ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ তাদের সিনিয়র নায়েবে আমির সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করিম, হেফাজত ইসলামের আমির জুনায়েদ বাবুনগরী ও যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হকের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে।
Published : 08 Dec 2020, 01:59 PM
জাতির জনকের ভাস্কর্যবিরোধী বক্তব্য দেওয়ায় রাষ্ট্রদ্রোহের মামলার পরদিন মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলনে এসে সংগঠনটির আমির সৈয়দ মো. রেজাউল করিম তার লিখিত বক্তব্যে সরকারের ভূমিকারও সমালোচনা করেন।
পুরানা পল্টনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, “মূর্তি বা ভাস্কর্য নিয়ে বিরাজমান পরিস্থিতিকে আমরা দেশ বিরোধী অপশক্তি চক্রান্ত আকারে দেখছি। আমরা মনে করি, ওরা বাংলাদেশের মানুষের ঐক্য বিনষ্ট করে ভিনদেশী এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে চায়। সামাজিক ও ধর্মীয় অস্থিতিশীলতা তৈরি করতে চায়।”
জাতির জনকের ভাস্কর্যের বিরোধিতা করে বক্তব্য দেওয়ায় হেফাজতে ইসলামের নেতা জুনাইদ বাবুনগরী, মামুনুল হক এবং সৈয়দ ফয়জুল করিমের বিরুদ্ধে সোমবার রাষ্ট্রদ্রোহের দুই মামলা হয়েছে।
এর মধ্যে একটি মামলা করেছেন মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুল। দণ্ডবিধির ১২০ (খ) (১)/১২৪ (ক)/ ৫০৫ (ক) ধারায় করা এ মামলায় হেফাজতে ইসলামের আমির জুনাইদ বাবুনগরী, খেলাফত মজলিসের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মামুনুল হক এবং ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নায়েবে আমির সৈয়দ ফয়জুল করিমকে আসামি করা হয়েছে।
দ্বিতীয় মামলাটি করেছেন বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশনের নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট মশিউর মালেক। দণ্ডবিধির ১২০ (খ)/১৫৩/১২৪ (ক)/ ধারার এ মামলায় আসামি করা হয়েছে কেবল মামুনুল হককে, যিনি হেফাজতে ইসলামের নতুন কমিটিতে যুগ্ম মহাসচিবের দায়িত্বে আছেন।
ভাস্কর্য বিষয়ে সরকারের অবস্থানে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ হতাশ জানিয়ে রেজাউল করিম বলেন, “সাধারণ মানুষের নিয়মতান্ত্রিক একটি দাবিকে কেন্দ্র করে যখন কুচক্রী মহল দেশে ওলামাদের বিরুদ্ধে উগ্রতা ছড়াচ্ছে তখন তারা (সরকার) তা দমন না করে আরও উৎসাহ দিচ্ছে।
“ইসলামী আন্দোলন মনে করে, তাদের এই ভূমিকা বরং বঙ্গবন্ধুকে ছোট করছে। তার সম্মানকে মানুষের চেতনার সাথে সাংঘর্ষিক অবস্থানে ঠেলে দিয়েছে।”
এর কোনো দরকার ছিল না জানিয়ে তিনি বলেন, “জনগণ মনে করছে, সরকার তাদের ব্যর্থতা দুর্নীতি ও অনিয়ম আড়াল করতেই এ অপকৌশলের আশ্রয় নিয়েছে।”
তিনজনের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে রেজাউল বলেন, “দেশের ওলামা সমাজকে এবং সম্মানিত ধর্মীয় ব্যক্তিদেরকে অশালীন ভাষায় গালিগালাজ করে কটূক্তি করে, ব্যঙ্গ কার্টুন প্রকাশ করে, অপমান অপদস্ত করে, প্রাণনাশের হুমকি দেয়, মারামারি ও মল্লযুদ্ধের আহ্বান জানায়, তাদের বিচারের আওতায় এনে শাস্তি দিতে হবে।
“আশা করছি আমাদের দাবি মেনে নিয়ে দেশকে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির হাত থেকে রক্ষা করার উদ্যোগ গ্রহণ করবে। সরকার যদি ষড়যন্ত্রকারীদের নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ নিজেদের নিরাপত্তা, মর্যাদা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও অধিকার রক্ষার প্রয়োজনেই দেশের জনগণকে সঙ্গে নিয়ে বৃহত্তর কর্মসূচি দিতে বাধ্য হবে।”
হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক মুজিববর্ষে ঢাকার ধোলাইরপাড়ে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনের প্রকাশ্য বিরোধিতা করার পর থেকেই বিতর্কের সূত্রপাত। তারপর হেফাজতের অন্য নেতারাও সরব হন।
হেফাজত নেতাদের এই অবস্থানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতা যেমন কড়া ভাষায় কথা বলছেন। অন্যদিকে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন ভাস্কর্যবিরোধীদের রুখে দাঁড়ানোর এবং বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভেঙে ফেলার হুমকি দেওয়ায় হেফাজত আমির জুনাইদ বাবুনগরী ও যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হকের গ্রেপ্তারের দাবি তুলেছে।
রেজাউল করিম বলেন, “স্বপ্নের পদ্মা সেতু প্রকল্পের ঢাকা প্রবেশদ্বারে বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করে স্থাপিত হতে যাওয়া ভাস্কর্য নিয়ে একটি বিতর্ক তৈরি হয়েছে। পাঁচ থেকে সাতটি মসজিদ-মাদ্রাসার মিলন মোহনায়, দুটি মসজিদের অবকাঠামো ভেঙে এই পয়েন্টে ভাস্কর্য স্থাপনের ফলে স্থানীয় ইমাম, মুসল্লি ও তৌহিদী জনতা সেখানে ভাস্কর্যের বদলে বিকল্প কোনো উত্তম পন্থায় বঙ্গবন্ধুকে স্মরণীয় করে রাখার দাবি জানিয়েছিল।
“বাংলাদেশ সরকারের বিদ্যমান আইন-কানুন মেনে তৌহিদী জনতা সমাবেশ করেছে এবং শালীন ভাষাতেই যৌক্তিকভাবে ভাস্কর্য স্থাপনের বিরোধিতা হয়েছে। বিষয়টি একেবারে স্বাভাবিক একটি নাগরিক প্রতিক্রিয়া। কিন্তু বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করলাম একটি সুবিধাভোগী মহল বিষয়টিকে কেন্দ্র করে দেশে চরম উস্কানি ও উত্তেজনা তৈরি করছে।
তিনি বলেন, “এহেন পরিস্থিতিতে আমরা পরিষ্কার করে জানাচ্ছি যে, উলামায়ে কেরামের দাবির মধ্যে মরহুম বঙ্গবন্ধুর প্রতি বিদ্বেষ ছিল না, অসম্মানও ছিল না। বরং বিষয়টি ছিল দেশের প্রায় ৯০ শতাংশ জনগণের বোধ-বিশ্বাসের সঙ্গে সাংঘর্ষিক মূর্তি স্থাপন না করে বিকল্প পন্থায় তাকে (বঙ্গবন্ধু) স্মরণ করার দাবি।
“আলেম সমাজ ও সাধারণ মুসলিম ধর্মপ্রাণ জনগণ এক্ষেত্রে সরকারের কাছে নিজেদের প্রাণের আকুতি তুলে ধরতেই পারে। মানা না মানা কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব।”
রেজাউল করিম বলেন, “ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা ও তার পরিবার ১৯৭১ সালে একনিষ্ঠভাবে মুক্তিসংগ্রামের সহযোগী ছিলেন। তার দরবার ছিল এলাকার সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষের আশ্রয়স্থল। এটি এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে সর্বজন বিদিত। যারা এ বিষয়ে বিতর্ক তৈরি করছে, তারা মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে তামাশায় পরিণত করছে এবং আমরা এর তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানাই।”
তিনি আরও বলেন, “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে যারা তার বেশি বিরোধিতা করেছে, নানা হুমকি দিয়েছে, বঙ্গবন্ধু হত্যার ক্ষেত্র তৈরি করেছে, মৃত্যুর পরে আনন্দ উল্লাস করেছে, তারাই আজ বঙ্গবন্ধুর সম্মান রক্ষার নামে অপসংস্কৃতি প্রসারে সবচেয়ে এগিয়ে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, এরা বঙ্গবন্ধুর কন্যা ও মূল আওয়ামীলীগের চেয়েও বেশি মুজিবভক্ত হয়ে গেছে। এখানে মনে হওয়া যৌক্তিক যে, বঙ্গবন্ধুর সম্মান তাদের উদ্দেশ্য না, বরং তাওহীদ বিরোধী মূর্তিবাদী আদর্শ বিস্তারই তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য। যা এদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর চেতনাবিরোধী।”
ভাস্কর্য নিয়ে চরম উস্কানির মুখেও দেশের শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার স্বার্থে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ সীমাহীন ধৈর্য্যর পরিচয় দিয়ে এসেছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “আমরা বিষয়টি রাজনৈতিক ইস্যু মনে করিনি। যে কারণে ধৈর্য্যর সঙ্গে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেছি মাত্র। আমাদের দলীয় ব্যানারে বা কোনো সহযোগী সংগঠনের ব্যানারে কোনো কর্মসূচি দেইনি। উগ্রবাদী শক্তি ও তাদের উশৃংখল সহযোগীরা আমাদের নীরবতাকে দুর্বলতা ভেবেছে।”
সংবাদ সম্মেলনে মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করিমও উপস্থিত ছিলেন।
এক প্রশ্নে তিনি বলেন, ভাস্কর্য ভাংচুর তিনি সমর্থন করেন না। কুষ্টিয়ায় যারা এক কাজ করেছে তাদের শাস্তি দাবি করেন।
“আমাদের দাবি বঙ্গবন্ধুকে অন্য কোনোভাবে সম্মানিত করা যায়। আমি আমার বাবাকেও স্মরনীয় করার জন্য ভাস্কর্য তৈরির বিরোধী।”