যুদ্ধাপরাধ: রণদা প্রসাদ হত্যার রায় যে কোনো দিন

মুক্তিযুদ্ধের সময় দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা ও তার ছেলেসহ সাতজনকে হত্যার ঘটনায় টাঙ্গাইলের মাহবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায় হবে যে কোনো দিন।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 April 2019, 12:02 PM
Updated : 24 April 2019, 12:02 PM

উভয় পক্ষের যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে বিচারপতি শাহিনুর ইসলামের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বুধবার মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখে।

ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশনের তথ্য অনুযায়ী, ৭০ বছর বয়সী আসামি মাহবুবুর একাত্তরে মির্জাপুর শান্তি কমিটির সভাপতি বৈরাটিয়া পাড়ার আব্দুল ওয়াদুদের ছেলে। মাহবুবুর ও তার ভাই আব্দুল মান্নান সে সময় রাজাকার বাহিনীতে ছিলেন।

অপহরণ, আটকে রেখে নির্যাতন, হত্যা- গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের তিনটি ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ আনা হয়েছে মাহবুবের বিরুদ্ধে।

রাষ্ট্রপক্ষে মামলাটি পরিচালনা করেন প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত। আসামিপক্ষে ছিলেন গাজি এম এইচ তামিম।

রানা দাশগুপ্ত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রসিকিউশন ও আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থান শেষ হলে আজ আদালত মামলাটির রায় অপেক্ষমাণ রেখে আদেশ দিয়েছেন। এর মানে হল যে কোনো দিন রায় ঘোষণা করা হবে।”

এ প্রসিকিউটর বলেন, “আসামির বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের তিনটি অভিযোগ এনেছিল প্রসিকিউশন। আমরা মনে করি তিনটি অভিযোগই আমরা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি। তদন্তকারী কর্মকর্তাসহ এ মামলায় ১৩ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন। যেসব সাক্ষ্য-প্রমাণ আমরা উপস্থাপন করেছি তাতে আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড চেয়েছি।”

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল

আসামি মাহবুবের বিরুদ্ধে ‘গণহত্যা অথবা বিকল্প হিসেবে অপহরণ, নির্যাতন ও হত্যার’ যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা অপরাধের নতুন কোনো সংজ্ঞায়ন কিনা জানতে চাইলে রানা দাশগুপ্ত বলেন, “না, এটা নতুন কোনো টার্ম না। আমরা তিনটি চার্জেই মাস কিলিং এবং এর বিকল্প হিসেবে অন্য অপরাধের টার্ম ইউজ করেছি। আমরা আমাদের সাক্ষ্য প্রমাণ, যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেছি। এখন ট্রাইব্যুনাল তা কীভাবে বিবেবচনা করবে তা রায়ের মাধ্যমে জানতে পারব “

তিনি জানান, নেত্রকোণার দুই যুদ্ধাপরাধী হেদায়েত উল্লাহ ওরফে আঞ্জু বিএসসি এবং সোহরাব আলী ওরফে ছোরাপ আলীরে মৃত্যুদণ্ডের যে রায় বুধবার ট্রাইব্যুনালে হয়েছে,  সেই মামলাতেও গণহত্যা অথবা বিকল্প হিসেবে অন্য অপরাধের কথা ছিল। রায়ে ট্রাইব্যুনাল ওই অপরাধকে ‘গণহত্যা’ বিবেচনা করে সাজা ঘোষণা করেছে।

আসামিপক্ষের আইনজীবী গাজি এম এইচ তামিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রণদা প্রসাদ সাহার হত্যাকাণ্ডের ৪৮ বছর পর বিচার হচ্ছে, এটাই সবচেয়ে দুঃখজনক এবং হতাশাজনক বিষয়। কিন্তু আরও দুঃখজনক হচ্ছে তার হত্যার পর কোথাও কোনো থানায় একটি সাধারণ ডায়রি পর্যন্ত হয়নি।”

তামিম বলেন, “এ মামলায় যে কজন সাক্ষ্য দিয়েছেন তারা প্রত্যেকেই বলেছেন আরপি সাহা নিখোঁজ হয়েছেন। তাকে হত্যা করা হয়েছে এ কথা কোনো সাক্ষীই বলেননি। প্রসিকিউশনের একজন প্রত্যক্ষ সাক্ষী ছিলেন। তিনিও ধরে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন। আরপি সাহাকে তিনি চিনতেন না, বলেছেন।

“ফলে এটাই প্রমাণ হয় যে, মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়ে এর বিচার হচ্ছে। আমি মনে করি প্রসিকিউশন আমার মক্কেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি। আমি আমার মক্কেলের খালাস চেয়েছি।”  

 

গত বছর ১২ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলের মাহবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন।

১১ ফেব্রুয়ারি অভিযোগ আমলে নেওয়ার পর ২৮ মার্চ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে তার বিচার শুরুর আদেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল।

এক বছরের বেশি সময় পর বুধবার আসামি পক্ষের যুক্তিতর্ক শেষ হলে ট্রাইব্যুনাল মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখে।

অভিযোগপত্রের তথ্য অনুযায়ী, মাহবুব একসময় জামায়াতে ইসলামীর সমর্থক ছিলেন। তিনি তিনবার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থী হলেও প্রতিবারই পরাজিত হন।

২০১৬ সালের ১৮ এপ্রিল মামলাটির তদন্ত শুরুর পর ট্রাইব্যুনাল থেকে পরোয়ানা জারি হলে ওই বছরের নভেম্বরে মাহবুবকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি এখন গাজীপুরের কাশিমপুরের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আছেন।

২০১৭ সালের ২ নভেম্বর এ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন প্রসিকিউশনে দাখিল করেন তদন্ত কর্মকর্তা মো. আতাউর রহমান।

তার আগে এক সংবাদ সম্মেলনে তদন্ত প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপ তুলে ধরেন তদন্ত সংস্থার প্রধান সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান খান ও জ্যেষ্ঠ সমম্বয়ক সানাউল হক।

হান্নান খান তখন বলেছিলেন, আসামি মাহবুবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ মে মধ্যরাতে নারায়ণগঞ্জের স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ২০-২৫ জন সদস্যকে নিয়ে রণদা প্রসাদ সাহার বাসায় হামলা চালায়।

“তারা রণদা প্রসাদ সাহা, তার ছেলে ভবানী প্রসাদ সাহা, রণদা প্রসাদের ঘনিষ্ঠ সহচর গৌর গোপাল সাহা, রাখাল মতলব ও রণদা প্রসাদ সাহার দারোয়ানসহ ৭ জনকে তুলে নিয়ে হত্যা করে তাদের লাশ শীতলক্ষ্যায় ফেলে দেয়। তাদের লাশ আর পাওয়া যায়নি।”

মানবহিতৈষী কাজে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত থাকায় ব্রিটিশ সরকার রায় বাহাদুর খেতাব দিয়েছিল রণদা প্রসাদ সাহাকে। মানবসেবায় অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ স্বাধীনতার পর ১৯৭১ সালে সরকার তাকে মরণোত্তর স্বাধীনতা পদক দেয়। তিনি আর পি সাহা নামেও পরিচিত।

রণদা প্রসাদ সাহার পৈত্রিক নিবাস ছিল টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে। সেখানে তিনি একাধিক শিক্ষা ও দাতব্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এক সময় নারায়ণগঞ্জে পাটের ব্যবসায় নামেন রণদা প্রসাদ সাহা; থাকতেন নারায়ণগঞ্জের খানপুরের সিরাজদিখানে।

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধের সময় মির্জাপুরের ভারতেশ্বরী হোমসের আশপাশের এলাকা, নারায়ণগঞ্জের খানপুরের কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট ও তার আশপাশের এলাকা এবং টাঙ্গাইল সার্কিট হাউজ এলাকায় অপরাধ সংঘটন করেন আসামি মাহবুব।