মুক্তমনাদের হত্যার বিচার না হওয়ায় এখন অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল আক্রান্ত হয়েছেন মন্তব্য করে এরজন্য প্রধানমন্ত্রীর আশপাশের ‘কিছু মানুষকে’ দুষছেন অধিকারকর্মী সুলতানা কামাল।
Published : 04 Mar 2018, 09:28 PM
তিনি বলেছেন, “প্রধানমন্ত্রীর চারপাশে এখনও পাকিস্তানি প্রেতাত্মারা রয়ে গেছে, যারা তাকে লক্ষ্যচ্যুত করতে প্রস্তুত।
“দীর্ঘদিন ধরে তাদের প্রতি নতজানু হওয়ার ফলে, তাদের অন্যায়ের কোনো বিচার না হওয়ার ফলে, তারা যে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে সেটার বিচার না হওয়ার ফলে জাফর ইকবালের মতো অত্যন্ত সৎ, নিরপেক্ষ মানুষকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে।”
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অভিজিৎ রায়, অনন্ত বিজয় দাশ, নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় নীলয়, ওয়াশিকুর বাবুসহ অনেক লেখক-ব্লগার, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট, অধিকারকর্মী ও ভিন্ন মতাবলম্বী খুন হলেও তার একটিরও বিচার হয়নি।
একের পর এক জঙ্গি হামলার প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে এ বিষয়ে উদাসীনতার অভিযোগ করে আসছিলেন বিভিন্ন নাগরিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা। এরমধ্যে পুলিশের উপস্থিতিতে অধ্যাপক জাফর ইকবালের ওপর এই হামলা নতুন করে নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করেছে অনেকের মধ্যে।
অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে উচ্চকণ্ঠ জাফর ইকবালের ওপর হামলার প্রতিবাদে রোববার দ্বিতীয় দিনের মতো বিক্ষোভ মিছিল, প্রতিবাদ সমাবেশসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছে গণজাগরণ মঞ্চসহ বিভিন্ন সংগঠন।
এসব কর্মসূচি থেকে বিক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখানোর পাশাপাশি তার উপর হামলার বিচারের মাধ্যমে দেশে এসব ঘটনার বিচার হয়, এমন দৃষ্টান্ত তৈরির আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
“আমাদের দাবি থাকবে আজকে, এখান থেকে শুরু হোক- আর কোনো হত্যাকাণ্ড ঘটবে না এবং যে হত্যাকাণ্ড হয়েছে, প্রত্যেকটি ঘটনা বিচারের আওতায় নিয়ে আসা হবে।”
বিকাল ৪টায় শাহবাগ থেকে শুরু হয় যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চের বিক্ষোভ মিছিল, যে মঞ্চের আন্দোলনে শুরু থেকে সক্রিয় ছিলেন অধ্যাপক জাফর ইকবাল।
বিক্ষোভ মিছিলটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি ঘুরে আবার শাহবাগ হয়ে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল মোড় ঘুরে শাহবাগে পৌঁছে শেষ হয়।
কর্মসূচির শুরুতে সংক্ষিপ্ত সমাবেশে সুলতানা কামাল বলেন, “আমরা জানি জাফর ইকবাল কীসের প্রতীক, জাফর ইকবাল কেন সবার প্রিয়, জাফর ইকবাল কীসে এত ভালোবাসার পাত্র। কারণ জাফর ইকবাল মানুষের মৌলিক অধিকারের পক্ষে, ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে, অসাম্প্রদায়িকতার পক্ষের মানুষ।
“জাফর ইকবাল এমন বিরল প্রতিভার মানুষ যিনি তার লেখনী দিয়ে লাখ লাখ মানুষের মনে মুক্তবুদ্ধির চর্চার তরঙ্গ বয়ে দিতে পারেন। সেই তরঙ্গের কারণে যারা জঙ্গিবাদী, রক্ষণশীল ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপক্ষে তারা নিশ্চিহ্ন হওয়ার ভয় করে। তরুণরা তার ভক্ত, সাধারণ মানুষ তার ভক্ত, তার কথায় তারা অনেক কিছু করতে পারে। সে কারণে তারা জাফর ইকবালকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চায়।”
তিনি বলেন, “আজকে জাফর ইকবালের উপর আঘাত মুক্তিযুদ্ধের চেতনার উপরেও আঘাত, আপনাদের সবার উপরে আঘাত। এর দায় রাষ্ট্র কোনোভাবে এড়াতে পারে না। রাষ্ট্র মুক্তিবুদ্ধির চেতনার মানুষের কাছে দায়ী থাকবে এই হত্যাকাণ্ডের বিচার না হলে।”
“আমাদের কেউ যখন আক্রান্ত হয়েছে, তখন একজন মানুষকে আমরা অভিভাবক হিসাবে পেয়েছি, তিনি অধ্যাপক জাফর ইকবাল, অত্যন্ত প্রিয় স্যার সবার। আজকে তিনিই আক্রান্ত হয়েছেন। সুতরাং এর মাধ্যমে প্রমাণিত হয়, আসলে যারা এই আক্রমণগুলো করছেন, তারা প্রমাণ করে দিয়েছেন, তারা যে কোন সময়ে যে কাউকে আক্রমণ করতে পারেন। এবং আমরা তাদের হাতের নাগালেই আছি।”
বিক্ষোভ পরবর্তী সমাবেশে ইমরান বলেন, এই ‘জঙ্গি’ ফয়জুলের পেছনে কারা অর্থ দিচ্ছে, কারা হামলার পরিকল্পনাকারী তাদের খুঁজে বের করে তাদের পরিচয় আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে প্রকাশ করতে হবে।
তিনি বলেন, “সরকারকে বলতে চাই, একদিকে জঙ্গিদের বাড়িতে দাওয়াত দিয়ে খাওয়াবেন, আরেক দিকে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে কথা বলবেন- তা হয় না। এদেশে স্পষ্টত দুইটা পক্ষ। একটি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের, অন্যটি বিপক্ষের। বিপক্ষ শক্তি কোনো ধরনের রাখঢাক না করে ঘোষণা দিয়ে এ ধরনের হামলা চালিয়ে যাচ্ছে।”
মানবাধিকারকর্মী খুশি কবির বলেন, “জাফর ইকবালের নিজের এলাকায় তার উপর যে হামলা হয়েছে তা এমনি এমনি হঠাৎ করে ঘটেনি, এগুলো সব পরিকল্পিত। আগে মুক্তবুদ্ধির চর্চাকারীদের উপর যে হামলা হয়েছে, সেগুলো যদি বিচার হত, তাহলে এমনটা হত না।”
তিনি বলেন, “আমাদের দেশে বেছে বেছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালনকারীদের উপর হামলা হয়। তবুও আমরা পিছপা হব না, আমরা ভয় পাব না, মুক্তচিন্তার আন্দোলন আমরা চালিয়ে যাব।”
একই সময়ে শাহবাগে ‘বিক্ষুব্ধ নাগরিক সমাজ’ ব্যানারে আরেকটি বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে গণজাগরণ মঞ্চের অপর অংশের নেতাদের দেখা যায়।
এই সমাবেশে সভাপতির বক্তব্যে সাংবাদিক আবেদ খান বলেন, “অধ্যাপক জাফর ইকবাল মুক্তবুদ্ধি চর্চার অনিবার্য প্রতীক। তার উপরে এই জঘন্য হামলা আমরা মেনে নিতে পারি না।
“এমন একজন মানবিক মানুষের উপর আক্রমণ করা হল, যিনি রক্তাক্ত অবস্থায়ও বলছেন, হামলাকারীর যেন কোনো ক্ষতি করা না হয়। এমন হৃদয়ের মানুষ জাফর ইকবাল।”
সমাবেশে অন্যদের মধ্যে একাত্তরের গেরিলা যোদ্ধা জহির উদ্দিন ওরফে বিচ্ছু জালাল, প্রজ্ন্ম ’৭১ এর সংগঠক তৌহিদ রেজা নূর, গণজাগরণ মঞ্চের একাংশের সংগঠক কামাল পাশা চৌধুরী ও এফএম শাহীন বক্তব্য দেন।
গণজাগরণ মঞ্চের নতুন কর্মসূচি
জাফর ইকবালের উপর হামলার বিচার চেয়ে আগামী ৬ মার্চ মঙ্গলবার সকাল ১০টা থেকে সারা দেশে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একযোগে মানববন্ধনসহ কয়েকটি কর্মসূচির ঘোষণা দেন গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান।
তিনি জানান, মঙ্গলবারের কর্মসূচির পর ৮ মার্চ বিকাল ৪টায় সারা দেশের জেলা ও উপজেলায় একযোগে গণবিক্ষোভ কর্মসূচি পালিত হবে। কেন্দ্রীয় কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হবে শাহবাগে।
শাহজালালের সাবেক শিক্ষার্থীদের মানববন্ধন
জাফর ইকবালের উপর হামলার প্রতিবাদে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থীরাও একটি মানববন্ধন করেছেন শাহবাগে।
“যতদিন জাফর ইকবাল স্যারের মতো শিক্ষকদের আদর্শকে আমরা নিজেদের মধ্যে লালন করব, ততদিন আমাদের চাপাতি দিয়ে দমিয়ে রাখা যাবে না।”
শহীদ মিনারে প্রতিবাদ
জাফর ইকবালের ওপর হামলার প্রতিবাদে বিকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমাবেশ করে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। মুক্তবুদ্ধির চর্চার উপর ‘মৌলবাদী অপশক্তির’ ধারাবাহিক আঘাত এবং ‘বিচারহীনতার’ সংস্কৃতিতে সরকারের ভূমিকার প্রতি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা।
সমাবেশে নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ বলেন, “এই দেশে সামাজিক শক্তি এখন অনুপস্থিত। রাজনীতি আমাদের গোটা সমাজ ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়েছে। শিক্ষা ব্যবস্থায় ধস নেমেছে। মেরুদণ্ডসম্পন্ন মানুষ কোথায়?
“আমরা মানবিক রাষ্ট্র তৈরি করতে পারিনি, যার ফলশ্রুতিতে এই হামলার ঘটনা ঘটল। এখন আমরা কোথায় দাঁড়াব?”
জাফর ইকবালের উপর হামলার ঘটনাকে বিজ্ঞানমনস্কতা ও সৎ শিক্ষকতার উপর হামলার শামিল বলে উল্লেখ করেন তিনি।
এই হামলা বন্ধ না হলে তার পরিণতি পুরো জাতির জন্য ভয়াবহ হবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “দেশের বড় মেধা হত্যা করা হচ্ছে। এখন রাজনৈতিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার সময়, না হলে দেশ একদিন মেধাশূন্য হয়ে যাবে।”
জাফর ইকবালকে ‘জাতির বিবেকের কণ্ঠস্বর’ অভিহিত করে নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার বলেন, “তার উপর হামলা মানে সমগ্র জাতির উপর হামলা। ব্লগার, প্রকাশক হত্যার বিচার হয়নি দেখে খুনিরা বারবার পার পেয়ে যাচ্ছে, এরা ঔদ্ধত্য দেখাচ্ছে।”
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্ম ব্যবসা বাড়ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
“এই আইনটি কি কেবল সাংবাদিকদের জন্য? যারা ফেইসবুকে এমন মন্তব্য করেছেন, তাদের ধরতে পারে না সরকার? তাদের আইডি বন্ধ করে দিতে পারে না? এটা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নয়, এটা দেশদ্রোহিতা,” বলেন তিনি।
চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেন বলেন, “প্রগতিশীল ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কারা মৌলবাদীদের সহায়ক শক্তি তাদের চিহ্নিত করতে হবে। এখন আর কোনো কম্প্রোমাইজ করা যাবে না।”
প্রাবন্ধিক-গবেষক মফিদুল হক বলেন, “বাংলাদেশ যে স্বপ্ন দেখে একটি মানবিক ও অসাম্প্রদায়িক চেতনাবোধে উজ্জ্বীবিত একটি রাষ্ট্র নির্মাণের, জাফর ইকবাল সে মতাদর্শের অনন্য সুন্দর প্রকাশ। নবীন প্রজন্মের কাছে তিনি এক স্বপ্নের মানুষ। তার উপর হামলার বিচারে এখন এক জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করবে এই তরুণরাই।”
তিনি বলেন, “জাফর ইকবালের উপর হামলাকারীদের কিন্তু ছাত্ররা ধরে ফেলেছে। তবে প্রশাসন তৎপর রয়েছে এমন ঘটনা প্রতিহত করার জন্য। শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নয়, সমাজের সবাইকে এখন সচেতন ভূমিকা পালন করতে হবে।”
জাফর ইকবালের ওপর হামলার প্রতিবাদ জানিয়ে এক বিবৃতিতে বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতি বলেছে, “এই সন্ত্রাসী হামলা প্রকৃত অর্থে মুক্তচিন্তার ওপর হামলা। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আমাদের সংবিধানপ্রদত্ত মৌলিক অধিকার। এ অধিকার সমুন্নত রাখতে হবে।”
এই হামলায় জড়িতদের পাশাপাশি আগের এ ধরনের সব হামলার হোতাদের দ্রুত গ্রেপ্তার, সুষ্ঠু তদন্ত ও সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছে প্রকাশকদের এই সংগঠন। পাশাপাশি ভবিষ্যতে যেন আর কোনো লেখক, প্রকাশক ও মুক্তচিন্তার কোনো মানুষের ওপর এ ধরনের হামলা না হতে পারে সে বিষয়ে সরকারের আরও কার্যকর উদ্যোগ চেয়েছে তারা।