সব আসন তো পূর্ণই, তারপরও বাসের ভেতরে দাঁড়ানো যাত্রী, চালক-হেলপারসহ যাত্রীদেরও অনেকের মুখে নেই মাস্ক, নেই হ্যান্ড স্যানিটাইজার। রাজধানীর অধিকাংশ গণপরিবহনের চিত্র এখন এমনই।
Published : 29 Aug 2020, 12:19 PM
এখন বাসের সব আসনে যাত্রী নিতে চান মালিকরা
অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ে গণপরিবহনের নিবন্ধন-পারমিট বাতিলের নির্দেশ
অথচ করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে তিন মাস আগে এমন বেশকিছু স্বাস্থ্যবিধি মানার শর্তে গণপরিবহন চালানোর অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। বিনিময়ে যাত্রীদের গুণতে হচ্ছে ৬০ শতাংশ বেশি ভাড়া।
শুরুতে কিছুটা সচেতনতা দেখা গেলেও দিন গড়ানোর সাথে সাথে রাস্তা-ঘাট, হাট-বাজারের মতো গণপিরবহনেও এখন বলতে গেলে স্বাস্থ্যবিধির কোনো বালাই নেই, যা ক্ষুব্ধ করছে যাত্রীসাধারণকে।
ত্যক্ত-বিরক্ত যাত্রীদের কেউ আগের ভাড়ায় ফিরে যাওয়ার দাবি তুলছেন। আবার কেউ বলছেন, মহামারী নিয়ন্ত্রণে না আসা পর্যন্ত নজরদারি বাড়িয়ে বর্তমান নিয়মেই গণপরিবহন চালানোর কথা।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে ২৫ মার্চ থেকে ৩১ মে পর্যন্ত গণপরিবহন চলাচল বন্ধ ছিল। পরে অর্ধেক আসন খালি রাখাসহ কয়েকটি শর্তে ৬০ শতাংশ ভাড়া বাড়িয়ে ১ জুন গণপরিবহন চালানোর অনুমতি দেয় সরকার।
তবে স্বাস্থ্যবিধি মানায় উদাসীনতা দেখা দেওয়ায় যাত্রী অধিকার সংগঠন ও মালিক-শ্রমিকদের পক্ষ থেকেও আগের ভাড়ায় ফিরে যাওয়ার দাবি উঠতে শুরু করেছে।
শিগগিরই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসতে পারে জানিয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও বলেছেন, মাস্ক বাধ্যতামূলক ও দাঁড়িয়ে যাত্রী না নেওয়ার শর্তে গণপরিবহনে আগের ভাড়ায় ফিরে যাওয়ার চিন্তাভাবনা করছে সরকার।
সম্প্রতি রাজধানীর মিরপুর, ফার্মগেইট, মহাখালী, শাহবাগ, গুলিস্তানসহ কয়েকটি এলাকা ঘুরে অধিকাংশ গণপরিবহনকে স্বাস্থ্যবিধি না মেনে চলতে দেখা গেছে।
এমন পরিস্থিতিতে ক্ষুব্ধ বেসরকারি চাকরিজীবী মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ। অফিস করতে তাকে নিয়মিত মিরপুর এক নম্বর থেকে ফার্মগেইট যাতায়াত করতে হয়।
তিনি জানান, আগে নিউ ভিশন ও তানজিল পরিবহনের বাসের ভাড়া ছিল ১৫ টাকা, এখন দিতে হচ্ছে ২৫ টাকা।
ভাড়া বেশি দিতে হলেও পরিবহন কোম্পানিগুলো স্বাস্থ্যবিধি না মানায় ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দুপুরে যখন যাত্রী কম থাকে, তখন বাসগুলো নিয়ম মানছে। কিন্তু অফিস টাইমে কাঁধের উপর দাঁড় করিয়ে যাত্রী নিচ্ছে। যেহেতু কোথাও সোশ্যাল ডিসটেন্স মানা হচ্ছে না, শুধু বাসের অল্প সময়ের বিধিনিষেধে কী হবে? তাই মাস্ক বাধ্যতামূলক করে আগের সিটিং সার্ভিসে ফিরে যাওয়া উচিত।”
ইসিবি থেকে মতিঝিলে আল মক্কা বাসে যাতায়াত করা আরিফ চৌধুরী মনে করেন, এখন বাড়তি ভাড়া নেওয়ার কোনো যুক্তি নেই।
“৪০ টাকার ভাড়া ৬০ টাকা হয়ে যাওয়াটা একটু বেশিই। কেবল যাওয়া-আসাতেই ৪০ টাকার বাড়তি ধাক্কা। অনেকের পক্ষেই এটা কষ্টসাধ্য। অফিস টাইমে যাত্রীরা জোর করে উঠে পড়ে। আবার হেলপাররাও বেশি যাত্রী তোলে। এরপর শুরু হয় ভাড়া নিয়ে বাকবিতণ্ডা। বাড়তি ভাড়াও যাচ্ছে, স্বাস্থ্যবিধিও মানা হচ্ছে না।”
একই অভিজ্ঞতা জানিয়ে মিরপুর-১২ নম্বরের বাসিন্দা ফারুক আহমেদ বলেন, “মিরপুর থেকে গুলিস্তান যায়, এমন কোনো বাসে হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিতে দেখি না। অধিকাংশ হেলপার-ড্রাইভার মাস্ক পরে না। তাহলে লাভ কী? শুরুর দিকে কিছুটা সিরিয়াস ছিল বিষয়গুলো, এখন আর কিছুই মানছে না।”
স্বাস্থ্যবিধি কেন মানা হচ্ছে না জানতে চাইলে আল মক্কা পরিবহনের সহকারী হৃদয় বলেন, “এক-দুইজন জোর কইরা উইঠা দাঁড়াইয়া গেলে যারা আগে ভাড়া দিছে তারা ঝগড়া করে। তখন আমারই লস হয়, কারণ ওয়েবিলে তো যাত্রী কয়জন তা লিখে দেয়। আর দুপুরে তো খালি বাস চালাই। ৫০ শতাংশ ভাড়া বাড়াইয়া এক সিট খালি রাখলে মালিকেরও লস।”
মিরপুর থেকে সদরঘাট রুটের বিহঙ্গ পরিবহনের সহকারী জামাল মুখে মাস্ক ছাড়াই ভাড়া আদায় করছিলেন।
মাস্ক ব্যবহার না করার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, “সারাদিন মাস্ক পইরা থাকতে কষ্ট হয়, এইজন্য মাঝে মাঝে খুইলা রাখি। পকেটে আছে তো!”
আর হ্যান্ড স্যানিটাইজার না রাখার পক্ষে তার যুক্ত হচ্ছে- যাত্রীরাই ব্যবহার করতে চায় না, তাই বাসেও রাখা হয় না।
সাইনবোর্ড থেকে গুলিস্তান আসা জাহাঙ্গীর আলম জানান, আগে এই রুটে ২৫ টাকা ভাড়া নিলেও এখন ৪০ টাকা, কিন্তু যাত্রী তোলা হচ্ছে আগের মতোই। কোনো স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না।
যখন প্রশাসনের নজরদারি ছিল, তখন অনেক বাসেই স্বাস্থ্যবিধি মানা হত বলে মনে করেন যাত্রাবাড়ী থেকে ট্রান্সসিলভা বাসে শাহবাগ আসা হাসান আল মঞ্জুর নামে একজন যাত্রী।
জানতে চাইলে ট্রান্সসিলভা পরিবহনের একজন সহকারী বলেন, “বাসে হ্যান্ড স্যানিটাইজার আছে। কিন্তু যাত্রীরা ওঠার সময় তা ব্যবহার করতে চান না। কেউ চাইলে দেই।”
কুমিল্লা থেকে ঢাকায় আসতে তিশা পরিবহনে আগে ২০০ টাকা ভাড়া নেওয়া হলেও এখন নেওয়া হচ্ছে ৩০০ টাকা।
এ বাসের যাত্রী রেজাউল করিম বলেন, “ভাড়া বেশি নিচ্ছে, আবার উভয় সিটে যাত্রীও নিচ্ছে। কিছু বলতে গেলে বলে আপনার যাওয়ার দরকার নাই।
“এটা জনগণের সাথে প্রহসন। জনগণ আর্থিকভাবে চরম ক্ষতিগ্রস্ত ও ভোগান্তির মধ্যে রয়েছে। সরকারের উচিত দ্রুত অতিরিক্ত ভাড়া প্রত্যাহার করা।”
এ বিষয়ে তিশা পরিবহনের এক সহকারী বলেন, “আমাদের কিছু করার নেই। সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গাড়ি মালিক যতটুক ভাড়া নিতে বলছে, আমরা ততটুকই নিচ্ছি। মাঝে মাঝে অতিরিক্ত যাত্রী হয়ে যায়। অনেক সময় খালি সিটেও চালাতে হয়। এ পরিস্থিতিতে আমরা আগের মতো ভাড়া টানতে পারছি না।”
তবে এখনও করোনাভাইরাসের সংক্রমণ না কমায় ‘মন্দের ভালো’ হিসেবে গণপরিবহনের বর্তমান ব্যবস্থাপনাতেই থাকতে বলছেন কেউ কেউ।
মিরপুরের কালশীর ব্যবসায়ী আনোয়ার সোহেল বাসগুলো নিয়ম মানছে কিনা, সেদিকে বাড়তি নজর দিতে বলছেন।
“তিনশ ফিট দিয়ে নরসিংদীর পাঁচদোনা গিয়েছি ১৭০ টাকা ভাড়া দিয়ে, যেটা ছিল ১১০ টাকা। কিন্তু বিআরটিসির এসি বাসেও যাত্রী দাঁড় করিয়ে নিচ্ছে। তাহলে লাভ কি হল বাড়তি ভাড়া দিয়ে?
“কিন্তু নরসিংদীর লোকাল বাসে ভাড়া না বাড়লেও যাত্রী যাচ্ছে ঠাসাঠাসি করে। ওটা তো আরও ভয়ংকর। তাই বাড়তি ভাড়া থাকুক আরও কিছুদিন, কিন্তু সরকারকে কড়া হতে হবে।”
মহাখালীতে অফিস থাকায় আলিফ পরিবহনে যাতায়াত করা মোহাম্মদপুরের শেহরীন জাহানকে ২০ টাকার ভাড়া ৩০ টাকা গুণতে হচ্ছে। তারপরও এভাবে যেতে রাজি তিনি।
শেহরীন বলেন, “শুনেছি সেপ্টেম্বরে বাস নরমাল হয়ে যাবে, এটি আশঙ্কার বিষয়। তখন ধাক্কাধাক্কি শুরু হবে, ঝুঁকিও বাড়বে। তখন সিএনজিতে অফিস করতে হবে, খরচও বাড়বে।
“এখনই আগের পর্যায়ে ফেরা উচিত হবে না। কারণ এখনও সংক্রমণ বাড়ছে। তাড়াহুড়ো না করে শীত পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করা উচিত। সরকারের হুটহাট সিদ্ধান্ত সংক্রমণ আরও বাড়াবে।”
মনজিল পরিবহনে চিটাগাং রোড থেকে সাতরাস্তায় এসে অফিস করা আফরিন সুলতানা জানান, ৪৫ টাকার ভাড়া ৭০ টাকা নেওয়া হলেও মাঝে মাঝেই দুই সিটে ও দাঁড় করিয়ে যাত্রী নেওয়া হয়।
আফরিন বলেন, “মাসে কেবল বাস ভাড়াই বেড়ে গেছে দেড়-দুই হাজার টাকা। আয় তো বাড়েনি এক টাকা। অনেকের আয় কমেও গেছে। এভাবে চলা সম্ভব না।
“তবে দুই সিটে এক যাত্রী নেওয়ার ব্যবস্থাটা ভালো। সেক্ষেত্রে সরকারের উচিত পরিবহনে ভুর্তকি দিয়ে ভাড়াটা আগের মত রাখা।”