তিস্তার বদলে পশ্চিমবঙ্গের ছোট ছোট চারটি নদীর পানি বাংলাদেশের সঙ্গে ভাগাভাগির যে প্রস্তাব মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দিয়েছেন তাতে আগ্রহী নয় ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার।
Published : 10 Apr 2017, 01:05 PM
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এবিষয়ে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া না দেওয়া হলেও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও শেখ হাসিনার মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর যে যৌথ বিবৃতি দেওয়া হয়েছে, তাতে মমতার প্রস্তাবের কোনো উল্লেখ নেই।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এসব ছোট নদী থেকে বাংলাদেশের উত্তরের জেলাগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় পানি সরবরাহ সম্ভব নয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই কর্মকর্তা বলেন, “১৯৮০ দশক থেকে আমরা তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা করে আসছি। তাদের প্রত্যাশা আছে এবং পশ্চিমবঙ্গসহ সব বিষয় বিবেচনায় নিয়েই আমরা ২০১১ সালে চুক্তির বিষয়টি চূড়ান্ত করেছি।”
ওই কর্মকর্তা বলেন, শুকনো মৌসুমে শুকিয়ে যায় বলে তিস্তার পানি বাংলাদেশকে দেওয়া সম্ভব নয় বলে তোরশা, মানসী, জলঢাকা ও রায়ঢাকা- এই চারটি ছোট নদীর পানি ভাগাভাগির প্রস্তাব দিয়ে মমতা বিস্ময় ছড়িয়ে দিয়েছেন।
“যেহেতু তিস্তা বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত এবং এটাই উত্তর বাংলা অববাহিকার সবচেয়ে বড় নদী, তাই এই নদীর পানির ভাগ অবশ্যই বাংলাদেশকে দিতে হবে। এখন পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থের কথা বিবেচনা করে চুক্তির রূপরেখা নিয়ে কিছু কাজ করা যেতে পারে। কিন্তু আমরা কীভাবে বরতে পারি, বড় এই নদীকে পানি বণ্টনের হিসাবের বাইরে রাখতে হবে।”
মমতার প্রস্তাব যাতে ‘কোনো সংশয় সৃষ্টি না হয়’ সেজন্য এই বার্তা বাংলাদেশকে দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
ওই কর্মকর্তা বলেন, মমতার বিরোধিতায় মাথা না দিয়ে তিস্তা চুক্তি এগিয়ে নিতে বদ্ধপরিকর প্রধানমন্ত্রী মোদী।
“সে কারণেই তিস্তা নিয়ে সমাধান বের করবেন বলে মমতার উপস্থিতিতে শেখ হাসিনাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি। যৌথ বিবৃতিতেও তার প্রতিফলিত হয়েছে। সেখানে মমতার প্রস্তাব নিয়ে কিছু নেই। তাই আমরা মোটেই সেগুলো নিয়ে ভাবছি না। আমরা তিস্তা চুক্তি নিয়েই কাজ করব, ” বলেছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই কর্মকর্তা।
শনিবার নয়া দিল্লির হায়দরাবাদ হাউজে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা হয়।
পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ে ওই কর্মকর্তা বলেন, তিস্তা ছাড়াও আরও সাতটি অভিন্ন নদী নিয়ে তাদের কাজ শুরু করতে বলেছেন মোদী।
“আগের মতো একবার একটা নদী নিয়ে নয়, তিনি এই বিষয়টি সমন্বিতভাবে সমাধান করতে চান। সব বড় নদী নিয়েই প্রধানমন্ত্রী আমাদের কাজ করতে বলেছেন, যাতে বাংলাদেশের কোনো অভিযোগ না থাকে।
“বাংলাদেশের মতো বিশ্বস্ত মিত্রকে অনর্থক অপেক্ষায় রাখতে চান না মোদী। তার কথা সোজাসাপ্টা- আমরা যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি তা দ্রুত করে ফেলতে হবে।”
প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের কর্মকর্তারা বাংলার কর্মকর্তাদের বলেছেন, বাংলাদেশে পানি প্রবাহ ক্ষতিগ্রস্ত না করে শুকনো মৌসুমের জন্য পশ্চিমবঙ্গে পানি সংরক্ষণের জন্য জলাধার নির্মাণের বিষয়টি কেন্দ্র বিবেচনা করতে পারে।
কিন্তু তারা বলেছেন, তিস্তা নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি একটি সার্বভৌম প্রতিশ্রুতি এবং তা রক্ষা করতে হবে।
এর মধ্যে তিস্তা বাদ দিয়ে চারটি ছোট নদী পানি প্রস্তাব করায় মমতার সমালোচনায় মুখর হয়েছেন বিজেপি, কংগ্রেস ও বাম রাজনীতিবিদর; ভারতের গণমাধ্যমও ছাড় দেয়নি।
শনিবার সন্ধ্যায় নয়া দিল্লির রাষ্ট্রপতি ভবনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের পর বেরিয়ে এসে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, তার প্রস্তাব তিনি শেখ হাসিনাকে ‘বুঝিয়ে বলেছেন’।
বাংলাদেশের মতো ঘনিষ্ঠ মিত্রের কাছে প্রধানমন্ত্রী যখন প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তখন হঠাৎ করে ‘সম্পূর্ণ নতুন একটি প্রস্তাব’ তোলায় মমতার সমালোচনা করেন বিজেপি সরকারের শিল্প প্রতিমন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়।
গায়ক থেকে রাজনীতিক বনে যাওয়া বাঙালি এমপি বলেন, “এটা শুধু অভাবিতই নয়, দুর্ভাগ্যজনকও।”
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবার ভারত সফরে স্বাগত জানানোর দায়িত্বে ছিলেন সুপ্রিয়।
“এতগুলো চুক্তি ও ঋণ সহায়তা বাড়ানোর পর যে ইতিবাচক মেজাজ তৈরি হয়েছে তা এই একটা প্রস্তাবই নষ্ট করে দিয়েছে।”
“তিনি করার চেষ্টা করছেন? এতগুলো বছরেও তিনি কেন এসব এবিষয় তুললেন না? কংগ্রেস সরকার তিস্তা নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা চালিয়েছিল, এখন মোদী এটা বাস্তবায়নের চেষ্টা করছেন। তাহলে কেন সংশয় সৃষ্টি করা।”
তার সঙ্গে সুর মিলিয়ে বামপন্থী রাজনীতিক সাংসদ মোহাম্মদ সেলিম ও পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা এমপি সিপিআই (এম) নেতা সুজন চক্রবর্তী অভিযোগ তুলেছেন, মমতা সম্ভবত অন্য কোনো জায়গোয় গোপন কোনো দরকষাকষির খোঁজে আছেন।
সুজন বলেন, “ মমতা যদি তিস্তার বিষয়ে তাকে বিবেচনায় নিতে কেন্দ্রের উপর চাপ দেন, তাহলে বাংলার বিরোধীদের সঙ্গে আলোচনা না করে ছোট নদীগুলোর বিষয়ে প্রস্তাব দিতে পারেন?
“সারদা ও নারদার মতো দুর্নীতির মামলায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে তিনি এখন মোদীর একটা সমঝোতা চান। আর তাই ছোট নদীগুলোর কথা তুলেছেন দিয়েছেন।”
এমপি সেলিমের ধারণা, তিস্তার বিষয়ে দরকষাকষির পেছনে মমতার অন্য বিবেচনা আছে।
“মোদীর কাছ থেকে বড় কিছু পাওয়ার জন্য তার এই বিরোধিতা।”
পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির শীর্ষ নেতা কৈলাশ বিজয়বর্গীয় বলেন, ‘ফেডারেল ব্যবস্থায় সহযোগিতার’ চেতনা অক্ষুণ্ণ রেখে মোদী তার সঙ্গে আলোচনা করেছেন এবং হাসিনার সফরকালে তাকে যথাযোগ্য গুরুত্বও দিয়েছেন।
“তাই বলে তিনি নিজের খায়েশ ও হিসাব-নিকাশ মেটাতে ভারতকে জিম্মি করতে পারেন না। মোদীর ধৈর্য পরীক্ষা করা তার উচিত হবে না।”
খোলনলচে বিশ্লেষণ করে পশ্চিমবঙ্গের শীর্ষ বাংলা দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা মমতার প্রস্তাবকে নিয়ে ব্যঙ্গ করে বলেছে, “ছোট নদীগুলোর অববাহিকা ছোট। তিস্তাতে থেকে যে পরিমাণ আসে এই সবগুলো নদী মিলেও তা হবে না।”
হাসিনার সফরের বিষয়ে প্রকাশিত নিবন্ধে ভারতের বেশিরবাগ পত্রিকা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে ‘অত্যন্ত বিশ্বস্ত মিত্র’ হিসেবে বর্ণনা করেছে। ‘তিনি ভারতের জন্য অনেক কিছু করেছেন’ উল্লেখ করে এখন তার প্রতিদানের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
ইন্ডিয়া টুডে টিভি হাসিনাকে নিয়ে ৩০ মিনিটের প্রোগ্রাম করেছে, যেখানে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব কৃষ্ণন শ্রীনিবাসন স্পষ্ট ভাষায় বলেন, ‘তাকে ফেলে দেওয়া যাবে না’।
তিনি বলেন, “আমরা যদি এই পানি চুক্তি দ্রুত করতে না পারি, তাহলে তিনি ব্যাপক ক্ষোভের মুখে পড়বেন এবং সেটা আমাদের জন্য মোটেই সুবিধাজনক হবে না।”