যুবলীগ নেতা হত্যাকাণ্ডের পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলেও হঠাৎ করেই সদলবলে পাহাড়িদের গ্রামে হামলা চালিয়ে বাড়ি-ঘরে আগুন দেওয়া হয় বলে প্রত্যক্ষদর্শী একজন জানিয়েছেন।
Published : 03 Jun 2017, 05:04 PM
নির্মল চন্দ্র চাকমা নামে এই পাহাড়ি বলেছেন, পুলিশ ও সেনা সদস্যরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলেও নিবৃত্ত করতে পারেনি হামলাকারী বাঙালিদের।
বৃহস্পতিবার যুবলীগের লংগদু সদর ইউনিয়ন শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক নুরুল ইসলাম নয়নের লাশ খাগড়াছড়ি- দীঘিনালা সড়কের চার মাইল এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয়। নয়ন ভাড়ায় মোটর সাইকেল চালাতেন।
শুক্রবার সকালে ময়নাতদন্তের পর নয়নের লাশ লংগদু উপজেলা সদরের বাট্ট্যাপাড়ায় নেওয়ার পর বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। এরপর তিনটিলা পাড়া, বাত্যাপাড়া, উত্তর ও দক্ষিণ মানিকজুড় ও বড়াদম এলাকায় পাহাড়িদের ঘরে আগুন দেওয়া হয়।
এই সময় ওই এলাকার অন্য সব পাহাড়ির সঙ্গে জঙ্গলে লুকিয়ে ছিলেন এনজিওকর্মী নির্মল; তিনি সমন্বিত সমাজ উন্নয়ন প্রকল্পের ফিল্ড অফিসার হিসেবে কাজ করেন।
শনিবার সকালে ফিরে নিজের অফিসও আগুনে পোড়া অবস্থায় পান নির্মল।
তিনি টেলিফোনে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, আগের দিন নয়নের লাশ উদ্ধারের পর পরিস্থিতি স্বাভাবিকই ছিল। স্থানীয় চেয়ারম্যানও আশ্বস্ত করেছিল যে পাহাড়িদের কোনো সমস্যা হবে না।
“সব কিছু স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু হঠাৎ সকাল ৯টা-সাড়ে ৯টার দিকে কী যে হল! সবাই ছোটাছুটি শুরু করল, দেখলাম শুধু পাহাড়িদের বাড়িঘরগুলো পুড়ছে।”
“প্রথমেই আগুন দেওয়া হল আমাদের দোকানের দক্ষিণ পাশের বাড়িগুলোতে। এরপর উত্তর দিকে তারা (হামলাকারীরা) এগিয়ে আসতে লাগল। আমি প্রাণভয়ে সোজা পশ্চিম দিকে চলে যাই; আমার স্ত্রী, মা, ভাই, ভাই বৌ সবাই। বাঙালিরা যেভাবে ধেয়ে আসছিল, সেখানে থাকা সম্ভব ছিল না।”
মানিকজুড় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে পৌঁছনোর পর ধানক্ষেত দিয়ে প্রায় ২০০-২৫০ বাঙালিকে লাঠি-সোঁটা নিয়ে তেড়ে আসতে দেখেন বলে জানান নির্মল।
তিনি বলেন, তখন পাহাড়িরাও ইট ছোড়ে বাঙালিদের দিকে। তবে পেরে উঠছিল না।
“আমরা আবারও প্রাণভয়ে দৌড়ে পেছনের জঙ্গলে চলে যাই। ওই সময় বাড়িঘর পোড়াতে থাকে তারা।”
দুপুর ২টার দিকে দূরের জঙ্গল থেকে বাড়িঘর পুড়তে দেখেন বলে জানান এই উন্নয়নকর্মী।
তিনি জানান, তিন টিলা সদরে আনুমানিক ১৫০-২০০ বাড়িঘর, মানিকজুড় দক্ষিণপাড়ায় ৩০-৪০টি ও উত্তরদিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের সমন্বিত সমাজ উন্নয়ন প্রকল্প কেন্দ্রটি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।
যারা আগুন দিয়েছে, তাদের চেনেন কি না- জানতে চাইলে এই পাহাড়ি বলেন, “এরা চেনা লোক। নাম না জানলেও এরা আমাদের মুখ চেনা বাঙালি।”
বিভিন্ন স্থান থেকে গিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসতি গেঁড়ে বসা বাঙালিদের সঙ্গে পাহাড়িদের বিরোধী দীর্ঘদিনের।
দুই দশক আগে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তিতে ওই অঞ্চলের ভূমির উপর পাহাড়িদের অধিকারের স্বীকৃতি দেওয়া হলেও চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন না হওয়ায় অসন্তোষ জানিয়ে আসছেন পাহাড়িদের নেতা জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা)।
হামলাকারীরা আগুন দেওয়া শুরু করলে পুলিশ ও সেনাসদস্যরা ঘটনাস্থলে এসেছিল বলে জানান নির্মল।
“সেনাবাহিনীর কয়েকজন এসেছিল, থামাতে চেষ্টা করেছে কিছুটা, কিন্তু থামাতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছিল।”
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতির মধ্যে এত বাড়িতে আগুন দিতে কীভাবে পেরেছিল হামলাকারীরা, তা নিয়ে প্রশ্ন এই পাহাড়ির মনে।
পাহাড়িদের ঘর পোড়ানোর ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে একটি মামলা করেছে; তাতে ১৫ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা আরও ৪শ জনকে আসামি করা হয়েছে বলে লংগদু থানার ওসি মোমিনুল ইসলাম জানিয়েছেন।
শনিবার সকালে কার সহায়তায় জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এলেন- জানতে চাইলে নির্মল বলেন, “সকালে চেয়ারম্যানকে ফোন দিয়েছিলাম। তিনি বললেন, এখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে আলোচনা হবে। এই কথা শুনে আমি সব দেখতে বেরিয়ে এসেছি।”
তবে অনেকে এখনও জঙ্গলেই লুকিয়ে রয়েছেন জানান তিনি।
“আমার বলার কোনো ভাষা নাই। আমার মা হাঁটতে চলতে পারে না। এমন অনেক বৃদ্ধ-শিশুকে নিয়ে গতকাল কীভাবে যে কী করেছি, নিজেও জানি না।”