স্থানীয় সরকার বিভাগের সঙ্গে ঠেলাঠেলির পর বিদেশ থেকে মশা মারার ওষুধ আনার দায়িত্ব ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ওপরই বর্তেছে; সরকারের দুই দপ্তরকে এ বিষয়ে সব ধরনের সহযোগিতা দিতে নির্দেশ দিয়েছে হাই কোর্ট।
Published : 01 Aug 2019, 05:37 PM
মশা মারার কার্যকর ওষুধ আমদানির বিষয়ে বৃহস্পতিবার তিন দফা শুনানিতে দুই সিটি করপোরেশন এবং স্থানীয় সরকার সচিব হেলালুদ্দীন আহমদের বক্তব্য শুনে বিচারপতি তারিক-উল হাকিম ও বিচারপতি মো. সোহরাওয়ার্দীর বেঞ্চ এই আদেশ দেয়।
আদালত বলেছে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং স্থানীয় সরকার বিভাগ মশা মারার ওষুধ দ্রুত আনার ব্যাপারে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনকে ‘লাইসেন্স’ ও ‘ক্লিয়ারেন্স’সহ সার্বিক সহযোগিতা দেবে।
‘সম্ভব হলে’ ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনসহ সব সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও দেশব্যাপী ওই ওষুধ সরবরাহ করতে হবে। তবে ঢাকার বাইরে সারাদেশের জন্য ওষুধ আনার বিষয়টি সরকার বিবেচনা করতে পারে বলে মত দিয়েছে আদালত।
পাশাপাশি ঢাকা মহানগরীর সব সরকারি হাসপাতালে একজন করে চিকিৎসককে ডেঙ্গু চিকিৎসার বিষয়ে সার্বক্ষণিক তদারকির দায়িত্ব দিতে বলা হয়েছে, যিনি পদমর্যাদায় অন্তত সহযোগী অধ্যাপকের সমান হবেন।
সব হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীদের জন্য অতিরিক্ত বেডের ব্যবস্থা রাখতে স্বাস্থ্য সচিব ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
আদেশে বলা হয়েছে, যেন একজন রোগিও চিকিৎসা না পেয়ে ফেরত না যায় তা নিশ্চিত করতে হবে। যারা ডেঙ্গুর লক্ষণ নিয়ে হাসপাতালে যাবেন, মানবিক দিক বিবেচনায় তাদের সবার চিকিৎসা বেসরকারি হাসপাতালগুলোকেও নিশ্চিত করতে বলেছে আদালত।
এছাড়া ডেঙ্গু পরীক্ষার কিট আমদানী করে যাতে স্বল্পমূল্যে দ্রুত সরবরাহ করা হয়, সরকারকে তা নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে আদেশে।
স্থানীয় সরকার সচিব হেলালুদ্দীন আহমদের পাশাপাশি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আব্দুল হাই ও প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মোমিনুর রহমান মামুন এবং দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পক্ষে আইনজীবী সাঈদ আহমেদ রাজা এবং উত্তর সিটি করপোরেশনের পক্ষে তৌফিক ইনাম টিপু এদিন আদালতে শুনানি করেন। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল কাজী মাঈনুল হাসান ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল সায়রা ফাইরোজ।
আদালতের আদেশের পর সচিব হেলালুদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, “হাই কোর্ট আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন যে, সরাকরি পর্যায়ে অর্থাৎ জিটুজি পদ্ধতির মাধ্যমে মশার ওষুধ আনতে অসুবিধা কোথায়। আমি বললাম এটা আমার জানতে হবে। এ জন্য আমাকে এক ঘণ্টা সময় দিলেন। এক ঘণ্টা সময়ের মধ্যে আমি সকল মহলের সঙ্গে এবং বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি।
“এটা পরীক্ষা করে দেখতে হবে যে মানবদেহে ওষুধটির কোনো প্রভাব আছে কি না। তাছাড়া এটা পৃথিবীর কোনো দেশে সরকারিভাবে প্রসেস করা হয় না। বেসরকারি খাতে এটা প্রস্তুত করা হয়। সুতরাং সিটি করপোরেশন হলো একমাত্র প্রতিষ্ঠান মশা নিধনের জন্য।”
এ বিষয়ে সিটি করপোরেশনকে আর্থিক সহযোগিতার পাশাপাশি জনবলসহ যা যা দরকার সব সহযোগিতা দিতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় প্রস্তুত রয়েছে বলে জানান সচিব।”
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে সাড়ে ১৯ হাজার মানুষ, যাদের মধ্যে ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। তবে সংবাদপত্রে আসা খবরে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা এ বছর অর্ধশত ছাড়িয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে এডিস মশার প্রজননস্থানগুলো ধ্বংসে সফলতা না এলে এ রোগের প্রকোপ আরও বাড়তে পারে বলে সতর্ক করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
ঢাকায় এবার এডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু জ্বরে প্রকোপ বাড়তে শুরু করে গত জুন মাস থেকে। জুলাইয়ের শেষে এসে তা ছড়িয়ে পড়ে দেশের সব জেলায়।
এই পরিস্থিতিতে সিটি করপোরেশনের মশা নিধন কার্যক্রমে শিথিলতার অভিযোগ ওঠে। মশা মারতে ব্যবহৃত ওষুধ ‘কার্যকর নয়’ বলে আইসিডিডিআর,বির এক গবেষণায় তথ্য এলে সমালোচনা আরও জোরালো হয়ে ওঠে।
এই প্রেক্ষিতে মশা নিধনে কার্যকর ওষুধ আনতে কত দিন লাগবে, তা গত ২৫ জুলাই জানতে চেয়েছিল হাই কোর্ট। দুই সিটি করপোরেশন ও রাষ্ট্রপক্ষকে সুনির্দিষ্টভাবে তা হলফনামা আকারে জানাতে বলা হয়েছিল।
এর ধারাবাহিকতায় বৃহস্পতিবার সকালে আদালতের কাছে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরেন ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এবং রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা।
দুই সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে বলা হয়, মশার ওষুধ আনার দায়িত্ব সরকারের; ছিটানোর দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের।
অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বলেন, মশা মারার ওষুধ সিটি করপোরেশনই আনবে। সরকার এ বিষয়ে সব ধরনের সহযোগিতা দেবে।
তখন জরুরি পরিস্থিতিতে মশা মারার ওষুধ আনার বিষয়ে জানতে স্থানীয় সরকার সচিবকে তলব করে হাই কোর্ট। তাকে বেলা ২টার মধ্যে আদালতে উপস্থিত থাকতে বলা হয়।
নির্ধারিত সময়ে আদালতে হাজির হয়ে হেলালুদ্দীন আদালতকে বলেন, “অনেকের ধারণা, মশার যে ওষুধটি চলছে সেটা দিয়ে মশা মরছে না। ফলে ২৮ জুলাই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, এলজিইডি, দুই সিটি করপোরেশন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের সাথে মিটিং হয়। সেখানে সিদ্ধান্ত হয় যে ওষুধ আনবে সিটি করপোরেশন। আমরা টাকাসহ সব ধরনের সহযোগিতা দেব।”
হাই কোর্ট বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি তারিক-উল হাকিম তখন বলেন, “তারা (সিটি করপোরেশন) তো বলছে ভিন্ন কথা। দক্ষিণ সিটি করপোরেশ তো দরখাস্ত দিয়ে নির্দেশনা চাইছে যাতে আপনারা ওষুধ আনেন।”
উত্তর সিটির প্রধার নির্বাহী কর্মকর্তা এ সময় আদালতকে বলেন, নতুন ওষুধের নমুনা আনা হচ্ছে, ইতোমধ্যে তা দেশের পথে রয়েছে।
বিচারক তখন বলেন, “আপনারা বলছেন তারা আনবে, আর তারা বলছে আপনারা আনবেন। সরাসরি আপনাদের আনতে অসুবিধা কি? একটা ক্রাইসিস পিরিয়ড চলছে। বলেন আপনারা (সরকার) আনতে পারবেন কিনা?”
উত্তরে সচিব বলেন, “আমরা, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, সিটি করপোরেশন মিলে দ্রুত ব্যবস্থা করব।”
বিচারক তখন বলেন, “অগাস্ট-সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গুর প্রকোপ আরও বাড়বে। আমাদের জানান- জি টু জি পদ্ধতিতে আনা সম্ভব কিনা, আমরা আদেশ দেব।”
পরে আদালত বিকাল ৪টার মধ্যে ওই সিদ্ধান্ত জানানোর নির্দেশ দেয় সচিব হেলাল উদ্দিনকে।
নির্ধারিত সময়ে আদালতে এসে সচিব জানান, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে তিনি এ বিষয়ে কথা বলেছেন। তারা বলেছেন, মশা মারার জন্য্ যে কীটনাশক আমদানি করতে হবে, তা উৎপাদিত হয় বেসরকারিভাবে। ফলে সরকারি পর্যায়ে বা জিটুজি পদ্ধতিতে তা আনা সম্ভব না।
“কাজেই দুই সিটি করপোরেশনকেই ওষুধ আমদানি করতে হবে। আমরা দুই সিটি করপোরেশনকে লাইসেন্স ও ক্লিয়ারেন্স দিয়ে দিয়েছি। এরপরও যত ধরনের সহযোগিতা করা দরকার তার সবটুকুই করব ওষুধ আনার ব্যাপারে।”
আর উত্তর সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে এ সময় আদালতকে জানানো হয়, চীন থেকে তারা মশা মারার ওষুধের নমুনা (স্যাম্পল) আনার ব্যবস্থা করেছে। সেই স্যাম্পল বাংলাদেশের পথেই রয়েছে। এটা পরীক্ষা করে ব্যবহার উপযোগী কি না সেই অনুমোদন পেতে অন্তত ১৪ কার্যদিবস লাগবে।
শুনানি শেষে হাই কোর্ট মশা মারার ওষুধ আমদানিতে সিটি করপোরেশনকে সব ধরনের সহযোগিতা দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে আদালতের কার্যক্রম শেষ করে।