বাসচাপায় আরেক শিক্ষার্থীর মৃত্যু ঢাকার সড়কের অনিরাপদ চিত্র আবার তুলে ধরল।
Published : 19 Mar 2019, 10:36 PM
ঢাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় শিক্ষার্থীর মৃত্যু, সড়ক অবরোধ
মেয়রের আশ্বাসেও সরেনি শিক্ষার্থীরা, বাসে আগুন
নদ্দার বিক্ষোভে ভিপি নূর, মেনে নেয়নি একপক্ষ
মঙ্গলবার সকালে বারিধারার পাশে নদ্দায় বাসের চাপায় এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর মৃত্যুর পর সারাদিন বিক্ষোভ করে তার সহপাঠিরা। ফলে প্রগতি সরণিতে গাড়ি চলাচল হয় বিঘ্নিত।
নিহত ছাত্র বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের সহপাঠিদের পাশাপাশি আশপাশের কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও ছিল এই বিক্ষোভে: তাদের সঙ্গে সংহতি জানাতে যান ডাকসুর নবনির্বাচিত ভিপি নুরুল হক নুরও।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম গিয়ে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের মানাতে না পারলেও তারা সন্ধ্যায় নিজেরাই সড়ক ছেড়ে যায়। তবে বুধবার সকালে আবার অবস্থান নেওয়ার ঘোষণা দিয়ে গেছে তারা।
এদিকে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রভাত পরিবহনের ওই বাসটির নিবন্ধন সাময়িকভাবে বাতিল করেছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ-বিআরটিএ।
এই বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রের মৃত্যুর জন্য চালকের বেপরোয়া চালনাকেই দায়ী করেছে বিআরটিএ। বাসচালককে সঙ্গে সঙ্গে আটকের কথা জানিয়েছে পুলিশ।
গত বছর বাসের চাপায় রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর পর শিক্ষার্থীদের নজিরবিহীন আন্দোলনের পর নানা পদক্ষেপ নেওয়া হলেও সড়কে মৃত্যুর মিছিল থেমে নেই।
এর ধারাবাহিকতায় রাজধানীতে ট্রাফিক সপ্তাহ চলার মধ্যেই মঙ্গলবার নিহত হলেন বিইউপির শিক্ষার্থী আবরার আহমেদ চৌধুরী (২০)। তিনি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে প্রথম বর্ষে পড়তেন।
ডিএমপির সহকারী পুলিশ কমিশনার মামুন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, যমুনা ফিউচার পার্কের সামনের রাস্তার সুপ্রভাত পরিবহনের উত্তরাগামী একটি বাস আবরারকে চাপা দেয়। এতে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়।
আবরারের সহপাঠী ইফতেখার আজম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সকাল সাড়ে ৮টার ক্লাস ধরার জন্য আবরার বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে উঠতে বসুন্ধরা গেইটে এসেছিল। সাড়ে ৭টার দিকে সে যখন রাস্তা পার হচ্ছিল, সুপ্রভাত পরিবহনের একটি বাস তাকে চাপা দেয়।”
চালক বাস ফেলে পালানোর চেষ্টার সময় তাকে আটক করা হয় বলে জানান পুলিশ কর্মকর্তা মামুন।
জোহরের নামাজের মিরপুর সেনানিবাসে বিইউপি ক্যাম্পাসে আবরারের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। পরে তাকে বনানী সামরিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।
সহপাঠী ইফতেখার আজম বলেন, “আবরার খুব পড়ুয়া ছিল। লেখাপড়ার প্রতি ছিল তার দারুণ ঝোঁক। সে এমন করে চলে যাবে, এটা আমরা ভাবতেও পারিনি।”
বিইউপির অতিরিক্ত পরিচালক (জনসংযোগ) মো. জাহাঙ্গীর কবির সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, এই ঘটনায় পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
যান চলাচল বন্ধে দুর্ভোগ
সকাল সোয়া ৭টার দিকে আবরারের নিহত হওয়ার খবর পাওয়ার পর ক্যাম্পাস থেকে দলে দলে এসে যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে প্রগতি সরণিতে অবস্থান নেয় শিক্ষার্থীরা। দোষি চালকের শাস্তির দাবিতে স্লোগান দিতে থাকে তারা।
সহপাঠী আজম বলেন, আবরারের সঙ্গে থাকা তাদের এক সহপাঠি ঘটনার পর ফোন করে তাদের খবর দেয়।
তাদের অবরোধের কারণে বাড্ডা-নতুনবাজার থেকে কুড়িলের পথে দুই দিকেই যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
উত্তেজিত শিক্ষার্থীরা এ সময় কয়েকটি যানবাহন ভাংচুর করে।
পুলিশ গিয়ে শিক্ষার্থীদের সরাতে না পেরে নতুন বাজার থেকে বিমানবন্দরগামী গাড়িগুলোকে প্রগতি সরণির কোকাকোলা মোড় থেকে ঘুরিয়ে দেয়। কুড়িল থেকেও নতুন বাজারের দিকে গাড়ি চলেনি।
গুরুত্বপূর্ণ এই সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে পড়ায় দুর্ভোগে পড়ে হাজারো মানুষ। হেঁটেই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয় অনেককে।
মেয়র বিফল
বিক্ষোভের এক পর্যায়ে সকাল ১০টার দিকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের নতুন মেয়র আতিকুল ইসলাম সেখানে উপস্থিত হন।
এসময় শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে কিছু দাবি তুলে ধরা হয় তাকে। এর মধ্যে রয়েছে- আবরারকে চাপা দেওয়া বাসের চালককে ১০ দিনের মধ্যে ফাঁসি দিতে হবে, সুপ্রভাত বাসের রুট পারমিট বাতিল করতে হবে, সিটিং সার্ভিস বন্ধ করতে হবে, চালকদের ছবি ও লাইসেন্স গাড়িতে ঝোলানোর ব্যবস্থা করতে হবে, বসুন্ধরা গেইটে ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ করতে হবে, প্রতিটি জেব্রা ক্রসিংয়ে সিসি ক্যামেরা বসাতে হবে, ট্রাফিক পুলিশের দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে।
শিক্ষার্থীদের দাবি শুনে আতিকুল বলেন, “৭ দিন হল আমি দায়িত্ব নিয়েছি। আমি মেয়র নই, ভাই হিসেবে বলছি আমাকে সময় দেন।”
শিক্ষার্থীদের দাবিগুলোর যৌক্তিকতা স্বীকার করে তিনি বলেন, “তোমরা আমার সাথে থাকলে আমি সব সমস্যার সমাধান করে ফেলব। বাসের মালিক ও সংশ্লিষ্টদের নিয়মের ভেতরে আনা হবে। ঢাকা সিটিতে ছয়টি কোম্পানির বাস চালানো হবে। আমি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে সমাধান করব।”
সুপ্রভাত বাসের চালকের বিরুদ্ধে আইন অনুয়ায়ী ব্যবস্থা নেওয়ারও আশ্বাস দেন তিনি। দুই-তিন মাসের মধ্যে নিহত আবরারের নামে বসুন্ধরা গেইটে ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণের কথাও তিনি দেন।
এরপর মেয়র রাস্তা ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ করলে শিক্ষার্থীরা উত্তেজিত হয়ে ওঠে। তাদের তোপের মুখে এক পর্যায়ে সেখান থেকে চলে যান মেয়র।
তিনি চলে যাওয়ার পর বেলা সাড়ে ১২টার দিকে সুপ্রভাত পরিবহনের একটি বাসে আগুন দেওয়া হয়। আর সড়ক আটকে বিক্ষোভও চলতে থাকে।
নুরও তোপে
বিকাল পৌনে ৫টার দিকে সেখানে উপস্থিত হন ডাকসুর নবনির্বাচিত ভিপি নুরুল হক নুর। কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতা নুরের সঙ্গে আরেক নেতা রাশেদ খানও ছিলেন।
বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার প্রধান গেইটে জেব্রা ক্রসিংয়ের যে জায়গায় আবরার নিহত হন, সেখানে নূর যেতে চাইলে আন্দোলনকারীদের একটি পক্ষ তাকে বাধা দেয়।
এ সময় নূরকে উদ্দেশ করে তারা ‘চলে যান, চলে যান’ ও ‘ভুয়া-ভুয়া’ বলে রব তোলে।
ওই স্লোগানের মধ্যেই মিনিট দুয়েক সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন নূর ও রাশেদ। পরে আন্দোলনকারীদেরই আরেকপক্ষ সেখান থেকে নূর ও রাশেদকে বের করে নিয়ে যান।
নূর আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলেন, “আপনাদের ওপর দায় চাপানোর চেষ্টা করা হবে। আপনারা সচেতন থাকবেন। আপনারা আপনাদের আন্দোলন করবেন। কোনো প্রয়োজন হলে আমাদের জানাবেন। আমরা আপনাদের সাথে আছি।”
আন্দোলনরতদের নিয়ে কোনো ‘কূটকৌশল’ হলে ছাত্রসমাজ তার ‘দাঁতভাঙা জবাব দেবে’ বলেও হুঁশিয়ারি দেন ডাকসুর ভিপি। এর আগে কোটাবিরোধীসহ শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন আন্দোলন থামাতে সরকারের নেওয়া পদক্ষেপের কঠোর সমালোচনাও করেন তিনি।
গত বছর অগাস্টে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় রাজধানীর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের উপর হামলাকারীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর দাবি জানান নূর।
তিনি বলেন, “যখনই সড়কে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে, একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। আমাদের সামনে কোনো তথাকথিত তদন্ত কমিটি চাই না।”
নূর সেখান থেকে চলে আসার পর আন্দোলনকারীদের একজন ফয়সাল এনায়েত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নিশ্চয়ই আমরা তার (নুর) সাথে কথা বলব। তিনি চাইলেই আসতে পারেন।”
বিক্ষোভেও দ্বন্দ্ব
সড়কে দিনভর অবস্থান নিয়ে কয়েকশ শিক্ষার্থী বিক্ষোভ করলেও তাদের কোনো সংগঠিত কার্যক্রম দেখা যায়নি। মাঝে নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বে জড়াতেও দেখা গেছে।
বিক্ষোভকারীদের একটি অংশ আরও কিছু স্থানে অবস্থানের সিদ্ধান্ত নিলে আরেক পক্ষ তার বিরোধিতা করে। সারা দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিক্ষোভের ডাক দেওয়া নিয়েও দেখা দেয় দ্বন্দ্ব।
১০ ঘণ্টা অবস্থানের পর সন্ধ্যা ৬টার দিকে সড়ক ছাড়ার সময় শিক্ষার্থীদের মধ্যে কয়েকজনকে বলতে শোনা যায়, একটি পক্ষ এই আন্দোলনকে ‘ঘুরিয়ে দিতে চাইছে’।
বিইউপির রেজিস্ট্রার মো. মাহবুব সারওয়ার সকালে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলেন, “দাবি মেনে নিতে সরকারকে কিছুটা সময় দাও। জনভোগান্তির কথা মাথায় রেখে তোমরা সড়ক ছেড়ে দাও। ক্যাম্পাসে চল।”
শিক্ষার্থীরা তখন সমস্বরে জানান, তারা কেউ সড়ক ছেড়ে যাবেন না। রেজিস্ট্রার চলে যাওয়ার পর শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকে।
বেলা ১২টা পরযন্ত শুধু বিইউপির শিক্ষার্থীরা থাকলেও এরপর নর্থ সাউথ, ইনডিপেন্ডেন্ট, ইস্ট ওয়েস্ট, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ও পাইওনিয়ার ডেন্টাল কলেজের শিক্ষার্থীরা এই বিক্ষোভে যোগ দেয়।
এরপর হঠাৎ করে সুপ্রভাত পরিবহনের একটি বাসে আগুন দেওয়া হয়। বাসে আগুন দেওয়াকে কেন্দ্র করে একদল সন্দেহভাজন একজনকে ধরে আনার দাবি করলে আরেকটি দল এসে তাকে ছিনিয়ে নেয়।
এই সময় দুই পক্ষকে হাতাহাতিতে লিপ্ত হতে দেখা যায়।
আন্দোলনকারীদের একটি পক্ষ তখন বিমানবন্দর সড়কে গিয়ে অবরোধের আহ্বান জানালে আরেকটি পক্ষ এসে তাদের সঙ্গে তর্কে জড়ায়।
এসময় সড়ক বিভাজকের উপর আন্দোলনের অস্থায়ী মঞ্চে উঠে অনিক হাসান নামে এক শিক্ষার্থী ঘোষণা দেন, তাদের মধ্যে থেকে সাতজন প্রতিনিধি মেয়র আতিকুল ইসলামের সঙ্গে দেখা করতে যাবেন।
এসময় নারী শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে আসে বিরোধিতা। তারা বলেন, এখানে ‘আমরা সবাই রিপ্রেজেন্টেটিভ’।
বেলা ৩টার দিকে আন্দোলনকারীদের তিনজন ‘সম্মিলিত ছাত্র সমাজের প্রতিনিধি’ হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিয়ে বলেন, বিক্ষোভ বিকাল ৪টা পর্যন্ত চলবে।
তাদের একজন বুধবার দেশের স্কুল-কলেজে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের আহ্বান জানান।
এসময় আন্দোলনকারীদের বড় অংশ সড়ক ছেড়ে না ওঠার কথা জানায় স্লোগানে।
বড় দলটি টানা অবরোধের সিদ্ধান্ত নিতে গেলে আরেক অংশের সঙ্গে তাদের হাতাহাতি হয়। এসময় কেউ কেউ বাস ভাংচুর করলে অন্য শিক্ষার্থীরা এগিয়ে গিয়ে তাদের এলাকাছাড়া করে।
হাতাহাতির দৃশ্যধারণ করতে গেলে তারা সাংবাদিকদেরও বাধা দেয়।
পরে ফয়সাল এনায়েত নামে এক শিক্ষার্থী এগিয়ে এসে বলেন, “আমাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি হলে অন্য একটি পক্ষ এর সুবিধা নেবে। সবাই এক থাকি।”
পরে তিনিসহ আরও কজন শিক্ষার্থী বৈঠকে বসেন। এরপর অস্থায়ী মঞ্চে উঠে মাইশা নূর ঘোষণা দেন, সন্ধ্যা ৬টায় তারা সড়ক অবরোধ তুলে নিচ্ছেন। তবে বুধবার সকাল ৮টা থেকে একই স্থানে অবস্থান নেবেন তারা।
তিনি প্রশাসনের কাছে শিক্ষার্থীদের সুরক্ষার দাবি জানিয়ে বলেন, “আমাদের আন্দোলন কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন নয়। আমাদের উপর যেন কোনো আক্রমণ না হয়, সেজন্য আমরা পুলিশের কাছে সুরক্ষা দাবি করছি।”
এসময় শিক্ষার্থীদের মধ্যে একজন বলেন, “কাল আন্দোলন কিভাবে চলবে? দাবিগুলো কিভাবে আদায় করব, এ নিয়ে সুস্পষ্ট কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি আমাদের। কোন দিকে যাবে আন্দোলন, জানি না।”
এদিকে রাতে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় স্টুডেন্ট এলায়েন্সের ফেইসবুক পেইজ থেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিজ ক্যাম্পাসের সামনে অবস্থান নিতে বলা হয়েছে।