পুলিশ কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান ও তার স্ত্রী স্বপ্না রহমান হত্যা মামলায় মৃত্যদণ্ডপ্রাপ্ত তাদের মেয়ে ঐশী রহমানের বক্তব্য শোনার পর আদালত বলেছে, এই তরুণীর মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে চিকিৎসকদের প্রতিবেদনে গুরুত্ব দিচ্ছেন তারা।
Published : 10 Apr 2017, 12:31 PM
আদালতের নির্দেশে কারাগার থেকে সোমবার সকালে হাই কোর্টে হাজির করা হয় ঐশীকে। এরপর উভয় পক্ষের দুই আইনজীবীর উপস্থিতিতে বিচারকের খাসকামরায় প্রায় ১৫ মিনিট ধরে তার বক্তব্য শোনে হাই কোর্ট।
পরে ডেথ রেফারেন্স ও ঐশীর আপিলের উপর শুনানিতে আদালত বলে,আইনি ক্ষমতাবলেই তারা এই পর্যায়ে এসে আসামির বিষয়ে এই পদক্ষেপ নিয়েছেন।
ঐশী কী বলেছেন, তা প্রকাশ না করে আদালত বলে, ঐশীর মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের দেওয়া প্রতিবেদন গুরুত্ব দিচ্ছি।
ঐশী রহমানের মানসিক অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য গত ৩ এপ্রিল তাকে আদালতে হাজিরের নির্দেশ দিয়েছিল বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম ও বিচারপতি মো. জাহাঙ্গীর হোসেনের হাই কোর্ট বেঞ্চ।
সে নির্দেশ অনুযায়ী সোমবার সকাল পৌনে ১০টার দিকে ঐশীকে আদালতে হাজির করে কারা কর্তৃপক্ষ। তাকে আদালত কক্ষে একটি চেয়ারে বসতে দেওয়া হয়।
সাড়ে ১০টার দিকে দুই বিচারপতি এজলাসে বসেন। এসময় আদালত কক্ষে উপস্থিত আইনজীবী ও সংবাদ মাধ্যমের কর্মীসহ উপস্থিত সবাই উঠে দাঁড়ালে ঐশীও উঠে দাঁড়ান। কিন্তু সে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছিলেন না।
সকাল ১০টা ৪০ মিনিট পর্যন্ত এজলাস কক্ষের ওই চেয়ারেই বসে ছিলেন ঐশী। তার ডান হাতে ছিল ইনহেলার (শ্বাসকষ্ট নিরাময়কারী স্প্রে)। সালোয়ার-কামিজ পরা ঐশীর পাশেই দাঁড়ানো ছিলেন দুজন নারী কারারক্ষী।
এরপর ঐশীকে আদালতের নির্দেশে বিচারপতির খাসকামরায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল আতিকুল ইসলাম সেলিম ও ঐশীর আইনজীবী সুজিত চ্যাটার্জীর উপস্থিতিতে ঐশীর কথা শোনেন দুই বিচারক।
ঐশীকে খাস কামরায় নেওয়ার আগে আদালত বলে, একটি মানবাধিকার সংস্থা বা একজন কর্মী ঐশীর মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য রিট আবেদন করেছিলেন। এরপর আদালতের নির্দেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে তার মানসিক অবস্থা পরীক্ষা করে প্রতিবেদন দেওয়া হয়। এ প্রতিবেদন বিচারিক আদালতে উপস্থাপন করা হয়েছে। আসামিপক্ষ এখন সেই প্রতিবেদনকে গুরুত্ব দিচ্ছেন।
আইনজীবীরা ২০১৪ সালের ২৬ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঐশীর মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে দেওয়া প্রতিবেদন তুলে ধরে বলেন, এ রিপোর্ট অনুযায়ী ঐশী মানসিকভাবে অসুস্থ। এমনকি বংশেও মানসিক অসুস্থতার উদাহরণ আছে। ঐশীর দাদী ও মামাও মানসিক রোগী ছিলেন। ফলে বংশগত প্রভাব তার মধ্যে রয়েছে।
ঐশী যতক্ষণ আদালত কক্ষে বসা ছিলেন প্রায় পুরো সময়টাই গালে ডান হাত রেখে মাথা নিচু করে ছিলেন। এসময় তাকে কাঁদতেও দেখা যায়। বারবারই চোখ মুছছিলেন তিনি।
ঐশীকে দেখার জন্য এজলাস কক্ষে ভিড় করেছিলেন সুপ্রিম কোর্টের বিভিন্ন শাখার কর্মচারী ও আইনজীবীরা। এক পর্যায়ে আদালত আইনজীবী, সাংবাদিক ও নিরাপত্তাকর্মীসহ আদালত সংশ্লিষ্ট ছাড়া অন্যদের বের করে দেওয়ার নির্দেশ দেয়। এমনকি আদালত কক্ষের দরজা-জানালাও বন্ধ করে দেওয়া হয়।
এজলাস কক্ষ থেকে বিচারকের খাসকামরায় নেওয়ার সময় ঐশী তার এক আত্মীয়ের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন।
পরে সাংবাদিকরা ঐশীর আত্মীয় ওই ব্যক্তির নাম-পরিচায় জানতে চাইলে বিস্তারিত কিছু না বলে তিনি বলেন, “আমি তার কাছের চাচার মতোন।”
আদালত বক্তব্য শোনার পর ১০টা ৫৭ মিনিটে খাস কামরা থেকে ঐশীকে সরাসরি কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়।
ঐশী চলে যাওয়ার পর দুই বিচারক কিছু সময় পর আবার এজলাসে বসেন। এরপর রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষের যুক্তি শোনেন। ঐশীর পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট আফজাল এইচ খান ও সুজিত চ্যাটার্জি। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল আতিকুল ইসলাম সেলিম।
ঐশীর পক্ষে আইনজীবীরা বিভিন্ন মামলার নজির উপস্থাপন করে বলেন, এ মামলায় কোনোভাবেই তার মৃত্যুদণ্ড হতে পারে না। ঐশীর মৃত্যুদণ্ডের সাজা নিশ্চিত করার জন্য তদন্ত কর্মকর্তা বিভিন্ন ডকুমেন্ট বানিয়েছেন। সাজানো সাক্ষী আনা হয়েছে। বাদীর সাক্ষ্য ও জন্ম সনদ অনুযায়ী ঘটনার সময় ঐশীর বয়স ১৮ বছরের নিচে (জন্ম ১৯৯৬ সাল) হলেও তদন্ত কর্মকর্তা তাকে পূর্ণ বয়স্ক প্রমাণের জন্য ডকুমেন্ট বানিয়ে আদালতে উপস্থাপন করেছেন।
বন্ধু আসাদুজ্জামান জনির কাছে ঐশী বাবা-মাকে মেরে ফেলার ইচ্ছা জানানোর পর ওই তরুণ ‘মেরে ফেল’ বলার বিষয়টি ধরে ঐশীর মৃত্যুদণ্ড হলেও জনিকে খালাস দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলেন আইনজীবীরা।
রাজধানীর চামেলীবাগে নিজেদের বাসা থেকে ২০১৩ সালের ১৬ আগস্ট এসবি কর্মকর্তা মাহফুজ ও তার স্ত্রী স্বপ্নার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। মাহফুজের ভাই মশিউর রহমান পরদিন পল্টন থানায় হত্যা মামলা করেন।
পর দিনই নিহত দম্পতির মেয়ে ঐশী পল্টন থানায় আত্মসমর্পণ করে তার বাবা-মাকে নিজেই খুন করার কথা স্বীকার করেন।
আলোচিত এ মামলায় ২০১৫ সালের ১২ নভেম্বর ঢাকার একটি আদালত ঐশীকে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেয়। রায়ের কপি ওই বছরের ১৯ নভেম্বর হাই কোর্টে পৌঁছে। এরপর প্রধান বিচারপতির নির্দেশে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন দ্রুত মামলার পেপারবুক প্রস্তুত করে।
এরপর শুনানির জন্য গত বছরের ৩০ নভেম্বর কার্যতালিকায় আসলেও গত ১২ মার্চ হাই কোর্টে এ হত্যা মামলার শুনানি শুরু হয়। উভয় পক্ষই যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ করেছে। এখন আসামিপক্ষের পাল্টা যুক্তিতর্ক চলছে।
আদালত পরবর্তী শুনানির জন্য তারিখ নির্ধারণ করে দেয়নি। তবে আইনজীবীদের বলেছেন কার্যতালিকা অনুসরণ করতে। এ সপ্তাহে কার্যতালিকায় না এলে অবকাশের পর শুনানি হবে।