বৃহস্পতিবার টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের কুমুদিনী কমপ্লেক্সে এই ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে এ কথা বলেন সরকারপ্রধান।
তিনি বলেন, দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা মানুষের কল্যাণে কাজ করতেন। তিনি এক হাতে যেমন অর্থ আয় করতেন অন্য হাতে সাধারণ মানুষকে তা বিলিয়ে দিতেন। সারা জীবন নির্যাতিত মানুষের কথা তিনি ভেবেছেন।
“আজকে এই কুমুদিনী ট্রাস্ট আমি মনে করি, আমাদের দেশে নারী শিক্ষার প্রসার ঘটানো থেকে শুরু করে মানব সেবার যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, সে দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে আমাদের দেশে অনেক বিত্তশালী আছেন, তারাও করতে পারেন। তাহলে আমাদের দেশের মানুষের আর কোনো কষ্ট থাকবে না।”
কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট অব বেঙ্গল (বিডি) আয়োজিত এ অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হিসেবে প্রধানমন্ত্রী চলতি বছরের রণদা প্রসাদ সাহা স্মারক স্বর্ণপদক বিতরণ করেন।
পাশাপাশি তিনি কুমুদিনী হাসপাতাল ও ভারতেশ্বরী হোমস পরিদর্শন করেন এবং ভারতেশ্বরী হোমসের শিক্ষার্থীদের মনোমুগ্ধকর ডিসপ্লে উপভোগ করেন।
বেলা ১১টার পর হেলিকপ্টারে করে ঢাকা থেকে মির্জাপুরে পৌঁছেই কুমুদিনী কমপ্লেক্স প্রাঙ্গণে পৌঁছেই প্রধানমন্ত্রী ফলক উন্মোচনের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রকল্পের উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের আনুষ্ঠানিকতা সারেন। ছোট বোন শেখ রেহানাও এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন।
সোহরাওয়ার্দীর পক্ষে জাতির জনকের ছোট মেয়ে শেখ রেহানা এবং নজরুলের পক্ষে কবির নাতনী খিলখিল কাজী পদক গ্রহণ করেন।
মানবহিতৈষী কাজে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত থাকায় ব্রিটিশ সরকার রায় বাহাদুর খেতাব দিয়েছিল রণদা প্রসাদ সাহাকে। মানবসেবায় অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে স্বাধীনতার পর ১৯৭১ সালে সরকার তাকে মরণোত্তর স্বাধীনতা পদক দেয়।
রণদা প্রসাদ সাহার পৈত্রিক নিবাস ছিল টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে। কিশোর বয়সে বাড়ি পালিয়ে কলকাতা গিয়ে কুলি, মজুর, ফেরিওয়ালার কাজে কাটে তার প্রথম যৌবন। এক পর্যায়ে স্বদেশী আন্দোলনে জড়িয়ে কারাগারেও যান।
তার চাকরিজীবন শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বেঙ্গল অ্যাম্বুলেন্স কোরের সদস্য হিসেবে যুদ্ধক্ষেত্রে আহত ও অসুস্থদের সেবা দেওয়ার মধ্যে দিয়ে। যুদ্ধ শেষে রেলওয়ের টিকেট কালেক্টরে চাকরি পান তিনি। ১৯৩২ সালে ওই চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার সময় পাওয়া অর্থ দিয়ে শুরু করেন ব্যবসা।
১৯৪০ সালে তিনি নারায়ণগঞ্জে জর্জ অ্যান্ডারসনের পাটের ব্যবসা কিনে নেন। তখন থেকেই নারায়ণগঞ্জের খানপুরের সিরাজদিখানে থাকতে শুরু করেন।
ব্যবসায়ী হিসেবে পাওয়া সাফল্যে প্রথম জীবনের সেবার ধর্ম ভুলে যাননি রণদা প্রসাদ। ১৯৩৮ সালে তিনি মায়ের নামে প্রতিষ্ঠা করেন কুমুদিনী হাসপাতাল। দাদীর নামে গড়ে তোলেন মেয়েদের আবাসিক স্কুল ভারতেশ্বরী হোমস। ১৯৪৩ সালে টাঙ্গাইলে কুমুদিনী কলেজ এং ১৯৪৬ সালে মানিকগঞ্জে বাবার নামে দেবেন্দ্র কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন।
ওই সময় দুর্ভিক্ষের মধ্যে কলকাতা, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে লঙ্গরখানা খুলে দেন রণদা প্রসাদ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে রেডক্রসের তহবিলে বড় অংকের অর্থ সহায়তা দেন। এছাড়া জনস্বার্থে নানা কাজে অর্থ দিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন দানবীর আর পি সাহা।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের ৭ মে পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীর সহযোগীরা কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট থেকে রণদা প্রসাদ সাহা ও তার ছেলে ভবানী প্রসাদ সাহাকে ধরে নিয়ে যায়। পরে তাদের আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি।
কুমুদিনী ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাজিব প্রসাদ সাহাকে ভাই হিসেবে বর্ণনা করে রণদাপ্রসাদ স্মারক স্বর্ণপদক বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “তার জন্য আমার দরজা সব সময় খোলা। যখনই চায়.. তখনই আসতে পারে এবং আসে। আমি তাকে ছোট ভাইয়ের মতই স্নেহ করি… কুমুদিনী ট্রাস্টের জন্য যা যা সহযোগিতা দরকার সে পাবে।”
“স্বজন হারানোর বেদনা নিয়েই কিন্তু আমার যাত্রা শুরু। আমি বাবা মা ভাই সব হারিয়ে এই মাটিতে যখন ফিরে আসি তখন চারদিকে শুধু অন্ধকার। একটাই আলোকবর্তিকা পেয়েছিলাম- বাংলাদেশের জনগণ। এই জনগণের ভালোবাসা পেয়েছি, জনগণের আস্থা পেয়েছি।”
অন্যদের মধ্যে কুমুদিনী ট্রাস্টের পরিচালক ভাষা সৈনিক প্রতিভা মুৎসুদ্দি, কুমুদিনী উইমেন্স মেডিকেল কলেজের শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক এম এ জলিল, কুমুদিনী উইমেন্স মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ আব্দুল হালিম, ভারতেশ্বরী হোমসের অধ্যক্ষ মো. আনোয়ারুল হক উপস্থিত ছিলেন এ অনুষ্ঠানে।