রক্তাক্ত বিদ্রোহের সেই দুই দিন

ফেব্রুয়ারির ২৫ তারিখ, ২০০৯। হঠাৎ পিলখানায় বিডিআর সদরদপ্তর থেকে ভেসে আসা মুহুর্মুহু গুলির শব্দে আতঙ্কিত হয়ে উঠল পুরো জনপদ।

>>বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 Nov 2013, 06:05 AM
Updated : 26 Nov 2017, 06:00 AM

নানা জল্পনা-কল্পনার মধ্যেই জানা গেল, বিদ্রোহ করেছে জওয়ানরা।

দুই দিন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার পর আত্মসমর্পণে অবসান ঘটল বিদ্রোহের। পিলখানা থেকে বের করে আনা হল অর্ধ শতাধিক লাশ।

২০০৮ সালের শেষে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিপুল জনসমর্থন নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি রাষ্ট্রক্ষমতায় আসায় দেশবাসীর মধ্যে যে উৎসাহ-উদ্দপীনা দেখা দেয়, দুই মাসেরও কম সময়ের ব্যবধানে পিলখানায় ওই বিদ্রোহের ঘটনায় ক্ষণিকের জন্য হলেও তা থমকে যায়।

সেই দুই দিনে আসলে কী ঘটেছিল তৎকালীন বিডিআর সদরদপ্তরে, সেই ঘটনাক্রমই তুলে আনার চেষ্টা করেছেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান অপরাধ বিষয়ক প্রতিবেদক লিটন হায়দার

২৫ ফেব্রুয়ারি সকাল ৯টার কিছু আগেই মূলত বিদ্রোহী জওয়ানরা পিলখানার অস্ত্রাগার লুট করে। এরপর সোয়া ৯টার দিকে দরবার হলে হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে তাদের বিদ্রোহ চূড়ান্ত রূপ নেয়।  

এই দুই দিনে ঘটে যায় অনেক ঘটনা। তার মধ্যে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, সংসদ সদস্যদের সঙ্গে বিদ্রোহীদের বৈঠক, প্রধানমন্ত্রীর জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ, সেনা মোতায়েন, হেলিকপ্টার দিয়ে প্রচারপত্র বিতরণের ঘটনা উল্লেখযোগ্য।

বিদ্রোহ শুরুর বেশ কয়েকদিন আগে থেকে বাংলাদেশ রাইফেলসের (বিডিআর) কিছু সংখ্যক সদস্য কয়েকটি দাবি নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে আসছিলেন। পাশপাশি অন্যদেরও দলে ভেড়ানোর চেষ্টা ছিল তাদের।

মূলত পিলখানায় কর্মরত ডিএডি তৌহিদ, ডিএডি নাসির উদ্দিন খান, ডিএডি মীর্জা হাবিবুর রহমান, ডিএডি আব্দুর রহিম, ডিএডি জলিল, সিপাহি সেলিম রেজাসহ কয়েকজন এসব ঘটনার নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন বলে জানা যায়।

বিদ্রোহ ও হত্যাকাণ্ডের পর মামলা, পুলিশের তদন্ত, বিডিআরের নিজস্ব তদন্ত, বিচার চলাকালীন সময় জেরা, সাক্ষীদের বক্তব্য, সরকার পক্ষের কৌঁসুলি ও আসামিপক্ষের আইনজীবীদের কথোপকথন থেকে এসব তথ্য বেরিয়ে আসে।

বিদ্রোহের পরিকল্পনার আগে বিডিআরের ওই সদস্যরা জাতিসংঘ মিশনে যাওয়ার সুযোগ না থাকা, রেশন বৈষম্য, ডাল ভাত কর্মসূচির নামে টাকা আত্মসাতের অভিযোগসহ বিভিন্ন দাবি নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, স্থানীয় সংসদ সদস্য ফজলে নূর তাপসসহ কয়েকজনের সঙ্গে দেখা ও কথা বলার চেষ্টা করেন। বিভিন্নমাধ্যমে তাদের কাছে দাবিগুলো তুলে ধরেন তারা।  

২৪ ফেব্রুয়ারি বিডিআর সপ্তাহ শুরুর দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পিলখানায় আসেন। ওই দিন প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে কোনো ঘোষণা আসবে বলে প্রত্যাশা ছিল বিডিআর জওয়ানদের।

কিন্তু প্রত্যাশা অনুযায়ী কিছু না হওয়ায় সুবেদার গোফরান মল্লিকের নেতৃত্বে বিদ্রোহের পরিকল্পনা করেন কিছু সংখ্যক জওয়ান। এর আগেই তারা দাবি দাওয়া নিয়ে বিডিআর ৫ নম্বর ফটকের কাছে এক কোচিং সেন্টারে প্রচারপত্র বানিয়ে বিভিন্ন জায়গায় তা বিতরণ করেন।

ওই কোচিং সেন্টারের কাছে এক সিপাহির ভাড়া বাসায় জড়ো হয়ে মোমবাতি জ্বালিয়ে একসঙ্গে থাকার শপথ করেন বিদ্রোহের মূল পরিকল্পনাকারীরা।

২৪ ফেব্রুয়ারি বিএনপি নেতা নাসির উদ্দিন আহমেদ পিন্টুর সঙ্গে তার বাসার কাছে কয়েকজন বিডিআর সদস্যকে কথা বলতে দেখা যায় এবং পিন্টুকে ৫ নম্বর ফটক পর্যন্ত তাদের এগিয়ে দিতেও দেখার কথা জানিয়েছেন অনেকে।  

ঘটনার দিন ২৫ ফেব্রুয়ারি সকাল ৮টায় দরবার শুরু হওয়ার আগে সিপাহি মইন উদ্দিন ও সেলিম রেজার নেতৃত্বে কয়েকজন সমবেত হন। কিন্তু তখন পর্যন্ত অন্যরা না আশায় তারা হতাশায় পড়েন।

এর পরপরই খবর আসে ৯টায় শুরু হবে দরবার। তখন তারা নিজেদের মধ্যে ফের যোগাযোগ করে একত্রিত হন এবং বিদ্রোহের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেন।

পরিকল্পনার অংশ হিসেবে জওয়ানদের একটি দল সকাল ৯টার কিছু আগে এক অস্ত্রাগারে চলে যান এবং সেখানে দায়িত্বরত এক মেজরকে জিম্মি করে অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুট করেন। সেখানে দায়িত্বরত কোনো বিডিআর সদস্য তাদের বাধা দেননি।

এরপরই কয়েকজন সরাসরি দরবার হলে চলে আসেন এবং দরবার শুরু হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে সোয়া ৯টার দিকে সিপাহি মইন ও সিপাহি কাজল ঢুকে পড়েন। কাজল পিছনে থাকেন আর মইন অস্ত্র হাতে মঞ্চে উঠে মহাপরিচালক শাকিল আহমেদকে জিম্মি করার চেষ্টা চালান।

এসময় বিগ্রেডিয়ার জেনারেল এমএ বারি তাকে ফেলে দিয়ে নিরস্ত্র করেন এবং জুতার ফিতা দিয়ে বেঁধে ফেলেন।

এই অবস্থা দেখে কাজল দরবার হল ত্যাগ করেন এবং এরইমধ্যে পুরো দরবার হলে হৈ চৈ শুরু হয়। ডিজি শাকিল সবাইকে বারবার শান্ত হওয়ার অনুরোধ জানান এবং দাবি দাওয়া নিয়ে আলোচনা করা হবে বলে প্রতিশ্রুতি দেন।

শাকিল আহমেদ প্রত্যেক কর্মকর্তাকে নিজ নিজ ইউনিট সামাল দিতে বলেন। এরইমধ্যে সিপাহিদের মধ্য থেকে ‘জাগো’ বলে শ্লোগান আসে। এরপরই সিপাহি সেলিম রেজার নেতৃত্বে একটি দল সশস্ত্র অবস্থায় দরবার হলে ঢুকে পড়লে সব নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে।

শুরু হয় পিলখানাজুড়ে তাণ্ডব। চলে সেনা কর্মকর্তাসহ তাদের পরিবারকে হত্যা, নির্যাতন, জিম্মি, লুটপাট আর অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনা।

বিদ্রোহীরা প্রায় দুই দিন পিলখানা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখেন। এরইমধ্যে ২৫ ফেব্রুয়ারি দুপুরের পর স্থানীয় সরকারমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবীর নানক, হুইপ মীর্জা আযমের নেতৃত্বে একটি দল তাদের সঙ্গে কথা বলেন এবং প্রধানমন্ত্রী শেথ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করেন।

বিদ্রোহীদের সে সময়ের নেতা ডিএডি তৌহিদের নেতৃত্বে ১৪ জনের একটি দল প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের পর রাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে লোক দেখানো অস্ত্র সমর্পণ করেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন পিলখানা থেকে বের হওয়ার পর তারা আবার অস্ত্র তুলে নেন।

এরই মধ্যে পিলখানার পাশে আম্বালা ইন নামের একটি হোটেলে দফায় দফায় বিদ্রোহীদের সঙ্গে সরকারে উচ্চ পর্যায়ের লোকজনের আলোচনা চলে।

তারা যখন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন তখন হাজারীবাগ সুয়্যারেজ লাইনে পোশাক পরিহিত দুইজন কর্মকর্তার লাশ পাওয়া যায়।

পরদিন ২৬ ফেব্রুয়ারি বিকাল পর্যন্ত বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণেই থাকে পিলখানা। তবে আগের তুলনায় গুলির শব্দ কম শোনা যায়। ২৫ ফেব্রুয়ারি বিদোহ শুরুর পর থেকেই পিলখানার আশপাশে যেসব সেনা সদস্যদের মোতায়েন করা হয় ২৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তাদের সেখানে দেখা যায়।

২৬ ফেব্রুয়ারি বিকাল থেকে পিলখানায় বিডিআরের সংখ্যা কমতে থাকে। অবস্থা বেগতিক দেখে পোশাক পাল্টে পিলখানার বিভিন্ন দিক দিয়ে পালিয়ে যেতে থাকেন তারা।

এক পর্যায়ে ডিএডি তৌহিদের নেতৃত্বে বিদ্রোহীরা আবার অস্ত্র সমর্পণের কথা বলেন এবং ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে অস্ত্র এবং অস্ত্রাগারসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার চাবি দেন। পরে পুলিশ কমিশনার নাইম আহমেদের কাছে তা বুঝিয়ে দেয়া হয়। অবসান ঘটে প্রায় ৩৩ ঘণ্টার বিদ্রোহের।

পরদিন পিলখানার ভিতরে একাধিক গণকবরের সন্ধান মেলে। সেখানে পাওয়া যায় বিডিআরের তৎকালীন মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদ, তার স্ত্রীসহ সেনা কর্মকর্তাদের লাশ। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিপুল পরিমাণ অস্ত্র, গ্রেনেড উদ্ধার হয়।  

২০০৯ সালের ওই ঘটনায় প্রাণ হারান ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন। পিলখানায় বিদ্রোহের সূত্র ধরে দেশের বিভিন্ন স্থানে জওয়ানরা বিদ্রোহ করে। সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনীর ওই বিদ্রোহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও আলোড়ন তোলে।

রক্তাক্ত সেই বিদ্রোহের পর সীমান্তরক্ষা বাহিনী বিডিআরের নাম বদলে যায়, পরিবর্তন আসে পোশাকেও। এ বাহিনীর নাম এখন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ বা বিজিবি।