ভরদুপুরে রোদের মধ্যে খিলক্ষেত থেকে হেঁটে উত্তরায় যাচ্ছিলেন ঢাকার তেজগাঁও কলেজের শিক্ষার্থী কামরুল হাসান।
Published : 18 Oct 2017, 05:14 PM
গাড়ি রেখে কী কারণে হাঁটা- জানতে চাইলে এই তরুণ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পরীক্ষা শেষ করে দেড়টায় বাসে উঠেছি, বাস তো চলছে না। ঘণ্টাখানেক বাসে বসেছিলাম। এখন মনে হচ্ছে হেঁটে গেলে তাড়াতাড়ি পৌঁছব।”
ঢাকার বিমানবন্দর সড়কে বুধবার দুপুরের পর থেকে যানজটে এমন নাকাল হতে হয়েছে কামরুলের মতো অনেককেই।
দুপুর ৩টায় খিলক্ষেতে যখন কামরুলের সঙ্গে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কথা হয়, তখন আশপাশের অনেকেই যানজট নিয়ে অসন্তোষের কথা জানাচ্ছিলেন।
১১ দিন আগে এই সড়কে যানজটে নাকাল হতে হয়েছিল ঢাকার বাসিন্দাদের; সেদিন ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আওয়ামী লীগের গণসংবর্ধনা দেওয়ার কারণে। বুধবার নগরবাসীকে একই অভিজ্ঞতা নিতে হল বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে শুভেচ্ছা জানাতে তার দলের নেতা-কর্মীদের তৎপরতার কারণে।
চিকিৎসার জন্য তিন মাস লন্ডনে থাকা খালেদা জিয়া বুধবার বিকাল সোয়া ৫টার দিকে শাহজালাল বিমানবন্দরে নামেন। সেখান থেকে গাড়িতে সরাসরি গুলশানের বাড়িতে যান তিনি।
বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো কর্মসূচি না রাখলেও দল ও সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীরা বিমানবন্দর থেকে বনানীর কাকলী পর্যন্ত সড়কের দুই পাশে দাঁড়িয়ে দলীয় নেত্রীকে শুভেচ্ছা জানান।
‘মাদার অব ডেমক্রেসি’ লেখা ব্যানার-ফেস্টুন হাতে দাঁড়ানো এই নেতা-কর্মীরা পাশ থেকে সড়কে উঠে আসায় যান চলাচল হয় বিঘ্নিত। তাদের মোটর সাইকেল শোভাযাত্রাও চলাচলে প্রভাব ফেলে।
খালেদা জিয়া বিকাল সোয়া ৫টায় নামলেও দুপুরের পর থেকে বিএনপি নেতা-কর্মীরা সড়কের অবস্থান নিতে শুরু করলে যানবাহনের গতি ধীর হয়ে পড়ে।
ডিএমপির অতিরিক্ত উপ-কমিশনার শাহেন শাহ বেলা ৩টার দিকে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এরই মধ্যে উত্তরা এলাকায় কয়েক হাজার নেতা-কর্মী চলে এসেছে।”
উত্তরা থেকে নেতা-কর্মীরা মিছিল নিয়ে জড়ো হয় বিমানবন্দরের গোলচত্বরের আশপাশে। বিমানবন্দরের ভেতরে ঢুকতে না পেরে তারা বাইরেই অবস্থান নেন।
খালেদা জিয়ার ফেরাকে কেন্দ্র করে পুলিশের বাড়তি নিরাপত্তার বন্দোবস্তে মহাসড়ক থেকে বিমানবন্দরে প্রবেশের রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হলে বিমানযাত্রী ও তাদের স্বজনদের হয়রানিতে পড়তে হয়।
বিকাল ৪টা থেকে বিমানবন্দরের সামনের সড়কে যান চলাচল বিঘ্নিত হতে থাকে। সড়কে পূর্ব পাশে অবস্থান নেওয়া বিএনপির কর্মী-সমর্থকরা ফুটপাথে অবস্থান নিলেও বিকাল সাড়ে ৪টার পর তারা মূল রাস্তায় নেমে এসে মিছিল করতে থাকে।
বিমানবন্দরের সামনে গোলচত্বর থেকে কাওলা পর্যন্ত রাস্তায় মিছিল করে তারা। এতে বনানীমুখী যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
যানজটে আটকে থাকা অটোরিকশাচালক মো. আবদুল্লাহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “উত্তরার ৮ নম্বর সেক্টর থেকে বের হয়ে দুই ঘণ্টা বসে আছি। গাড়ি এগুচ্ছেই না। আজকে তো জমার টাকাই উঠবে না।”
অন্যদিকে উত্তরামুখী যানবাহন বিমানবন্দর গোলচত্বর অতিক্রম করতে না পারায় সড়কের পশ্চিম পাশে গাড়ির দীর্ঘ লাইন কুড়িল বিশ্বরোড ছাড়িয়ে যায়।
এসময় কুড়িল ফ্লাইওভারেও যানজট সৃষ্টি হয়। সেখানে অবস্থান নিয়ে ছিলেন নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির নেতা-কর্মীরা।
সড়কের পাশে দাঁড়ালেন না কেন-এ প্রশ্নে নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মো. নজরুল ইসলাম পান্না মোল্লা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “লোকজনকে কন্ট্রোল করা যাচ্ছে না। কিছুই করার নাই। এত লোক কই জায়গা দিবেন? এইটা বিএনপির জোয়ারের ঢল।”
খিলক্ষেত, নিকুঞ্জ, শাওড়া, কাকলী মোড় পর্যন্ত বিএনপি নেতা-কর্মীরা রাস্তার পূর্ব পাশে অবস্থান নিয়ে ছিলেন। কয়েকটি স্থানে বাদক দলও ছিল।
বিএনপি নেতা মওদুদ আহমদ অভিযোগ করেন, পুলিশের বিভিন্ন স্থানে তাদের নেতা-কর্মীদের অবস্থান নিতে বাধা দিয়েছে।
তিনি বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের বলেন, “আমাদের নেত্রী দেশে ফিরবেন বলে দলের নেতা-কর্মীরা তাকে শুভেচ্ছা জানাতে এসেছে। অথচ দেখেন, পুলিশ কতভাবে তাদেরকে বাধা দিচ্ছে। পুলিশ সড়কে গণপরিবহনও বন্ধ করে দিয়েছে, যাতে আমাদের কর্মী-সমর্থকরা না আসতে পারে।”
যানজটের সময় পুলিশ পিকআপ ভ্যান নিয়ে মাইকিং করছিল, যাতে রাস্তায় গাড়ি চলাচল আটকে না যায়।
পুলিশের পক্ষ থেকে যানজট এবং জনদুর্ভোগ সৃষ্টি না করার অনুরোধ করা হচ্ছিল; নইলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারিও দেওয়া হয়। তবে কারও বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি।
খালেদা জিয়ার বনানী পৌঁছতেই লাগে রাত সোয়া ৮টা; তখনও বিমানবন্দর সড়কে যানজট লেগে ছিল।
৫ ঘণ্টায় গাজীপুর থেকে বিমানবন্দর
দুপুর ১টায় গাজীপুর থেকে ছেড়ে এসেছিল ঢাকার আজিমপুরগামী ভিআইপি পরিবহনের একটি বাস। তীব্র যানজটে পড়ে সন্ধ্যা ৬টায় শাহজালাল বিমানবন্দরের কাছাকাছি পৌঁছায় বাসটি।
বাসের যাত্রী মুমিনুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের কষ্টের শেষ নেই। সবই কপাল, জনগণ গোল্লায় যাক, সংবর্ধনা তো দিতেই হবে!”
সন্ধ্যায় অনেক মানুষকে হেঁটে উত্তরার দিক থেকে আসতে দেখা যায়। ঢাকামুখী অ্যাম্বুলেন্সগুলোর উল্টোপথে সামনে এগোনোর চেষ্টা করলেও বিমানবন্দরের সামনে এসে আটকে পড়তে হয়।
সন্ধ্যায় বিমানবন্দরের সামনে আটকা পড়া নরসিংদী থেকে ঢাকার অ্যাপোলো হাসপাতালগামী একটি অ্যাম্বুলেন্সে দেখা যায় এক হৃদরোগীকে।
রোগীর স্বজনরা জানান, বিকাল ৪টায় নরসিংদী থেকে যাত্রা করে ৫টার দিকে উত্তরায় এসে যানজটে পড়েন তারা।
নাতির পরীক্ষার প্রবেশপত্র আনতে দুপুরে উত্তরার রাজউক কলেজে গিয়ে ফেরার সময় কুড়িল পর্যন্ত ৫ কিলোমিটার পথ হাঁটতে হয় বলে জানান রামপুরা উলন রোডের বাসিন্দা নাদিরা আশরাফকে।
সন্ধ্যা পৌনে ৬টায় কুড়িল বিশ্বরোড এলাকায় যখন তার সঙ্গে কথা হয়, তখন রীতিমতো ক্লান্ত-বিধ্বস্ত ষাটোর্ধ্ব এই নারী।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, নাতির জ্বর থাকায় কলেজে যেতে হয়েছিল তাকে।
“৩টার দিকে বাসে উঠেছিলাম। কিন্তু জসিম উদ্দিন পর্যন্ত এসে যানজটে পড়ি। দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পর সবাই বাস থেকে নেমে হাঁটা ধরে। আমিও নেমে চলে এসেছি। এখন আর শরীরে কুলাচ্ছে না।”
“আমরা কোন এক দেশে আছি কে জানে? তারা দেশের বড় বড় নেতানেত্রী, আমাদের মনে হয় মানুষই মনে করে না। নইলে এভাবে কেউ মানুষকে কষ্ট দেয়,” ক্ষোভ ঝরে নাদিয়ার কণ্ঠে।
উত্তরার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক রাশিদ সাদমান উত্তরার আজমপুর থেকে হাঁটতে শুরু করেন মহাখালীর উদ্দেশে।
তিনি বলেন, “আমাদের কিছু মনে করায়-না করায় তাদের কিছু যায় আসে না। আমরা সাধারণ মানুষ, দুর্ভোগ পোহানোই তো আমাদের নিয়তি।”
এই যানজটে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদেরও ভোগান্তি পোহাতে হয়।
সন্ধ্যার পর বিমানবন্দর সড়ক ধরে হেঁটে ফিরছিলেন রাজউক উত্তরা স্কুল অ্যান্ড কলেজের তিন শিক্ষার্থী তৃষা, নাবিলা ও কলি। তিনজনের বাসাই বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায়। যানজটে কলেজ বাস না পৌঁছানোয় হেঁটেই বাসায় রওনা হন তারা।
শতাব্দী রায় তৃষা বলেন, “কলেজে ফোন নেয়া নিষিদ্ধ। তাই বাসার কারও সঙ্গে যোগাযোগও করা যাচ্ছে না। বাসায় সবাই নিশ্চয়ই খুব চিন্তা করছে।”
প্রধানমন্ত্রীর ফেরার দিনও একই রকম দুর্ভোগে পড়ার কথা জানান তিনি।
পাশে থাকা নাবিলা ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, “উনারা দেশের জন্য কাজ করেন। তারা আমাদের কষ্ট লাঘব করার কথা। উল্টো তাদের কারণেই প্রতিনিয়ত আমাদের দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে। এটার একটা প্রতিকার হওয়া দরকার।”