সন্তানদের বড় করা, তিল তিল করে জমানো টাকায় টিনের ঘর তৈরি। ভেবেছিলেন হয়তো বা থিতু হল জীবন। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের আঘাতে এক রাতের মধ্যেই তাকে ফিরতে হয়েছে নয় বছর পেছনের সেই অনিশ্চয়তায়।
শুধু রাশিদা বেগমই নন, সুন্দরবন সংলগ্ন সাতক্ষীরার কয়রা, দাকোপ, শ্যামনগর উপজেলায় তার মতো অনেকের চোখেই এখন জীবিকার অনিশ্চয়তা।
তবে ‘ভয়ঙ্কর সুন্দর’ সুন্দরবন যেমন কেড়ে নেয়, আবার ফিরিয়েও দেয় কয়েকগুণ। ঢাল হয়ে এবার ‘বুলবুল’ ঠেকানো সুন্দরবনেই আশা দেখছেন রাশিদারা। লোনা পানিতে অনুর্বর এখানকার বনজীবীদের আসলে বিপদসংকুল সুন্দরবনে যাওয়া ছাড়া উপায়ও নেই।
নদী পার হয়ে চকবাড়া গ্রামে আসতেই দেখা রাশিদা বেগমের সঙ্গে। এলাকার প্রায় প্রতিটি ঘরেই কেউ না কেউ বাউয়ালি কিংবা মৌয়াল। এখানে যাদের স্বামী বাঘের শিকারে পরিণত হয়েছেন, সেই নারীদের বলা হয় ‘বাঘ বিধবা’।
ঝড়ে টিনের চাল উড়ে যাওয়া বিধ্বস্ত ঘরেই কথা হয় রাশিদা বেগমের সঙ্গে।
দিশাহারা এই নারী বলেন, “ঝড় এসে সব তছনছ করে দিল। এখন কই যাব? এখনও চেয়ারম্যান, মেম্বার, সরকারের লোক কেউ খোঁজ নিল না। আমাদের অন্য কোনো কাজের সুযোগও নেই। বনে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। ভয় পাই ছেলেদেরকেও যদি তাদের বাবার মতো বাঘে নেয়।”
রাশিদা বেগমের ভাঙ্গা ঘর থেকে বের হতেই পাওয়া গেলো রিজিয়া বেগমের খবর। তিনিও বাঘ বিধবা। স্বামী ইসলাম সর্দার ছিলেন মৌয়াল; সুন্দরবনে মধু সংগ্রহ গিয়ে আর ফেরেননি।
রিজিয়া জানালেন, ১৫ বছর আগে মধু কাটতে বাদায় গিয়েছিলেন তার স্বামী, বাঘে নিয়েছে তাকে। রিজিয়ার এক ছেলে, দুই মেয়ে। ছেলেও মৌয়াল। কিন্তু ছেলেকে নিয়ে এই নারীও শঙ্কায় থাকেন সব সময়।
চকবাড়া থেকে গাবুরার ডুমুরিয়ার দিকে যেতে চোখে পরে ঝড়ের তাণ্ডবে বিদ্ধস্ত বাজার। গোলপাতায় ছাওয়া বাজারের সব দোকানই লণ্ডভণ্ড।
এখানে অশীতিপর আবদুস সালাম জানালেন, জীবনে অনেক ঘূর্ণিঝড় দেখেছেন, তবে এবার ঘরবাড়ির চেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে গাছপালার।
“ঝড় আঘাত করে রাত তিনটার দিকে। ততক্ষণে জোয়ার শেষ। ফলে পানি আর লোকালয়ে ঢুকতে পারেনি। জোয়ারের সময় ঝড় আঘাত করলে পুরো গাবুরা সাফ হয়ে যেত।”
বুলবুলের আঘাতে এখানে প্রাণহানি না হলেও জীবিকার চিন্তায় এখানকার মানুষের দুশ্চিন্তা কাটছে না কিছুতেই। ঝড়ের পর পর্যাপ্ত সহায়তাও মেলেনি। তাই সুন্দরবনই ভরসা তাদের।
ইয়াদ আলী ৩৭ বছর ধরে সুন্দরবনে মধু সংগ্রহের কাজ করেন। মৌয়ালদের সর্দার তিনি।
তিনি বলেন, “এখন আর ইচ্ছা করে না। অনেক কষ্ট, বাঘের ভয় আছে। আমার সামনে দুইবার বাঘে নিয়ে গেছে দলের দুইজনকে। ডাকাতের ঝামেলাও আছে। কিন্তু তারপরও এই কাজ আমাদের করতে হচ্ছে, অন্য কোনো কাজের সুযোগ নেই এখানে।”
গাবুরাবাসী জানালো, ঝড়ের পরপরই প্রশাসন এবং সেনাবাহিনী খোঁজ খবর নিয়েছে। তবে ত্রাণ সাহায্য অপ্রতুল।
তবে ত্রাণের চেয়ে বাঁধ মেরামত আর বিকল্ড কর্মসংস্থান- এই দুটোই বেশি দরকার তাদের।