গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালানোর ঘটনায় সাত আসামির মৃত্যুদণ্ডের রায়ের পর আদালত প্রাঙ্গণেই তাদের দুজনের মাথায় দেখা গেল কালো টুপি, সেখানে মধ্যপ্রাচ্যের জঙ্গি দল আইএস এর পতাকার চিহ্ন।
Published : 27 Nov 2019, 02:02 PM
বুধবার বিশ্বজুড়ে আলোচিত এ মামলার রায়ের পর পুলিশ হেফাজতে থাকা অবস্থায় আসামিদের কাছে কী করে ওই টুপি গেল, সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি কেউ।
কেবল টুপিতে নয়, রায়ের আগে, পরে এবং রায়ের সময় আদালতকক্ষেও আসামিদের আচরণ ছিল উদ্ধত।
২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়াবহ সেই জঙ্গি হামলায় নিহত হন ২২ হন, যাদের সতের জনই বিদেশি। ১২ ঘণ্টা পর কমান্ডো অভিযানের মধ্য দিয়ে সেই সঙ্কটের রক্তাক্ত অবসান ঘটে।
হামলায় সরাসরি অংশ নেওয়া পাঁচ তরুণের সবাই সেই মারা পড়ে। হামলায় জড়িত আরও অনেকে পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে নিহত হন। জীবিত অবস্থায় গ্রেপ্তার আটজনকেই কেবল বিচারের মুখোমুখি করা সম্ভব হয়।
সেই বিচারের রায়ে ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মজিবুর রহমান বুধবার সাতজনকে মৃত্যুদণ্ড দেন।
এই সাতজন হলেন- জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে রাজীব গান্ধী, আসলাম হোসেন ওরফে র্যাশ, আব্দুস সবুর খান, রাকিবুল হাসান রিগ্যান, হাদিসুর রহমান, শরিফুল ইসলাম ওরফে খালেদ ও মামুনুর রশিদ রিপন।
অপরাধে সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত না হওয়ায় এ মামলায় বিচারের মুখোমুখি করা আরেক আসামি মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজানকে খালাস দেওয়া হয়েছে রায়ে।
রায়ের আগে আসামিদের যখন হাজতখানা থেকে বের করে আদালত কক্ষে নেওয়া হচ্ছিল, আসামিদের একজন আঙুল তুলে ‘ভি’ চিহ্ন দেখান। কালো পাঞ্জাবি পড়া জাহাঙ্গীর আলমের মুখে ছিল হাসি। মামুনুর রশীদ রিপনকে কিছুটা গম্ভীর মনে হলেও বাকিদের হাসতে ও আঙুল তুলে কথা বলতে দেখা যায়।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা জানান, কাঠগড়ায় তোলার পরও আসামিরা বেশ ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করছিলেন। নারায়ে তাকবীর স্লোগান দিয়ে বলছিলেন, বিচার হবে হাসরের ময়দানে।
সাতজনের ফাঁসির রায় ঘোষণার পর তাদের একজন উচ্চস্বরে বলতে থাকেন, “আল্লাহু আকবর, আমরা কোনো অন্যায় করিনি।”
রায় শেষে আদালত কক্ষেই আসামি রাকিবুল হাসান রিগ্যানের মাথায় দেখা যায় একটি কালো টুপি, সেখানে আইএস এর পতাকার ঢঙে আরবি লেখা।
এসময় তার পাশে পুলিশ সদস্যরাও উপস্থিত ছিলেন। তবে কাউকে এ বিষয়ে ভ্রুক্ষেপ করতে দেখা যায়নি।
পরে আসামিদের কারাগারে নেওয়ার সময় প্রিজন ভ্যানে তোলা হলে জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে রাজীব গান্ধীর মাথাতেও একই ধরনের টুপি দেখা যায়।
আমাদের প্রতিবেদক ও আলোকচিত্রীরা বলছেন, রায়ের আগে আসামিদের কারাগার থেকে এনে হাজতখানায় ঢোকানোর সময় কেবল আব্দুস সবুর খান সোহেল মাহফুজের মাথায় একটি সাদা টুপি ছিল। রিগ্যান ও রাজীব গান্ধীর মাথা ছিল খালি।
আদালতে উপস্থিত সাংবাদিকদের ধারণা, হাজতখানা থেকে বের হওয়ার সময় রিগ্যান ওই টুপি উল্টো করে পড়েছিলেন। রায়ের পর তিনি টুপি উল্টে নেওয়ায় আইএস এর চিহ্ন সামনে চলে আসে। পরে প্রিজন ভ্যানে তার কাছ থেকে নিয়েই রাজীব গান্ধী সেই টুপি মাথায় দেন।
আদালত প্রাঙ্গণে পুলিশ হেফাজতে থাকা অবস্থায় কীভাবে ওই টুপি তারা পেলেন- সে বিষয়ে স্পষ্ট কিছু বলতে পারেননি কেউ।
পুলিশের উপ-কমিশনার (প্রসিকিউশন) জাফর আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এটা আমরা খেয়াল করতে পারিনি। ধর্মীয় টুপি বলেই মনে করেছিলাম। পরে বিষয়টি নজরে আসে। তবে আদালত থেকে এধরণের টুপি আসামিদের হাতে যাওয়ার সুযোগ নেই।”
অন্যদিকে জেলার মাহবুব আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আসামিদের মধ্যে শুধু একজন আমাদের এখান থেকে সাদা টুপি পরে গেছে। বাকি সবার মাথা খালি ছিল। আমাদের এখান থেকে এ ধরনের কোনো টুপি পরে কেউ যায়নি।
“রায় ঘোষণার পর আসামিরা যখন কারাগারে এসেছে, তখনও তাদের কাছে কোনো কালো টুপি পাওয়া যায়নি।”
রায়ের পর প্রিজন ভ্যানে ওঠানোর পর আসামিরা চিৎকার করে বলতে থাকে- ‘খেলাফত শাসন প্রতিষ্ঠা হবেই। ‘আমরা আল্লাহর সৈনিক’, ‘আল্লাহর সৈনিকদের মৃত্যু হতে পারে না’, ‘২-৪ জনকে ফাঁসি দিয়ে জিহাদ দমন করা যাবে না’।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আবদুল্লাহ আবু বলেন, “এ ব্যাপারে আমি বলতে পারব না, এটা জেল কর্তৃপক্ষ, যেখান থেকে এদেরকে আনা হয়েছে, এই টুপি কীভাবে পরল, এই জবাবটা তারা দিবে। টুপি তারা পরতে পারে, কিন্তু টুপিতে কালো কাপড় দিয়ে প্রতীকী টুপি পরা একটি সংগঠনের, এটা অন্যায়। এটা কোনোভাবে হওয়া উচিত না।”
বিষয়টি তদন্তের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, “তাদের (জেল কর্তৃপক্ষের) অবহেলা বা গাফিলতি আমি এই মুহূর্তে বলব না। এটা সুষ্ঠুভাবে দেখতে হবে, এটার অবশ্যই তদন্ত হওয়া দরকার, জানা দরকার। আইএসের অনুরূপ কীভাবে এই টুপিটা তারা পরল?”
আব্দুল্লাহ আবু বলেন, নিরাপত্তার অনেকগুলো ধাপ পার করে আসামিদের আদালতে আনা হয়েছে। তার মধ্যে কীভাবে আসামিদের কাছে টুপি গেল, কীভাবে ফিতা লাগালো- এটা অবশ্যই দেখা দরকার, কেননা বিষয়টি ‘অত্যন্ত স্পর্শকাতর’।
এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে পিপি গোলাম ছারোয়ার খান জাকির বলেন, “আমি মন্তব্য করব না। তবে এর আগে আসামিরা যখনই আদালতে এসেছে এমন কোনো অভিযোগ পাইনি।”
অন্যদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী দেলোয়ার হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, “আসামিরা দীর্ঘদিন ধরে পুলিশের হাতে ছিল। আসামিরা কে কী পরে এসেছে সেটা নিয়ে আমার কথা বলা ঠিক নয়। এটা পুলিশের বিষয়।”
পরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রশ্নের জবাব দেয়ার সময় দেলোয়ার হোসেন বলেন, তার মক্কেলরা আইএস সমর্থক ‘হতেও পারে’।
গুলশানে হামলার রাতে হলি আর্টিজান বেকারির ভেতরে কী ঘটেছে সে বিষয়ে দেশের মানুষ যখন নিশ্চিত হতে পারছিল না, আইএস এর মুখপত্র আমাক প্রথমে হামলাকারী পাঁচ তরুণের ছবি এবং পরে নিহত কয়েকজনের রক্তাক্ত ছবি ইন্টারনেটে প্রকাশ করে।
আইএস গুলশান হামলার দায় স্বীকার করেছে বলেও সেদিন খবর আসে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে। বাংলাদেশের গোয়েন্দারা তা নাকচ করে বলেন, বাংলাদেশি জঙ্গিদের একটি সংগঠিত ধারাই এই হামলা চালিয়েছে, যার নাম দেওয়া হয় ‘নব্য জেএমবি’।
মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়- হলি আর্টিজানে হামলার পেছনে মূলত তিনটি উদ্দেশ্য ছিল জঙ্গিদের। ১. কূটনৈতিক এলাকায় হামলা করে নিজেদের সামর্থ্যের জানান দেওয়া; ২. বিদেশি নাগরিকদের হত্যা করে নৃশংসতার প্রকাশ ঘটানো এবং ৩. দেশে বিদেশে গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার পাওয়া এবং বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করা।
হলি আর্টিজান মামলার রায়ের পর সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকরা আসামির মাথায় আইএস এর টুপি নিয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হককে প্রশ্ন করেন।
জবাবে তিনি বলেন, “এই ব্যাপারটার তদন্ত হওয়া উচিত। এখনইতো বলতে পারবো না কীভাবে তারা পেল। প্রেস কনফারেন্সের পরেই আমি এ ব্যাপারে খোঁজ নেব।”
এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে প্রসিকিউশন পুলিশের উপ কমিশনার জাফর হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তারা ইতোমধ্যে তদন্ত শুরু করেছেন। ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। ওই টুপি আসামিরা সঙ্গে করে এনেছেন না আদালত চত্বরে কেউ তাকে দিয়েছে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
বিষয়টি খতিয়ে দেখতে একজন অতিরিক্ত আইজিকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করার কথা জানান আইজি প্রিজনস ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোস্তফা কামাল।
তবে এ মামলার তদন্তকারী সংস্থা পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম ওই টুপিকে ‘আইএসের টুপি’ বলতে রাজি নন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আইএস কখনো টুপি ব্যবহার করত না। আইএসের কোনো টুপি নেই। যতটুকু জানা গেছে টুপিটিতে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু লেখা ছিল। এটা অনেকেই ব্যবহার করে। এটা নব্য জেএমবির টুপি হতে পারে।”