১৮ বুদ্ধিজীবী হত্যায় জড়িত আশরাফ- মুঈনুদ্দীন

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৮ জন বুদ্ধিজীবী হত্যার অভিযোগের প্রতিটি ঘটনায় তখনকার আলবদর নেতা আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মুঈনুদ্দীনের সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হয়েছে।

সুলাইমান নিলয়কাজী শাহরীন হক ও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 Nov 2013, 06:35 AM
Updated : 3 Nov 2013, 06:35 AM

চৌধুরী মাঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খান

প্রসিকিউশনের আনা ১১টি অভিযোগের সবগুলোই প্রমাণিত হওয়ায় জামায়াতে ইসলামীর তখনকার সহযোগী সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের এ দুই কেন্দ্রীয় নেতাকে প্রাণদণ্ড দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।    

বিচারপতি ওবায়দুল হাসান নেতৃত্বাধীন ট্রাইব্যুনাল-২ রোববার এ মামলার রায় ঘোষণা করে।

রায়ে বলা হয়, “আমরা ঐক্যমতের ভিত্তিতে এই মত দিচ্ছি, আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মুঈনুদ্দীনের সর্বোচ্চ শাস্তির আদেশ না দিলে ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে না।”

স্বাধীনতার ঠিক আগে ১৯৭১ সালের ১১ থেকে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের ‘দায়িত্বপ্রাপ্ত’ আলবদর বাহিনীর ‘চিফ এক্সিকিউটর’ ছিলেন আশরাফুজ্জামান খান। আর চৌধুরী মুঈনুদ্দীন ছিলেন সেই পরিকল্পনার ‘অপারেশন ইনচার্জ’।

রায়ে বলা হয়, “আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মুঈনুদ্দীন যে মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৮ জন বুদ্ধিজীবী হত্যায় জড়িত ছিলেন, তা প্রসিকিউশনের তথ্য-প্রমাণে বেরিয়ে এসেছে। তারা কখনো নিজেরা হত্যায় অংশ নিয়েছে। কখনো জোরালো সমর্থন দিয়েছে, উৎসাহ যুগিয়েছে।”

সে সময় আলবদর বাহিনীর ওপর ইসলামী ছাত্র সংঘের এ দুই নেতার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিল বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়।

পলাতক আশরাফুজ্জামান বর্তমানে আছেন যুক্তরাষ্ট্রে এবং চৌধুর মুঈনুদ্দীন যুক্তরাজ্যে রয়েছেন।

বিচারক বলেন, যেহেতু দণ্ডিত দুই ব্যক্তি পলাতক। তাই যখন তারা গ্রেপ্তার হবে বা ট্রাইব্যুনালে আত্মসমর্পণ করবে- তখন তাদের রায় কার্যকর হবে।

“আশরাফুজ্জামান খান ওরফে নায়েব আলী খান ও চৌধুরী মুঈনুদ্দীনকে সকল অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হলো। আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন ১৯৭৩ অনুসারে তাদের আমৃত্যু ফাঁসিতে ঝুলতে হবে।” 

একাত্তরে ১৮ জন বুদ্ধিজীবীকে অপহরণ ও হত্যার ১১টি ঘটনায় গত ২৪ জুন অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে এ দুই পলাতক যুদ্ধাপরাধীর বিচার শুরু হয়।

তাদের বিরুদ্ধে আনা প্রতিটি অভিযোগেই আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের ৩ (২) (এ) (জি) (এইচ) ধারা অনুযায়ী বুদ্ধিজীবী নির্মূলের পরিকল্পনা, অপহরণ ও হত্যার অভিযোগ আনা হয়, যা মৃত্যুদণ্ডযোগ্য অপরাধ।

অভিযোগ ১:  ১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর ভোর ৩টা থেকে সাড়ে ৩টার মধ্যে আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মুঈনুদ্দীনের নির্দেশে ৭-৮ সশস্ত্র আলবদর সদস্য সাংবাদিক সিরাজ উদ্দিন হোসেনকে চামেলীবাগে তার নিজ বাড়ি থেকে অপহরণ করে ইপিআরটিসির একটি মিনিবাসে করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়। পরবর্তীতে তার মৃতদেহ পাওয়া যায়নি।

অভিযোগ ২: ১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর ভোর ৪টা-সাড়ে ৪টার দিকে এই দুইজনের উপস্থিতিতে আলবদর বাহিনীর ৮-১০ জন সশস্ত্র সদস্য পিপিআইর প্রধান প্রতিবেদক ও কলম্বিয়া ব্রডকাস্টিং সার্ভিসের স্টাফ রিপোর্টার সৈয়দ নাজমুল হকের পুরানা পল্টনের বাসায় জোর করে প্রবেশ করে বন্দুকের মুখে তাকে ইপিআরটিসির একটি মিনিবাসে করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে। তার মৃতদেহও পরবর্তীতে পাওয়া যায়নি।

অভিযোগ ৩: ১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর ভোর ৬টা থেকে সাড়ে ৬টার মধ্যে আশরাফ-মুঈনুদ্দীনের নির্দেশে পাঁচ-ছয়জন সশস্ত্র আলবদর সদস্য দৈনিক পূর্বদেশের প্রধান প্রতিবেদক এএনএম গোলাম মুস্তাফাকে তার গোপীবাগের বাসা থেকে দৈনিক পূর্বদেশের কার্যাশলয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে ইপিআরটিসির একটি মিনিবাসে করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায় এবং হত্যা করে। তার মৃতদেহও পরবর্তীতে পাওয়া যায়নি।

অভিযোগ ৪: ১২ ডিসেম্বর দুপুরে এই দুইজনের নির্দেশে সশস্ত্র আলবদর সদস্যরা পিপিআইর মহাব্যবস্থাপক  ও বিবিসির প্রতিবেদক নাজিম উদ্দিন আহমেদের কলতাবাজারের বাসায় জোর করে প্রবেশ করে এবং তাকে আলবদরের কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে ইপিআরটিসির একটি মিনিবাসে করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে হত্যা করে। তার মৃতদেহও পাওয়া যায়নি।

শিলালিপি সম্পাদক সেলিনা পারভীন

অভিযোগ ৫: ১৩ ডিসেম্বর দুপুরে এ দুই আসামির উপস্থিতিতে একদল সশস্ত্র আলবদর সদস্য দৈনিক শিলালিপির সম্পাদক সেলিনা পারভীনকে তার নিউ সার্কুলার রোডের বাসা থেকে বন্দুকের মুখে অপহরণ করে আলবদরের সদর দপ্তরে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে ইপিআরটিসির একটি মিনিবাসে করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে হত্যা করে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ১৭ ডিসেম্বর রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে তার মৃতদেহ পাওয়া যায়।

অভিযোগ ৬: ১৩ ডিসেম্বর সকাল ৮টা থেকে পৌনে ১০টার মধ্যে এই দুই আলবদর নেতার উপস্থিতিতে পাঁচ-ছয়জন সশস্ত্র সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, ড. সিরাজুল হক খান, ড. মো. মর্তুজা, ড. আবুল খায়ের, ড. ফয়জুল মহিউদ্দিন, অধ্যাপক রাশিদুল হাসান, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা ও ড. সন্তোষ ভট্টাচার্যের বাসায় ঢুকে তাদের বন্দুকের মুখে একটি মিনিবাসে তুলে মিরপুরের বধ্যভূমি এলাকায় নিয়ে যায় এবং হত্যা করে।

১৬ ডিসেম্বরের পরে মিরপুর বধ্যভূমি থেকে অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, ড. মো. মর্তুজা, ড. আবুল খায়ের, অধ্যাপক রাশিদুল হাসান, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা ও ড. সন্তোষের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। বাকি দুজনের লাশ পাওয়া যায়নি।

অভিযুক্ত আশরাফুজ্জামানের নাখালপাড়ার বাসা থেকে উদ্ধার করা তার ব্যক্তিগত দিনপঞ্জিতে ‘বুদ্ধিজীবী হত্যা’র লক্ষ্য হিসেবে অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমেদের নাম পাওয়া যায়।

অভিযোগ ৭: ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর দুপুর ১২-১টার দিকে আশরাফ-মুঈনুদ্দীনের উপস্থিতিতে ৭/৮ জন সশস্ত্র আলবদর সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকায় বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর বাসায় জোর করে ঢুকে পড়ে। এ সময় অধ্যাপক মোফাজ্জলের ভাই তৎকালীন বাংলা বিভাগের ছাত্র চৌধুরী মাঈনুদ্দীনের মুখ ঢেকে রাখা কাপড় টেনে খুলে ফেললে তার পরিচয় প্রকাশ পেয়ে যায়। এরপর আলবদর সদস্যরা অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দারকে ইপিআরটিসির একটি মিনিবাসে করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে হত্যা করে। শহীদ এ বুদ্ধিজীবীর মৃতদেহ পরে আর পাওয়া যায়নি।

বাংলা বিভাগের ছাত্র আশরাফুজ্জামানের দিনপঞ্জিতেও অধ্যাপক মোফাজ্জলের নাম ছিল।

অভিযোগ ৮: ১৪ ডিসেম্বর দুপুর ১টা-দেড়টার দিকে এই দুই ব্যক্তির নির্দেশে তিন-চারজন সশস্ত্র আলবদর সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও নাট্যকার মুনীর চৌধুরীর সেন্ট্রাল রোডের বাসায় ঢুকে বন্দুকের মুখে তাকে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে হত্যা করে। শহীদ এ বুদ্ধিজীবীর মৃতদেহ পরে আর পাওয়া যায়নি।

অভিযোগ ৯: ১৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৬টায় অভিযুক্ত দুই ব্যক্তির উপস্থিতিতে ৫/৬ জন সশস্ত্র আলবদর সদস্য দৈনিক সংবাদের যুগ্ম সম্পাদক শহীদুল্লাহ কায়সারকে তার কায়েতটুলীর বাসা থেকে বুন্দকের মুখে অপহরণ করে এবং ইপিআরটিসির মিনিবাসে করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে হত্যা করে। শহীদুল্লাহ কায়সারের মৃতদেহ আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।

 

অভিযোগ ১০: ১৫ ডিসেম্বর দুপুর ২টা-৩টার দিকে এ দুই ব্যক্তির উপস্থিতিতে আলবদর সদস্যরা চিকিৎসক মো. ফজলে রাব্বিকে তার সিদ্ধেশ্বরীর বাসা থেকে বন্দুকের মুখে মোহাম্মদপুরে শারীরিক শিক্ষা কলেজে আলবদরের সদর দপ্তরে নিয়ে যায়। সেখান থেকে রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে নিয়ে তাকে হত্যা করা হয়।

স্বাধীনতার পরে ১৮ ডিসেম্বর শহীদ এ চিকিৎসকের মৃতদেহ ওই বধ্যভূমি থেকে উদ্ধার করা হয়।

অভিযোগ ১১: ১৫ ডিসেম্বর বিকাল সাড়ে ৩টা-৪টার দিকে সশস্ত্র আলবদর সদস্যরা দুই আসামির নির্দেশে চিকিৎসক আলিম চৌধুরীর পুরানা পল্টনের বাড়িতে ঢুকে পড়ে। ওই বাড়ির নিচতলায় আলবদরের সংগঠক মাওলানা মান্নান থাকতেন। এরপরে তিনজন আলবদর সদস্য আলিম চৌধুরীকে বন্দুকের মুখে অপহরণ করে  ইপিআরটিসির মিনিবাসে করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। স্বাধীনতার পরে রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে চোখ বাঁধা অবস্থায় পাওয়া যায় আলিমের মৃতদেহ।

পরে তার স্ত্রী শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী জানতে পারেন, আলবদরের নেতৃত্বে ছিলেন আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মুঈনুদ্দীন।

 

আসামির অনুপস্থিতিতে ট্রাইব্যুনালে বিচার শেষে রয়ের পর্যায়ে আসা দ্বিতীয় মামলা এটি। এর আগে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক রুকন আবুল কালাম আযাদের অনুপস্থিতিতেই বিচার হয় এবং যুদ্ধাপরাধের দায়ে তার ফাঁসির আদেশ দেন বিচারক।

আশরাফুজ্জামানের গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরের বেজড়া ভাটরা (চিলেরপাড়) গ্রামে। আর চৌধুরী মুঈনুদ্দীনের বাড়ি ফেনীর দাগনভুঞার চানপুরে।

আইন অনুসারে দণ্ডের বিষয়ে ওয়ারেন্ট জারির পাশাপাশি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে এবং আদেশ বাস্তবায়নের জন্য রায়ের একটি করে অনুলিপি পুলিশ মহাপরিদর্শক ও ঢাকার জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে দিতে বলা হয়েছে। এছাড়া রায়ের সত্যায়িত একটি অনুলিপি তাৎক্ষণিকভাবে প্রসিকিউশনকে দিতে বলেছে আদালত।

বিচারক বলেন, “অপরাধীরা তাদের অপরাধের দায় দেবে- এটা নিশ্চিত করাই হচ্ছে ন্যায় বিচার।”