে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের সরকারই তো ক্ষমতায়। আমরা তাদের কাছেই গিয়ে কী বিচার চাইব? তাদেরই তো দায়বদ্ধতা।”
শহীদ বুদ্ধিজীবী শহীদুল্লা কায়সারের মেয়ে শমী কায়সার বলেন, “আমরা যখন স্বাধীনতার ৫০ বছর উদযাপন করতে যাচ্ছি তখন একাত্তরের সেই অপশক্তি যারা মুক্তিযুদ্ধ ও ধর্মকে মুখোমুখি দাঁড় করাতে চেয়েছিল, তারা আবার হুমকি দিচ্ছে। সেই অপশক্তিকে আমরা সমূলে উৎপাটিত করতে পারিনি। আমাদের সে চ্যালেঞ্জটা কিন্তু রয়ে গেছে।
“সেই দিক থেকে আমি বলব, ন্যায্যতা ও সত্যকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার জন্য শহীদ বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করতেই হবে।”
মৃত যুদ্ধপরাধীদের মরণোত্তর বিচারের দাবি জানিয়ে আসছেন শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. এ এফ এম আবদুল আলীম চৌধুরীর স্ত্রী শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী।
আলীম চৌধুরীর হত্যাকারী মাওলানা আব্দুল মান্নান পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে আবদুস সাত্তার ও এরশাদ সরকারের মন্ত্রিসভায় শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী, ধর্মমন্ত্রী ও ত্রাণ-পুনর্বাসন মন্ত্রীর দায়িত্ব পান। তিনি ২০০৬ সালে মারা যান।
শ্যামলী নাসরিন বলেন, “আব্দুল মান্নানের মতো চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী যাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যায়নি, তাদের মরণোত্তর বিচারের দাবি আমি আদালতে গিয়ে বারবার বলেছি। কিন্তু এ দেশে মরণোত্তর পুরস্কার দেওয়া হলেও মরণোত্তর বিচার হয় না।
“আমি কোর্টে গিয়ে কতবার মান্নানের বিচার চেয়েছি। নিয়ম নাই তো আইনসভায় আইন পাস করতে হবে। বিচার পাওয়ার অধিকার আমার আছে। আমার মানুষ তো আর ফিরে আসবে না। কিন্তু ন্যায়বিচার পেলে তো আমার মনে স্বস্তি আসবে।”