শরণার্থীদের নিঃস্ব করে ‘ভাগ্য গড়ার খেলা’

প্রাণ বাঁচাতে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের ঘিরে সীমান্তে চলছে এক ধরনের বাণিজ্য, যেখানে অভিযোগের আঙুল উঠছে কোস্ট গার্ড ও বিজিবির কিছু সদস্যের বিরুদ্ধেও।

সুলাইমান নিলয় মিয়ানমার সীমান্ত থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 Sept 2017, 12:20 PM
Updated : 13 Sept 2017, 03:57 PM

ভয়তাড়িত রোহিঙ্গারা সীমান্তে এ বাণিজ্যের কারণে নিঃস্ব হয়ে পড়ছেন। রোহিঙ্গাদের জিনিসপত্র লুটে নেওয়ার অভিযোগও পাওয়া গেছে।

রোহিঙ্গাদের দুরবস্থা নিয়ে আর্থিক ফায়দা হাসিল না করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা এলেও গত শনিবার থেকে চার দিন মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের আসার কয়েকটি পথ এবং অস্থায়ী রোহিঙ্গা ক্যাম্পসহ বেশ কিছু এলাকা ঘুরে এই চিত্র পাওয়া গেছে।

গত দুই সপ্তাহে মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ইতোমধ্যে পৌনে চার লাখ ছাড়িয়েছে।

মঙ্গলবার শেখ হাসিনা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দেখতে কক্সবাজার আসেন। তিনি ত্রাণ বিতরণ করেন এবং শরণার্থীদের সঙ্গে কথা বলেন।

কক্সবাজারের স্থানীয় বাসিন্দাদের তিনি অনুরোধ করেন, যারা আশ্রয়ের জন্য এসেছে, তাদের যেন কোনো কষ্ট না হয়। শরণার্থীদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণের নামে কেউ যেন ‘নিজের ভাগ্য গড়ার খেলা’ খেলতে না পারে।

আগের দিন সংসদেও তিনি বলেন, “এদের দুর্ভোগের সুযোগ নিয়ে কেউ যেন রাজনৈতিক ফায়দা লোটার চেষ্টা না করে। কেউ যেন আর্থিক সুযোগ নিয়ে নিজেদের ভাগ্য গড়ার চেষ্টা না করে।”

বিজিবির একজন কর্মকর্তা বলছেন, সীমান্তে রোহিঙ্গা সঙ্কট সামাল দিতে তারা সাধ্যমত চেষ্টা করছেন। বাহিনীর কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযাগ পেলে তারা অবশ্যই ব্যবস্থা নেবেন।

ছবি: মোস্তাফিজুর রহমান

‘নদী পারাপারে মোটা টাকা’

বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের বড় একটি অংশ জুড়ে নাফ নদী। মিয়ানমার থেকে নদী পার হয়ে বাংলাদেশে আসতে হয়। কোনো কোনো জায়গায় ভাটার সময় কেউ কেউ সাঁতরে পার হতে পারলেও নারী-শিশু-বৃদ্ধ এবং মালপত্র পার করার একমাত্র ভরসা নৌকা।

মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর তাড়া খেয়ে প্রাণ বাঁচাতে আসা মানুষের কাছ থেকে মোট অংকের টাকা আদায়ের অভিযোগ রয়েছে মাঝিদের বিরুদ্ধে।

গত রোববার টেকনাফের শাপলাপুর এলাকায় আব্দুল করিম নামে একজন জানান, তার পরিবারের বাচ্চা-কাচ্চা মিলিয়ে ১৩ জন সদস্যকে পার করতে মাঝিকে বাংলাদেশি টাকায় ৬০ হাজার টাকা দিতে হয়েছে।

এক কিলোমিটারের বেশি চওড়া এই নদী পার হতে জনপ্রতি তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা নেওয়ার কথা জানিয়েছেন অনেকে। তবে বিনা পয়সায় পার হয়েছেন- এমন দুই-চারজনের দেখাও মিলেছে।

প্রতিবেশী দেশের এই বাসিন্দাদের অনেককে টাকা না থাকায় নৌকা পার হতে দিতে হয়েছে সঙ্গে আনা গরু-ছাগল; নাক-কানের গয়নাও খুলে দিতে হয়েছে অনেককে।

এমনকি নৌকায় তুলে জোর করে টাকা পয়সা এবং গহনা খুলে নেওয়ার একটি ঘটনাও পাওয়া গেছে মঙ্গলবার।

আকিয়াব জেলার রাসিডং থানার সিরিনডং পাড়ার হাবিব হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, নদীর মাঝে এসে তাদের টাকা-পয়সা সোনা হাতে নিয়ে নেয় তিন মাঝি। নৌকা ভেড়ার পর  মাঝিরা সেগুলো নিয়ে দৌড় দেয়।

কোস্ট গার্ড দুজনকে ধরতে পারলেও আরেকজন জিনিসপত্র নিয়ে পালিয়ে যায় বলে জানান হাবিব।

এ বিষয়ে মাঝিদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। তাদের একজন ক্যামেরার সামনে কথা বললেও নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি।

কথায় কথায় তিনি বলেন, “রোহিঙ্গাদের পার করতে হলে আগেই বিজিবির সঙ্গে কথা বলে যেতে হয়। কথা না বলে পার করা যায় না। কথা বলতে গেলে অনেকে টাকা চায়, অনেকে আবার চায় না।”

রোহিঙ্গাদের পার করতে হলে বিজিবিকে ‘চা-নাস্তার খরচ’ দিতে হয় জানিয়ে তিনি বলেন, নদী পার করতে তারা ৫০০ থেকে ২০০০ টাকা করে নেন।

অভিযোগের আঙুল বিজিবি-কোস্ট গার্ডের দিকে

মঙ্গলবার সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত অন্তত আটটি নৌকা ভিড়তে দেখা যায় শাহপরীর দ্বীপের পূর্বের একটি চরে; জেলেরা ওই চরকে ‘গুলার চর’ নামে ডাকে।

ওই চরে রোহিঙ্গাদের বহন করে নিয়ে আসা একটি নৌকায় আগুন দেয় কোস্ট গার্ডের সদস্যরা। এর আগে তারা নৌকাটিকে ধাওয়া করে। ধাওয়া খেয়ে তীরে ভেড়ানোর আগেই নৌকার গতি কমিয়ে তিন মাঝি নেমে দৌড়ে চলে যায়।

এদের একজনকে পরে ধরতে সক্ষম হয় কোস্ট গার্ড। পরে ওই নৌকা পুড়িয়ে দেওয়া হয়।

কী কারণে তাকে ধরা হয়েছে- এ জিজ্ঞাসায় ক্যামেরার সামনে কথা বলতে অস্বীকার করেন সেখানে দায়িত্বে থাকা কোস্ট গার্ডের এক সদস্য।

তবে ক্যামেরা ছাড়া জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এরা দালাল। রোহিঙ্গাদের নৌকা পার করে দেওয়ার বিনিময়ে তারা প্রচুর টাকা-পয়সা আদায় করে।”

এ কথা যখন কোস্ট গার্ডের ওই সদস্য বলছিলেন, তখন কাছেই ভিড়ছিল রোহিঙ্গাদের বহন করে নিয়ে আসা অন্য একটি নৌকা। সেটি নিয়ে কোস্ট গার্ডের কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি।

 

রোহিঙ্গাদের নৌকা থেকে পালিয়ে যাওয়া তিনজনের মধ্যে একজন চরে ঘুরছিলেন, সেখান থেকেই তাকে আটক করা হয়।

তাকে নিয়ে যাওয়ার পর শাহপরীর দ্বীপের মূল ভূখণ্ডের দিকে এগোনোর সময় একদল নারী-পুরুষকে কান্নাকাটি করতে দেখা যায়।

তাদের মধ্যে এক বৃদ্ধের কথা শুনে বোঝা গেল, তিনি আটক ব্যক্তিকে নিজের ছেলে হিসেবে দাবি করছিলেন।

তিনি জানান, তার ছেলে ১৫-২০ বছর আগে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে এসেছেন, থাকেন শামলাপুর এলাকায়। এই সঙ্কটের সময় তিনি মিয়ানমারে গিয়েছিল মা-বাবাসহ পরিবারের অন্যদের আনতে। ফেরার পর দালাল বলে তাকে আটক করা হয়।

মঙ্গলবার রোহিঙ্গাদের বহনকারী অন্য যে নৌকাগুলো ওই এলাকার তীরে ভিড়েছে, সেগুলোর কোনো কোনোটির কাছে গিয়ে কোস্ট গার্ডের নৌকা ভিড়তে দেখা গেছে। আবার কোনো কোনোটি নিয়ে তাদের কোনো তৎপরতাই চোখে পড়েনি।

একেক নৌকার সঙ্গে একেক আচরণের কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা গেল রোহিঙ্গাদের নিয়ে সীমান্ত বাণিজ্যের অন্য এক চিত্র।

‘মাছ ধরা বন্ধ, প্রতি ট্রিপে টাকা’

কক্সবাজার থেকে মেরিন ড্রাইভ ধরে টেকনাফ পর্যন্ত রয়েছে বেশ কিছু জেলে ঘাট। মঙ্গলবার সকালে এসব ঘাটে নৌকা দেখা যায়নি খুব একটা। সাগরে বেশ মাছ ধরা পড়ছিল বলে জেলেরা ছুটেছেন মাছের সন্ধানে।

ব্যতিক্রম দেখা গেল শাহপরীর দ্বীপে। অনেকগুলো মাছ ধরার নৌকাকে দ্বীপের পূর্ব পাশে ঠায় বসে থাকতে দেখা গেল।

এসব নৌকার জেলেদের সঙ্গে কথা বলে রোহিঙ্গা পারাপারে বিজিবি-কোস্ট গার্ড সদস্যদের বিরুদ্ধে আরও কিছু দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেল।

নাম প্রকাশ না করে একজন জেলে বলেন, “নদীতে যেসব নৌকা দেখছেন, এগুলো কোনো না কোনোভাবে মিয়ানমার থেকে গরু বা মানুষ পারাপারের কাজ করছে। এজন্য প্রতি ট্রিপে ২০ হাজার টাকা করে দিতে হয়।”

এক জেলে জানান, যে মাঝি এই টাকা না দিয়ে রোহিঙ্গা পারাপার করে, তাকেই ধাওয়া করে কোস্ট গার্ড। ধরতে পারলে নৌকা পুড়িয়ে দেয়।

“আমরা কাজ করে খেতে চাই, সাগরে মাছ ধরতে যেতে চাই। সেটা না করে কেন আমাদেরকে বসিয়ে রাখা হয়েছে, জানি না। কবে এর শেষ হবে- সেটাও বুঝতে পারছি না।”

এসব অভিযোগের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে টেকনাফে বিজিবি-২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল এস এম আরিফুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের ব্যবস্থাগুলো সিম্বলিক। একজনকে শাস্তি দিয়ে বাকিদের দেখাতে চাই। গত কয়েক দিনে শাহপরীর দ্বীপে আমরা কোনো নৌকা পোড়াইনি। তবে কোস্ট গার্ড পুড়িয়েছে। আমরা দিনরাত পরিশ্রম করছি। তারপরও মানুষ হিসেবে সব কাজ করতে পারি না।”

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “আমাদের বাহিনীর কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট  অভিযাগ এলে আমরা ব্যবস্থা নেব।”

বিজিবির এই কর্মকর্তা বলেন, স্থানীয়দের কেউ কেউ মানুষকে জিম্মি করছে। তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

অভিযোগের বিষয়ে কোস্ট গার্ডের বক্তব্য বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম জানতে পারেনি। 

গরু নিয়ে ‘অন্য বাণিজ্য’

গত কয়েকদিনে সীমান্তের বিভিন্ন জায়গা দিয়ে ঘুরে দেখা যায়, যেসব পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গারা আসে, সেসব পথে আসে গরুও। যেখানে যেদিন মানুষ বাড়ে, সেখানে বেড়ে যায় গরুর সংখ্যাও।

তবে নো-ম্যান্স ল্যান্ডের বাইরে আর রোহিঙ্গাদের হাতে এ সব গরু দেখা যায় না। সীমান্ত পার হওয়ার সময়ই গরুর রশি চলে যায় নতুন কারও হাতে।

রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা গরু নিয়ে আসছেন ঠিকই, তবে অনিশ্চিত যাত্রার আগে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বেচে দিতে চান। এই সুযোগটাই কাজে লাগাচ্ছে সীমান্তের এক শ্রেণির মানুষ।

শাহপরীর দ্বীপের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নদীর ওপারে মিয়ানমার অংশ থেকে এ সব গরু  খুব অল্প দামে কিনে নিয়ে আসে বাঙালিরা। এপারে এনে তারা আবার অন্যদের কাছে বিক্রি করে দেয়।

শাহপরীর দ্বীপের এক অটোচালক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তিনি এক বাঙালির কাছ থেকে আড়াই হাজার টাকায় রোহিঙ্গাদের দুটো ছাগল কিনেছেন।