করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে চার মাস পর দেশের নিম্ন আদালতে আবার স্বাভাবিক বিচারকাজ শুরু হচ্ছে বুধবার।
Published : 04 Aug 2020, 07:42 PM
ভার্চুয়ালি শুনানির বদলে এজলাসে বিচারক ও আইনজীবী এবং প্রয়োজনে বিচার প্রার্থীর শারীরিক উপস্থিতিতেই আগের মতো শুনানি হবে। শুধু জরুরি শুনানি নয়, সব মামলার সব ধরনের বিচারকাজ অথাৎ মামলা দায়েরের পর থেকে রায় পর্যন্ত সাক্ষ্য, যুক্তি-তর্ক সব শুনানিই হবে।
তবে এক্ষেত্রে বেশ কিছু বিধি-নিষেধ মেনে চলতে হবে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি এড়াতে।
গত ৩০ জুলাই সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল মো. আলী আকবর স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে ৫ অগাস্ট থেকে নিম্ন আদালতের স্বাভাবিক বিচারকাজ চলবে বলে জানানো হয়। মহামারীকালে আদালত প্রাঙ্গণ ও এজলাস কক্ষের সুরক্ষা সংক্রান্ত হাই কোর্ট বিভাগের দেওয়া নির্দেশনা প্রতিপালনের নির্দেশ দেওয়া হয় সেখানে।
নির্দেশনা অনুযায়ী, এজলাসে একসঙ্গে দুইজন আইনজীবী এবং ছয়জনের বেশি সমাগম করা যাবে না, কমপক্ষে ছয় ফুট দূরত্ব বজায় রাখতে হবে, একটি মামলার শুনানি শেষ হলে ওই মামলার আইনজীবীরা এজলাস কক্ষ ত্যাগ করার পর পরবর্তী মামলার শুনানি গ্রহণ করবেন বিচারক। জামিন শুনানি এবং আমলি আদালতে আসামির হাজিরার জন্য কারাগার থেকে হাজতিকে প্রিজন ভ্যানে আদালতে আনার দরকার নেই।
এর বাইরে এজলাস কক্ষের বাইরে ভিড় না করাসহ আদালত প্রাঙ্গণের সুরক্ষা নিয়ে অনেকগুলো নির্দেশনা রয়েছে। এসব নির্দেশনা যথাযথভাবে মেনে চলা হবে কি না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে আইনজীবীদের মধ্যে।
৪৩ বছর ধরে ঢাকার উচ্চ ও নিম্ন আদালতে আইন পেশায় নিয়োজিত পান্নালাল রায় আদালত খোলার আগের দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ভার্চুয়াল আদালত তো ছিল সাময়িক সময়ের জন্য। ওই ভাবে আর চলছিল না। কনিষ্ঠ আইজীবীরা অভূতপূব অর্থ-কড়ির সঙ্কটে পড়েছিলেন। এমনকি একই অবস্থা হয়েছিল সৎ জ্যেষ্ঠ আইনজীবীদেরও।
“আদালতের শুধু এজলাস নয়, বারান্দা, প্রাঙ্গণেও গণসমাবেশ, আইনজীবী বিচারপ্রার্থী কমর্চারীদের শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে বাধ্য করার জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে। রেজিস্ট্রার জেনারেলের বিজ্ঞপ্তি মানতে হবে। সে ব্যবস্থা কেমন করে করা যাবে সেটা বারের নেতারা, বিচারকগণ ঠিক করবেন।”
ঢাকা বারের সাবেক সভাপতি ও সবচেয়ে প্রবীণ আইনজীবীদের একজন সৈয়দ রেজাউর রহমান বলেন, “নিরাপত্তা ও শারীরিক দূরত্বের বিষয়ে হাই কোর্ট, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, আইন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মেনে চলতে হবে। আইনজীবীদের সচেতন থাকতে হবে। শুনানি না থাকলে আড্ডা, গল্পের জন্য বা জরুরি কোনো বিষয় না থাকলে এজলাসে বা আদালতের বারান্দায় ঢোকা উচিৎ হবে না। এজলাসের প্রবেশ পথ থেকেই সম্মান ও সৌন্দর্য রেখে পারস্পরিক বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে আইনজীবী বিচারপ্রাথীদের প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ থাকতে পারে। এক্ষেত্রে বারের এবং আদালত পুলিশের ভূমিকা থাকতে পারে।”
২১ অগাস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌসুলি সৈয়দ রেজাউর বলেন, “আমি অধিকাংশ মামলাই করি কনিষ্ঠ আইনজীবীদের অনুরোধপ্রাপ্ত হয়ে। কোনো শুনানি সেটি সাক্ষ্য অথবা জামিন যা-ই হোক না কেন সিডিউলে না থাকলে তো আমি এজলাসের বারান্দা মাড়াব না।”
জ্যেষ্ঠ এই আইনজীবীরা একথা বললেও ভাইরাস সংক্রমণের মধ্যেই ভার্চুয়াল শুনানির দিনগুলোতেও জুন-জুলাই মাসে স্বাস্থ্য খাতে প্রতারণা মামলার আসামি সাহেদ, ডা. সাবরিনাসহ জেকেজি হেলথ কেয়ারের মামলার শুনানির সময় ঢাকার বিভিন্ন মহানগর হাকিমের এজলাসে আইনজীবীসহ অনেক মানুষের উপস্থিতি দেখা গেছে।
আদালতের সুরক্ষা বিষয়ে ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের পেশকার (বেঞ্চ সহকারী) ফয়েজ আহমেদের কাছে জানতে চাইলে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখনও কোনো কিছু ঠিক করা হয়নি চূড়ান্তভাবে। তবে এটুকু আলোচনা ও সিদ্ধান্ত এসেছে যে, আগের মতো আসামি-বিচারপ্রার্থীদের এজলাস কক্ষ ও বারান্দায় দাঁড়াতে দেওয়া হবে না। নির্ধারিত তারিখে তারা ভবনের নিচের প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে থাকেবেন।
“হ্যান্ডমাইক দিয়ে মামলার নম্বর ও আসামির নাম ডাকা হবে। একটা মামলার শুনানি শেষে এজলাস কক্ষ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা (আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থী) ত্যাগের পর অন্য মামলা শুরু হবে এবং সংশ্লিষ্টরা ঢুকবেন। আর ট্রায়ালের (বিচার) জন্য আগামীকাল ৫ তারিখ থেকে দেখে শুনে মামলার কজলিস্টে তারিখ ফেলা শুরু হবে। সে কারণে এ সপ্তাহে তো নয়ই, আগামী সপ্তাহেও ট্রায়াল আর সাক্ষ্যগ্রহণ, আত্মপক্ষ সমর্থন, যুক্তিতর্ক শুরু করা সম্ভব হবে কি না সন্দেহ রয়েছে।”
এজলাসে উপস্থিত সবার সুরক্ষা নিশ্চিতের জন্য সাক্ষীর ডক, কাঠগড়া গ্লাস দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে কি না জানতে চাইলে ফয়েজ বলেন, “না, এগুলো এখনও করা হয়নি।”
এ বিষয়ে আদালতের প্রশাসনিক কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আগাম কিছু বলা যাবে না। কাল খুললে বোঝা যাবে কীভাবে কী হবে।”
হাই কোর্টের নির্দেশনাগুলোর মধ্যে একটি পরিছ্ন্নতা ও জীবাণুনাশকের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের ব্যক্তিগত সহকারী জহিরুল কাইয়ূম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা ভার্চুয়াল আদালত শুরুর প্রথম থেকেই জীবাণুনাশক স্প্রে মেশিন থেকে এজলাসে ব্লিচিং পাউডার স্প্রে করছি। এখন আমাদের কাছে এ রকম চারটি মেশিন রয়েছে। আমরা সেগুলো ব্যবহার করব।”
স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলা নিয়ে ঢাকা আইনজীবী সমিতির কোনো উদ্যোগ আছে কি না জানতে চাইলে সমিতির সাধারণ সম্পাদক হোসেন আলী খান হাসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা অনেক আগে থেকে বার ভবনে পর্যাপ্ত পরিমাণে হ্যান্ডওয়াশ ও স্যানিটাইজার রেখেছি। উচ্চ আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়নে এজলাসে ঢোকা, অবস্থান করা, আদালত প্রাঙ্গণে, এজলাসের বরান্দায় অবস্থান করাসহ বিভিন্ন বিষয়ে আমাদের বারের পক্ষ থেকে কঠিন নজরদারি থাকবে। যদি এই নির্দেশনা কোনো আইনজীবী না মানেন, ভিড় করেন, সমাবেশ করেন তাহলে তার নাম সদস্য নম্বরসহ বার কাউন্সিলে পাঠানো হবে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য।
“আমরা চাই মামলার বিচার, দ্রুত নিষ্পত্তি। মামলার পাহাড় আরও যেন উঁচু না হয়।”
দেশে নতুন করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর সরকার গত ২৬ মার্চ থেকে সারা দেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে।
তার সঙ্গে মিল রেখে সর্বোচ্চ আদালতসহ দেশের সব আদালতে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সুপ্রিম কোর্ট। সরকারের সাধারণ ছুটির সঙ্গে আদালতের সাধারণ ছুটিও কয়েক দফা বাড়ানো হয়।
এক মাসের বেশি সময় বিচারকাজ বন্ধ থাকার পর ‘ভার্চুয়াল আদালতে’ শুনানির জন্য গত ৯ মে সরকার ‘আদালত কর্তৃক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার’ অধ্যাদেশ জারি করে।
পরদিন সর্বোচ্চ আদালতের উভয় বিভাগের বিচারপতিদের নিয়ে ভিডিও কনফারেন্সে ‘ফুলকোর্ট’ সভা করেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন।
ফুলকোর্ট সভার পর ওইদিনই অধস্তন আদালতে ভার্চুয়াল জামিন শুনানির নির্দেশ আসে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন থেকে। তার জন্য তিনটি বিশেষ প্র্যাকটিস নির্দেশনাও জারি করে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন।
তার মধ্যে আপিল বিভাগ পরিচালনার জন্য্ ১৩ দফা, হাই কোর্ট পরিচালনার জন্য ১৫ দফা ও অধস্তন আদালত পরিচালনার জন্য ২১ দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়।
এই ‘প্র্যাকটিস নির্দেশনা’র আলোকে ১১ মে থেকে তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে দেশের অধস্তন এবং ১২ মে থেকে উচ্চ আদালতে বিচারকাজ শুরু হয়।
এরপর প্রায় তিন মাস ভার্চুয়াল উপস্থিতির মাধ্যমে চলছিল দেশের অধস্তন আদালতের বিচারকাজ। তাও সব মামলার বিচার চলছিল না।
সরকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বাদে আর সব অফিস খুলে দেওয়ার পর আইনজীবীরাও স্বাভাবিক আদালত চালুর দাবি জানিয়ে আসছিলেন।