নিম্ন আদালতে দুই বছরের বেশি সাজা হলে আপিল বিচারাধীন থাকা অবস্থায় কোনো ব্যক্তি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না বলে জানিয়েছে হাই কোর্ট।
Published : 27 Nov 2018, 11:33 AM
দুর্নীতির দায়ে বিচারকি আদালতের দেওয়া দণ্ড ও সাজা (কনভিকশন অ্যান্ড সেন্টেন্স) স্থগিত চেয়ে আমান উল্লাহ আমানসহ বিএনপির পাঁচ নেতার করা আবেদন খারিজের রায়ে মঙ্গলবার এই পর্যবেক্ষণ আসে।
বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি কে এম হাফিজুল আলমের হাই কোর্ট বেঞ্চ মঙ্গলবার এ সিদ্ধান্ত দেয়।
আদালত পর্যবেক্ষণে বলেছে, সংবিধানের ৬৬ (২) (ঘ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কারও দুই বছরের বেশি সাজা বা দণ্ড হলে সেই দণ্ড বা সাজার বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল বিচারাধীন থাকা অবস্থায় তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না, যতক্ষণ না আপিলে ওই দণ্ড বাতিল বা স্থগিত হয়।
বিএনপি নেতা আমান উলাহ আমান, ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন, ওয়াদুদ ভূঁইয়া, মো. মশিউর রহমান ও মো. আব্দুল ওহাবের পক্ষে দণ্ড ও সাজা বাতিলের ওই আবেদন করা হয়েছিল।
আদালতের এই আদেশের ফলে দুই দুর্নীতি মামলায় ১৭ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পথও আটকে গেল।
সংবিধানের ৬৬ (২) (ঘ) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে কেউ অন্যুন দুই বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলে মুক্তির পর পাঁচ বছর পর্যন্ত তিনি সাংসদ নির্বাচিত হওয়ার যোগ্য বিবেচিত হবেন না।
বিএনপি নেতারা আশা করছিলেন, বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে এবং উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে অতীতে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার নজির থাকায় তারাও একইভাবে আসন্ন একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন।
কিন্তু মঙ্গলবার বিএনপির পাঁচ নেতার আবেদন খারিজের রায়ের সঙ্গে হাই কোর্টের দেওয়া পর্যবেক্ষণে সেই পথ বন্ধ হয়ে গেল বলে জানিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা।
অন্যদিকে বিএনপি নেতাদের আইনজীবীরা বলেছেন, তারা হাই কোর্টের এই আদেশের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ আদালতে যাবেন।
সাবেক প্রতিমন্ত্রী আমান উল্লাহ আমানের পক্ষে হাই কোর্টে শুনানি করেন আইনজীবী জাহিদুল ইসলাম। ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেনের পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ, আহসানুল করীম ও খায়রুল আলম চৌধুরী ।
ওয়াদুদ ভুঁইয়া ও আব্দুল ওহাবের পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার রফিক-উল-হক, ও ব্যারিস্টার একেএম ফখরুল ইসলাম। মশিউর রহমানের পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার আমিনুল হক ও ব্যারিস্টার মাহবুব শফিক।
অন্যদিকে দুদকের পক্ষে মো. খুরশীদ আলম খান এবং রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল একেএম আমিন উদ্দিন মানিক আদালতে ছিলেন।
জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন, সম্পদের তথ্য গোপনের মামলায় আমান উল্লাহ আমানকে ২০০৭ সালে ১৩ বছরের কারাদণ্ড দেয় বিশেষ জজ আদালত। হাই কোর্টে একবার ওই রায় বাতিল হলেও ২০১৪ সালে আপিল বিভাগ হাই কোর্টের রায় বাতিল করে পুনর্বিচারের আদেশ দেয়।
জরুরি অবস্থার মধ্যে একই ধরনের অভিযোগে খাগড়াছড়ি জেলা বিএনপির সভাপতি সাবেক এমপি ওয়াদুদ ভূঁইয়াকে ২০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও ১০ হাজার টাকা জরিমানা করেছিল চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্পেশাল জজ আদালত। ওই রায়ের পর ২০০৯ সালে হাই কোর্টে আপিল করে জামিন পান তিনি।
বিএনপি সমর্থক চিকিৎসকদের নেতা এজেডএম জাহিদ হোসেনের ১৩ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও ১০ লাখ টাকা জরিমানার রায় হয়েছিল ২০০৮ সালের ২৫ মে। ঢাকার ৬ নম্বর বিশেষ জজ আদালতের ওই রায়ের পর ২০০৯ সলের ৩ জুন তিনি হাই কোর্টে আপিল করে জামিন পান।
বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা ঝিনাইদহ-১ আসনের সাবেক সাংসদ মো. আব্দুল ওহাবের সাজার রায় আসে ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর। জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও তথ্য গোপনের অভিযোগে যশোরের বিশেষ জজ আদালত তাকে ৮ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও ত্রিশ হাজার টাকা জরিমানা করে। ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে গতবছর ৬ ডিসেম্বর তিনি জামিন পান।
একই ধরনের অভিযোগে ২০১৭ সালের অক্টোবরে ঝিনাইদহ-২ আসনের সাবেক সাংসদ বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মশিউর রহমানকে ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয় যশোরের বিশেষ জজ আদালত। মশিউরও পরে আপিল করে হাই কোর্ট থেকে জামিন নেন।
আদেশের পর দুদকের আইনজীবী বলেন, পাঁচ বিএনপি নেতার আপিল বিচারাধীন থাকা অবস্থায় পাঁচটি আবেদন করা হয়েছিল, যার মূল বিষয় ছিল দণ্ড স্থগিত করা। শুনানি করে আদালত তা খারিজ করে দিয়েছে।
“মূলত একটাই কারণ, সেটা হল সংবিধানের ৬৬(২) এর (ঘ) ধারায় যে বিধান দেওয়া আছে, আদালত বলেছে সেটা সুপ্রিম ল অব দ্য কান্ট্রি। কাজেই ফৌজদারি কার্যবিধিতে কনভিকশন স্টে করার কোনো বিধান নাই। সাসপেন্ডের বিধান থাক আর না থাক, সংবিধান দেশের সর্বোচ্চ আইন হিসেবে প্রাধান্য পাবে।
“সুতরাং অনুচ্ছেদ ৬৬(২) এর (ঘ) অনুযায়ী উনারা নির্বাচন করার যোগ্য নন এবং দণ্ড স্থগিত চাওয়ার কোনো এখতিয়ার রাখেন না। এ কারণে উনাদের দরখাস্ত খারিজ করে দিয়েছে।”
খুরশীদ আলম খান বলেন, আদালত আরও কিছু পর্যবেক্ষণ দিয়েছে, যা মূল রায় পেলে বিস্তারিত জানা যাবে।
“দুর্নীতির অভিযোগ মাথায় নিয়ে সংসদ নির্বাচনে অ্যাটেন্ড করা এবং ক্ষমতায় যাওয়া- আদালত এগুলো ডিসকারেজ করেছে। বলেছে, দুর্নীতি এমন একটা ব্যপার যে, এ বিষয়ে আমাদের সবার সজাগ থাকা উচিৎ। কাজেই কনভিকশন মাথায় নিয়ে সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়া সংবিধানের মূল স্পিরিটের পরিপন্থি। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪২৬ ধারায় যাই থাকুক না কেন, সংবিধান সবার উপরে প্রযোজ্য।”
এক প্রশ্নের জবাবে খুরশীদ আলম বলেন, “এখন পর্যন্ত হাই কোর্ট বিভাগ যে ব্যাখ্যা দিয়েছে, সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এটা নির্বাচন কমিশনের জন্য বাইন্ডিং। আজকে যে পর্যবেক্ষণ দিয়েছে তার বাইরে যাওয়ার এখতিয়ার নির্বাচন কমিশনের আইনে নেই।”
এই রায়ের পর বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ থাকছে কি না জানতে চাইলে দুদকের আইনজীবী বলেন, “একদম থাকছে না। একথা তো আমি আগেই বলেছি। উনি সম্পূর্ণ খালাস পেলে অথবা দণ্ড বাতিল হয়ে গেছে, তখন উনি পারবেন। আজকের আদেশে এটা আরও স্পষ্ট হল।”
তিনি বলেন, হাই কোর্টের এই আদেশ সবার ওপরই প্রযোজ্য হবে এবং নির্বাচন কমিশনও এর বাইরে কোনো আদেশ দিতে পারবে না।
আসামিপক্ষের আইনজীবী ব্যারিস্টার খায়রুল আলম চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, হাই কোর্টে সাজা ও দণ্ড স্থগিতের আবেদন করার উদ্দেশ্য ছিল, যাতে তাদের নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন।
“আদালত বলেছে, দুটি গ্রাউন্ডে এ আবেদন ‘বিবেচনার যোগ্য নয়’। একটি হল, ফৌজদারি কার্যবিধির ৪২৬ ধারা অনুযায়ী সেনটেনস (সাজা) স্থগিত করা যায়, কিন্তু কিনভিকশন (দোষী সাব্যস্ত করা) স্থগিত করা যায় না। দ্বিতীয় গ্রাউন্ড হল- সংবিধানের ৬৬ (২) (ঘ) অনুচ্ছেদে বলা আছে, সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তি নির্বাচন করতে পারবে না।
“কিন্তু এর আগেও আমরা ভারতসহ বিভিন্ন দেশের নজির দেখিয়েছি। যেখানে সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তি নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। এ আদেশের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ আদালতে আপিল দায়ের করা হবে।”