পিলখানায় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদরদপ্তরে বিদ্রোহের ঘটনায় সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে হত্যার মামলায় হাই কোর্ট যে রায় দিচ্ছে, তা হবে তিন বিচারকের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত।
Published : 26 Nov 2017, 01:15 PM
সোমবার রায়ের পর্যবেক্ষণ পড়া শেষ করে দুপুরের দিকে মূল আদেশের অংশ পড়া শুরু হবে বলে জানিয়েছেন তিন সদস্যের এই বৃহত্তর বেঞ্চের প্রিজাইডিং জাজ বিচারপতি মো. শওকত হোসেন।
হাই কোর্টের বিশেষ এই বেঞ্চের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী ও বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার।
আসামি সংখ্যার দিক দিয়ে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় এ মামলার রায় তারা পড়া শুরু করেন রোববার সকাল ১০টা ৫৪ মিনিটে।
মাঝখানে এক ঘণ্টা বিরতি দিয়ে প্রথম দিন বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী তার হাজার পৃষ্ঠার পর্যবেক্ষণের সংক্ষিপ্তসার পড়ে শোনান।
বিকাল ৪টায় বিচারপতি মো. শওকত হোসেন বলেন, বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী তার রায়ের অংশ পড়া শেষ করেছেন। সোমবার সকাল সাড়ে ১০টায় আবার আদালত বসবে এবং বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার তার পর্যবেক্ষণ সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরবেন।
“আশা করি, আগামীকাল দুপুরের আগেই আমরা মূল রায় দেওয়া শুরু করতে পারব।”
২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পিলখানায় বিডিআর (বর্তমানে নাম বিজিবি) সদরদপ্তরে রক্তাক্ত বিদ্রোহের এই ঘটনায় ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন প্রাণ হারান।
ঢাকার জজ আদালত ২০১৩ সালে এ মামলার রায়ে ১৫২ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ১৬১ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন।
এছাড়া ২৫৬ আসামিকে তিন থেকে ১০ বছর পর্যন্ত বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড দেওয়া হয়। কারও কারও সাজার আদেশ হয় একাধিক ধারায়।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের সাজা কার্যকরের অনুমতি (ডেথ রেফারেন্স) ও আপিল শুনানি শেষ হওয়ার সাত মাস পর হাই কোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চ রোববার রায় দেওয়া শুরু করে।
প্রথমে রায়ের উপক্রমনিকা পড়েন এ বেঞ্চের প্রিজাইডিং জাজ বিচারপতি মো. শওকত হোসেন। তারপর বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী বাংলায় তার রায়ের পর্যবেক্ষণের অংশ পড়া শুরু করেন। তিনি এ মামলার বিচারিক কার্যক্রম ও পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ভয়াবহতা নিয়ে কথা বলেন।
বেলা ১টায় মধ্যাহ্ন বিরতিতে যাওয়ার সময় তিনি রাষ্ট্র ও আসামি পক্ষের আইনজীবীদের বলেন, “এ রায়ের পর্যবেক্ষণই এক হাজার পৃষ্ঠার ওপরে। যে ভিত্তিতে রায় দেওয়া হচ্ছে, তাও মৌখিকভাবে উপস্থাপন করা হবে।
কত সময় লাগতে পারে- আইনজীবীদের এমন প্রশ্নে বিচারপতি শওকত হোসেন তখন বলেন, “কখন শেষ হবে, তা বলা যাচ্ছে না। একটা কথা বলতে পারি, সর্বসম্মত রায় হচ্ছে।”
মধ্যাহ্ন বিরতিতে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, “রায়ে কয়জন আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকবে, কয়জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বহাল থাকবে, কয়জনের সাজা বহাল থাকবে, এবং কোন কোন আসামির দণ্ড মওকূফ হবে, বা সাজা কমবে এসব ব্যাপারে তিনজন বিচারপতি ঐকমত্যে পৌঁছেছেন বলে জানিয়েছেন। তবে যার যার পর্যবেক্ষণ ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে।”
জজ আদালতের রায়
বিডিআর জওয়ানদের ওই রক্তাক্ত বিদ্রোহের পর ৫৭টি বিদ্রোহের মামলার বিচার হয় বাহিনীর নিজস্ব আদালতে। আর হত্যাকাণ্ডের বিচার চলে বকশীবাজারে আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে স্থাপিত মহানগর দায়রা জজ আদালতের অস্থায়ী এজলাসে।
ঢাকার অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মো. আখতারুজ্জামান ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর ওই রায়ে বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেওয়া বিডিআরের উপ সহকারী পরিচালক তৌহিদুল আলমসহ বাহিনীর ১৫২ জওয়ান ও নন কমিশন্ড কর্মকর্তার মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন। পাশাপাশি তাদের প্রত্যেককে এক লাখ টাকা করে জরিমানা করা হয়।
পাশাপাশি অস্ত্র লুটের দায়ে তাদের আরও ১০ বছরের কারাদণ্ড এবং ২০ হাজার টাকা জারিমানা, অনাদায়ে আরও দুই বছরের কারাদণ্ড দেন বিচারক। এছাড়া ২৫৬ আসামিকে তিন থেকে ১০ বছর পর্যন্ত বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড দেওয়া হয়। কারও কারও সাজার আদেশ হয় একাধিক ধারায়।
অপরাধে সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত না হওয়ায় রায়ে ২৭৭ জনকে বেকসুর খালাস দেয় বিচারিক আদালত।
পরে রায়ের বিরুদ্ধে খালাসপ্রাপ্ত ২৭৭ জনের মধ্যে ৬৯ জন আসামির সর্বোচ্চ সাজা চেয়ে হাই কোর্টে ফৌজদারি আপিল ও ডেথ রেফারেন্স দায়ের করে রাষ্ট্রপক্ষ। অন্যদিকে দণ্ডপ্রাপ্ত ৪১০ জন আসামির সাজা বাতিল চেয়ে আপিল করেন তাদের আইনজীবীরা।
এর মধ্যে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত কয়েক আসামির মৃত্যুদণ্ড ও কয়েকজনের সাজা বাড়াতে আরও দুটি আবেদন করেছিল রাষ্ট্রপক্ষ। কিন্তু দেরিতে আবেদন করায় গত ১৩ এপ্রিল আবেদন দুটিও বাতিল করে দেয় হাই কোর্ট। পরে এর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করলে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ হাই কোর্টের আদেশই বহাল রাখে।
এক বছরেরও বেশি সময় ধরে রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের পর গত ১৩ এপ্রিল মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখে আদালত। তার সাত মাস ১২ দিন হাই কোর্ট রায় ঘোষণা করছে।
এ মামলার হাই কোর্টে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা, মোমতাজ উদ্দিন ফকির, মোশাররফ হোসেন কাজল, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোশাররফ হোসেন সরদার, শেখ বাহারুল ইসলাম ও জাহিদ সরওয়ার কাজল।
আসামিপক্ষে আইনজীবী ছিলেন খন্দকার মাহবুব হোসেন, আবদুল বাসেত মজুমদার, মহসীন রশীদ, এস এম শাহজাহান, এ এস এম আবদুল মুবিন, মো. আমিনুল ইসলাম, দাউদুর রহমান মিনা ও শামীম সরদারসহ আরও অনেকে। আসামিপক্ষে রাষ্ট্র নিয়োজিত আইনজীবী ছিলেন হাসনা বেগম।
নিম্ন আদালতের পর্যবেক্ষণ
জজ আদালতের রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ন্যায্যমূল্যে পণ্য বিক্রির ‘অপারেশন ডালভাত’ কর্মসূচিতে সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিডিআরকে জড়ানো ঠিক হয়নি। এটা বাহিনীর ‘ঐতিহ্য’ নষ্ট করেছে।
রায়ে বলা হয়, ২০০৯ সালের ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় বিডিআর সদরদপ্তরে বিদ্রোহের ঘটনার পেছনে অর্থনৈতিক ‘মোটিভ’ ছিল। রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক ‘মোটিভও’ থাকতে পারে।
এই বিদ্রোহের তথ্য আগে জানতে না পারার ঘটনায় ‘গোয়েন্দা দুর্বলতা’ ছিল বলেও মনে করেছে আদালত।
আদালত মনে করে, দেশের ‘অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড’ দুর্বল করার জন্য ওই বিদ্রোহ ঘটানো হয়ে থাকতে পারে। আর সশস্ত্র বাহিনীকে নিরুৎসাহিত করাও এর একটি কারণ হতে পারে।
এই বাহিনীর সদস্যদের আবারও জাতিসংঘ শান্তি মিশনে পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া এবং পিলখানার ভেতরে স্কুলে সাধারণ বিডিআর সদস্যদের সন্তানদের ভর্তির ব্যাপারে আরও ছাড় দেয়ার পরামর্শ দেন বিচারক।
“সেনাসদস্যদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ রেখে বিডিআর সদস্যরা দেশের নিরাপত্তা রক্ষার কাজে নিয়োজিত আছেন। এ জন্য প্রতিরক্ষা বাহিনীর মতো ২০ শতাংশ ভাতা তাদের পাওয়া উচিত। তাদের ঝুঁকিভাতা দেয়া যায় কি না, তাও দেখা উচিত,” পর্যবেক্ষণে বলেন তিনি।