একাত্তরের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিক অভিনেতা, নির্দেশক আলী যাকেরের প্রতি রাষ্ট্রীয় সম্মান জানানো হয়েছে ঢাকার মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে, অশ্রুচোখে বন্ধু-স্বজন-সহকর্মীরা তাকে জানিয়েছেন শেষ বিদায়।
Published : 27 Nov 2020, 11:55 AM
প্রয়াত এই অভিনেতার মরদেহ শুক্রবার বেলা ১১টার পর শেরেবাংলা নগরে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি ছিলেন এ প্রতিষ্ঠানের অন্যতম ট্রাস্টি।
জাদুঘর প্রাঙ্গণে আলী যাকেরের কফিন জাতীয় পতাকায় মুড়ে দেন জাদুঘরের ট্রাস্টিরা। সেখানে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন স্ত্রী সারা যাকের, ছেলে ইরেশ যাকের এবং আলী যাকেরের অভিনয় জীবনের বন্ধু সাবেক সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। আলী যাকেরের মেয়ে শ্রিয়া সর্বজয়া এসময় কান্নায় ভেঙে পড়েন।
প্রথমে কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয় ঢাকা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে। পরে একাত্তরের শব্দসৈনিক এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে রাষ্ট্রীয় সম্মান জানিয়ে দেওয়া হয় গার্ড অব অনার।
এরপর একে একে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টিরা, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট, ছায়ানট, থিয়েটার, বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের পক্ষ থেকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয় এ অভিনেতার প্রতি।
গত চার বছর ধরে ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করে আসা এই অভিনয় শিল্পীর শরীরের দুদিন আগে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়েছিল।
গত শতকের সত্তর থেকে নব্বইয়ের দশকে মঞ্চ আর টেলিভিশনে দাপুটে অভিনয়ের জন্য দর্শক হৃদয়ে স্থায়ী আসন নিয়ে আছেন একুশে পদকপ্রাপ্ত এই অভিনেতা।
তার স্ত্রী অভিনেত্রী সারা যাকের বলেন, “অভিনয় বা কর্মজীবনের বাইরে ভীষণ এক সংসারী মানুষ ছিলেন আলী যাকের। তিনি নাটকের মত করেই সংসারটাকে ভালোবাসতেন। দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়াবেন, বাড়ি বানাবেন, এমন সব স্বপ্ন তার ছিল না। তিনি সবসময় এক মধ্যবিত্ত, রোমান্টিক জীবনযাপন করতে চাইতেন।”
আশির দশকের সাড়া জাগানো মঞ্চ নাটক ‘গ্যালিলিও’ ২০১৮ সালে আবার মঞ্চে ফিরে আসে নাগরিক নাট্যদলের মাধ্যমে। বের্টল্ট ব্রেখট রচিত নাটকটি নতুন করে মঞ্চ আনতে নির্দেশনায় ছিলেন পান্থ শাহরিয়ার।
ক্যান্সারে আক্রান্ত অভিনেতা আলী যাকের সেই নাটকের মাধ্যমে আবার মঞ্চে ফিরেছিলেন নাম ভূমিকায়। তাই মঞ্চে ‘গ্যালিলিও’ হয়ে থাকল এ অভিনেতার শেষ নাটক।
সেই প্রসঙ্গ ধরে সারা যাকের বলেন, “আলী যাকের বলতেন, ‘গ্যালিলিও’ নাটকটি হবে তার সর্বশেষ সেরা কাজ। তিনি তা করে যেতে পেরেছেন। আমি ধন্যবাদ জানাচ্ছি তাদের, যারা দীর্ঘযাত্রায় আমাদের সঙ্গে ছিলেন।”
অভিনেতা ও নির্দেশক মামুনুর রশীদ, রামেন্দু মজুমদার, ফেরদৌসী মজুমদার, নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, তারিক আনাম খানসহ আরও অনেকে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে এসেছিলেন শ্রদ্ধা জানাতে, যারা ছিলেন আলী যাকেরের সহযোদ্ধা, সহকর্মী।
মামুনুর রশীদ বলেন, “মঞ্চে বিরাট প্রভাব সৃষ্টি করে গেছেন অভিনেতা আলী যাকের। তার অভিনীত ‘দেওয়ান গাজীর কিসসা’ ও বিশেষ করে ‘নূরলদীন’ তো এক কথায় অবিস্মরণীয়।
“এক বিশাল মহীরুহ ছিলেন আলী যাকের। শুধু বাংলাদেশের নাটক বলব না, বাংলা নাটকে তার যে প্রভাব, তার যে অবদান, তা সবসময় আমাদের অনুপ্রেরণা দেবে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া শেষ করে করাচিতে একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কর্মজীবন শুরু করেন আলী যাকের। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে তিনি এশিয়াটিকের দায়িত্ব নেন, মৃত্যুর সময় তিনি কোম্পানির গ্রুপ চেয়ারম্যান ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আলী যাকের প্রথমে ভারতে গিয়ে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেন। চলচ্চিত্র পরিচালক ও সাংবাদিক আলমগীর কবির তাকে উদ্বুদ্ধ করেন প্রচারযুদ্ধে অংশ নিতে। আলী যাকের যুক্ত হন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে।
“বিশাল বড় হৃদয়ের এই মানুষটি নীরবে, নিভৃতে কাজ করতে পছন্দ করতেন। তিনি এতবড় জনপ্রিয় এক ব্যক্তিত্ব ছিলেন, যে খুব সহজেই তিনি মানুষকে তার সান্নিধ্যে নিয়ে আসতে পারতেন। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রতিষ্ঠায় তিনি যে অবদান রেখে গেছেন, তা অতুলনীয়। বহুমাত্রিক এ মানুষটির প্রয়াণে আমাদের জাদুঘরের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল।”
অভিনেত্রী ফেরদৌসী মজুমদার বলেন, “বহু নাটকে আমার সহ-অভিনেতা ছিলেন আলী যাকের। সদালাপী, মিষ্টভাষী ছিলেন। নাটক অন্তঃপ্রাণ মানুষটি দেশকেও ভীষণ ভালোবাসতেন।
“আমি সাধারণত কোথাও খুব একটা যাই না। কিন্তু আজ আমার এত কাছের এক মানুষকে হারালাম, আমি না এসে আর পারলাম না।”
রামেন্দু মজুমদার বলেন, “এক পরিপূর্ণ জীবন যাপন করে গেছেন আলী যাকের। তিনি নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়কে যেমন শীর্ষ অবস্থানে নিয়ে গেছেন, তেমনিভাবে তার কর্মদক্ষতায় তার প্রতিষ্ঠানকে (এশিয়াটিক থ্রি সিক্সটি) নিয়ে গেছেন সর্বোচ্চ শিখরে।
“মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তার ছিল নিখাদ ভালোবাসা। সেই ভালোবাসার টানেই তিনি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রতিষ্ঠার কাজে ব্রতী হয়েছিলেন। তার কাজই তার সাক্ষ্য দেবে।”
অভিনেতা তারিক আনাম বলেন, “বাংলাদেশ যে চার মূলনীতি নিয়ে প্রতিষ্ঠা হয়েছিল, ধর্মনিরপেক্ষতা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র- এ চার নীতিকে তিনি মনেপ্রাণে ধারণ করতেন। দেশকে তিনি বুকে লালন করতেন।”
‘অচলায়তন’, ‘বাকী ইতিহাস’, ‘সৎ মানুষের খোঁজে’, ‘তৈল সংকট’, ‘এই নিষিদ্ধ পল্লীতে’, ‘কোপেনিকের ক্যাপ্টেন’সহ বেশ কয়েকটি মঞ্চ নাটকের নির্দেশনা দিয়েছেন আলী যাকের। বেতারে অর্ধশতাধিক শ্রুতি নাটকেও কাজ করেছেন।
নাটকে অবদানের জন্য ১৯৯৯ সালে সরকার তাকে একুশে পদকে ভূষিত করে। এছাড়া বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার, বঙ্গবন্ধু পুরস্কার, মুনীর চৌধুরী পদক, নরেন বিশ্বাস পদকসহ বিভিন্ন সম্মাননা পেয়েছেন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের শ্রদ্ধা নিবেদন পর্ব শেষে আলী যাকেরের কফিন নিয়ে যাওয়া হয় বনানীতে তার কর্মস্থল এশিয়াটিক থ্রি সিক্সটি ডিগ্রির কার্যালয়ে। সেখানে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব মো. ফাহিমুল ইসলাম।
এশিয়াটিক থেকে আলী যাকেরের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় বনানী কবরস্থানে। বিকাল পৌনে ৫টায় জানাজা শেষে সেখানেই তাকে দাফন করা হয় বলে এশিয়াটিক থ্রি সিক্সটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।