অনিয়মে ধুঁকতে থাকা ফারমার্স ব্যাংকের অডিট কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান বাবুল চিশতীকে গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হেফাজতে নিয়েছে পুলিশ।
Published : 10 Apr 2018, 03:18 PM
ঋণ কেলেঙ্কারির এক মামলায় মঙ্গলবার বাবুলের সঙ্গে তার ছেলে রাশেদুল হক চিশতী, ফারমার্স ব্যাংকের জ্যেষ্ঠ ভাইস প্রেসিডেন্ট জিয়া উদ্দিন আহমেদ ও ফার্স্ট প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ মাসুদুর রহমান খানকেও গ্রেপ্তার করা হয়।
মামলার বাদী দুদকের উপ-পরিচালক মো. সামছুল আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বেলা আড়াইটার দিকে দুদকের পরিচালক কাজী শফিকুল আলমের নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল সেগুন বাগিচার জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ভবনের সামনে থেকে তাদের গ্রেপ্তার করে।
জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যাংকটির ‘কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের পর’ বাবুলসহ আসামিরা বিদেশে পালিয়ে যেতে পারেন বলে আশঙ্কা ছিল দুদকের। সেজন্য তাদের দেশত্যাগ ঠেকাতে ব্যবস্থা নিতে সরকারকে চিঠিও দেওয়া হয়েছিল।
জামালপুরের বকশীগঞ্জের মাহবুবুল হক চিশতীর (বাবুল চিশতী নামেই পরিচিত) সামান্য অবস্থা থেকে এই পর্যায়ে উঠে আসা নিয়েও রয়েছে নানা আলোচনা।
আওয়ামী লীগের এমপি মহীউদ্দীন খান আলমগীর চার বছর আগে ফারমার্স ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করলে একজন পরিচালক হন বাবুল চিশতী। হন অডিটি কমিটির চেয়ারম্যানও। ঋণ কেলেঙ্কারি নিয়ে চাপের মুখে মহীউদ্দীন আলমগীর চেয়ারম্যানের দায়িত্ব ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাবুলকেও পদত্যাগ করতে হয়।
গ্রেপ্তারের পর বাবুল চিশতী সাংবাদিকদের বলেন, “আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে, এখন তারা (দুদক) ডেকেছে, আমরাও এসেছি। তদন্ত চলছে দেখা যাক কী হয়।"
ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনায় এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “একটি ব্যাংকে এককভাবে একজন পরিচালকের কিছু করার নেই।”
গ্রেপ্তার বাবুল চিশতীসহ অন্য তিনজনকে বিকালে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিন হেফাজতের আবেদন করেন দুদক কর্মকর্তা শামছুল আলম।
শুনানি শেষে মহানগর হাকিম মো. গোলাম নবী বাবুল চিশতীকে পাঁচ দিন এবং অন্য তিনজনকে চার দিন রিমান্ডের আদেশ দেন।
আসামিদের পক্ষে জামিন চেয়ে তাদের আইনজীবী মো. মাহফুজ মিয়া বলেন, “রিমান্ডের আবেদন ও এজাহারে ২৫টি হিসাব তহবিলেরই স্পষ্ট বিবরণ রয়েছে। কোনো নতুন তথ্যের দরকার নেই। সুতরাং তাদের হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদেরও প্রয়োজন নেই।”
ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তি হিসেবে বাবুল চিশতী জামিন পেতে পারেন বলেও আবেদনে উল্লেখ করেন অ্যাডভোকেট মাহফুজ।
দুদকের আইনজীবী মাহমুদ হাসান জাহাঙ্গীর জামিনের বিরোধিতা করে বলেন, “এটি একটি আলোচিত মামলা। ঋণ দিয়ে এর বিপরীতে পরস্পর যোগসাজশে উৎকোচ গ্রহণ করে সে টাকা পাচারের মাধ্যমে আত্মসাত করেন আসামিরা।”
শুনানির সময় আসামি পক্ষের আইনজীবী বিচারকের প্রশ্নে স্বীকার করেন, রাশেদুলও ব্যাংকের একজন শেয়ার হোল্ডার।
দুদকের আইনজীবী বলেন, “আরও তথ্য উদ্ধারের জন্য তাদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ জরুরি। তারা অত্যন্ত প্রভাবশালী। জামিন পেলে তারা মামলার আলামত নষ্ট করে তদন্তে বিঘ্ন ঘটাবে।”
এরপর বিচারক আসামিদের জামিনের আবেদন নাকচ করে রিমান্ডের আদেশ দেন।
মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের ৪ ধারার গুলশান থানায় দুদকের করা এই মামলায় বাবুল চিশতীর স্ত্রী রুজী চিশতী এবং ফারমার্স ব্যাংকের এসইভিপি ও গুলশান শাখার সাবেক ব্যবস্থাপক দেলোয়ার হোসেনও আসামি।
এজাহারে বলা হয়, ফারমার্স ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় ক্ষমতার অপব্যবহার করে মাধ্যমে ব্যাংকিং নিয়মের তোয়াক্কা না করে বাবুল চিশতী ব্যাংকটির গুলশান শাখায় একটি সঞ্চয়ী হিসাবে বিপুল পরিমাণ অর্থ জমা ও উত্তোলন করেন।
এরপর বিভিন্ন সময়ে বাবুল চিশতী তার স্ত্রী, ছেলে, মেয়েদের ও তাদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের নামে বিভিন্ন শাখায় থাকা মোট ২৫টি হিসাবে অর্থ নগদ ও পে অর্ডারের মাধ্যমে বিভিন্ন সময় ১৫৯ কোটি ৯৫ লাখ ৪৯ হাজার ৬৪২ টাকার ‘সন্দেহজনক’ লেনদেন করেছেন।
‘সন্দেহজনক’ যেসব লেনদেন
>> ২০১৩ সালের ৪ নভেম্বর প্রাইম ব্যাংকের গুলশান শাখার এক গ্রাহকের হিসাব থেকে ৫০ লাখ টাকা ট্রান্সফার করে ফারমার্স ব্যাংক গুলশান শাখায় বাবুল চিশতীর হিসাবে পে-অর্ডার করা।
>> ২০১৩ সালের ৮ ডিসেম্বর ফারমার্স ব্যাংকের জামালপুরের বকশীগঞ্জ শাখায় বাবুলের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট একটি প্রতিষ্ঠানের হিসাব থেকে ২০ লাখ টাকা পে-অর্ডারে স্থানান্তর।
>> বকশীগঞ্জ শাখায় বাবুল চিশতীর হিসাব নম্বরে নগদ ছয় কোটি ৮১ লাখ ৮৮ হাজার টাকা জমা পাওয়া যায়; সেই বিষয়ে ব্যাংক কর্মকর্তারা বাংলাদেশ ব্যাংকে ‘সাসপিশিয়াস ট্রান্সেকশন রিপোর্ট’ প্রদান করেনি।
>> ২০১৪ সালের ৮ জানুয়ারি ব্যাংকটির গুলশান শাখার গ্রাহক ‘সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেডের’ চলতি হিসাব থেকে দুই কোটি টাকা বাবুল চিশতীর সঞ্চয়ী হিসাবে স্থানান্তর।
>> বাবুল চিশতীর ছেলে রাশেদুল হক চিশতীর নামে গুলশান শাখায় তিনটি মেয়াদী আমানত হিসাবে ৫৫ লাখ টাকা পাওয়া যায়। পরে ২০১৪ সালের ২৯ জানুয়ারি আমানতের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই ওই টাকা বাবুলের নামে পে-অর্ডার।
>> এছাড়া বাবুল চিশতী ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে বিভিন্ন সময়ে এক কোটি ৩৪ লাখ ৮৫ হাজার টাকার আটটি পে-অর্ডার।
>> বাবুল চিশতীর মালিকানাধীন মেসার্স রাশেদ এন্টারপ্রাইজের নামে ব্যাংকটির গুলশান শাখা হতে বিভিন্ন সময় এক কোটি ৮০ লাখ ৮৪ হাজার টাকার ১৬টি পে-অর্ডার।
>> ২০১৩ সালের ১৮ নভেম্বর থেকে চলতি বছরের ৩০ জানুয়ারি সময়ের মধ্যে ফারমার্স ব্যাংকের বকশীগঞ্জ শাখায় ‘বকশীগঞ্জ স্পিনার্স লিমিটেডের’ হিসাব নম্বরে ১৩৮ কোটি ৮২ লাখ ৯২ হাজার ৬৪২ টাকা জমা এবং নগদে উত্তোলন।
>> ২০১৭ সালের ৭ মার্চ বাবুল চিশতীর ভাই মাজেদুল হক ওরফে শামীম চিশতীর এক আত্মীয়র দ্বারা পরিচালিত একটি প্রতিষ্ঠানের ঋণ হিসাব থেকে ১৫ লাখ টাকা তাদের হিসাবে স্থানান্তর করা হয়; পরে এই টাকা বাবুলের নামে ব্যাংকের শেয়ার ক্রয় দেখিয়ে আরেকজনকে পে-অর্ডার।
>> ২০১৭ সালের ২৫ মে বাবুল চিশতী ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে ব্যাংকের শেয়ার ক্রয় মূল্য বাবদ তৎকালীন পরিচালক মোরশেদ মুরাদ ইব্রাহিমকে দুই কোটি ৮৫ লাখ টাকার পে-অর্ডার।
>> ২০১৭ সালের ১৯ মার্চ এক ঋণ গ্রহীতার হিসাব থেকে আড়াই কোটি টাকা স্থানান্তর করে বাবুল ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে ক্রয় করা শেয়ারের মূল্য পরিশোধ।
>> একই তারিখে বাবুল ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে শেয়ারের মূল্য পরিশোধ বাবদ শেয়ার বিক্রেতা ‘রুমি আক্তারের’ নামে ৪০ লাখ টাকার পে-অর্ডার।
>> ওই একই তারিখে অন্য এক ঋণ গ্রহীতার হিসাব থেকে নগদ উত্তোলন দেখিয়ে বাবুল ব্যাংকের পরিচালক মো. শরিফ চৌধুরীকে দুই কোটি টাকার পে-অর্ডার।