মৌলভীবাজারের নাসিরপুরের মতো বড়হাটের জঙ্গি আস্তানায় অভিযান শেষে তিনজনের লাশ পাওয়া গেছে; পালাতে না পেরে তারা নিজেরাই বিস্ফোরণ ঘটায় বলে পুলিশ জানিয়েছে।
Published : 01 Apr 2017, 10:03 AM
সিলেটে বোমার বিস্ফোরণে মৌলভীবাজারের জঙ্গিরা: আইজিপি
নাসিরপুরের আস্তানায় ‘সাত-আটটি’ ছিন্নভিন্ন দেহ
শনিবার দুপুর ১২টায় সংবাদ সম্মেলনে এসে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম প্রায় ৮০ ঘণ্টার অভিযান শেষের ঘোষণা দেন।
সোয়াট ও কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের এই অভিযানটির নাম দেওয়া হয় ‘অপারেশন ম্যাক্সিমাস’; এর প্রায় ১৮ কিলোমিটার দূরে নাসিরপুরের অভিযানটির নাম ছিল ‘অপারেশন হিট ব্যাক’।
সিলেটের দক্ষিণ সুরমায় এক সপ্তাহ আগের আরেক জঙ্গি আস্তানায় অভিযানের সূত্র ধরেই মৌলভীবাজারের এই দুটি বাড়ির সন্ধান পাওয়া যায় বলে পুলিশের ভাষ্য।
জেলা পুলিশের সহায়তায় সোয়াট ও কাউন্টার টেররিজম ইউনিট বড়হাটের এবং নাসিরপুরের বাড়ি দুটি ঘেরাও করেছিল গত বুধবার ভোরে। এই দুটি বাড়ির মালিকই যুক্তরাজ্য প্রবাসী একটি পরিবার।
নাসিরপুরের ওই বাড়িতে বৃহস্পতিবার অভিযান শেষে নারী-শিশুসহ সাতজনের ছিন্নভিন্ন লাশ পাওয়া যায়। ঘেরাওয়ের মুখে পালাতে না পেরে জঙ্গিরা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নিজেদের উড়িয়ে দেয় বলে পুলিশের ভাষ্য।
নাসিরপুরে অভিযান শেষে শুক্রবার সকালে বড়হাটের আবুশাহ দাখিল মাদ্রাসা গলির ডুপ্লেক্স বাড়িটিতে চূড়ান্ত অভিযান ‘অপারেশন ম্যাক্সিমাস’ শুরু হয়।
সিলেট-মৌলভীবাজার সড়কের আধা কিলোমিটারের মধ্যে এই বাড়িতে অভিযান শুরুর পর থেকে গুলি-বিস্ফোরণের শব্দ আসতে থাকে। বৈরী আবহাওয়ার কারণে সন্ধ্যায় অভিযানে বিরতি দেওয়া হয়।
শনিবার সকালে ফের অভিযান শুরুর ঘণ্টা তিনেকের মধ্যে সাংবাদিকদের সামনে এসে মনিরুল ‘অপারেশন ম্যাক্সিমাস’র আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘোষণা করে বলেন, “আমরা জানতে পেরেছিলাম যে এখানে তিনজন অবস্থান করছে, দুইজন পুরুষ ও একজন মহিলা।
“আমরা ভবনে প্রবেশ করেছি। আমরা এখানে তিনটি ডেডবডি দেখেছি। দুজন পুরুষ এবং একজন মহিলা। আমাদের তথ্য ছিল যে তিনজন রয়েছে, সেই তিনজনকেই আমরা পেয়েছি।”
নিহত তিনজনের নাম-পরিচয় পাওয়া না গেলেও তাদের মধ্যে পুরুষ এক ব্যক্তি সিলেটে বোমা হামলার ঘটনায় ‘সরাসরি জড়িত’ ছিলেন বলে দাবি করেন তিনি।
“আমরা টেকনোলজি ব্যবহার করে দেখেছি, এখান থেকে গিয়ে ওখানে তারা ঘটিয়ে আবার এখানে ফেরত আসতে পেরেছিল। আমরা বুঝতে পেরেছিলাম যে, এখানে শক্তিশালী বোমাসহ বেশকিছু এক্সপ্লোসিভ এবং এক্সপ্লোসিভ এক্সপার্ট এবং এ ধরনের কাজে একজন অন্তত খুব হাই লেভেলের না হলেও আপার মিড লেভেলের জঙ্গি এখানে রয়েছে।”
এখানে নিহত একজন সিলেটে বিস্ফোরণের নেতৃত্বে ছিলেন দাবি করে মনিরুল বলেন, তার সহযোগী ছিল এবং এখানে নিহত অন্যজন সেই সহযোগী হতে পারে, অন্য কেউও হতে পারেন।
দক্ষিণ সুরমায় জঙ্গি আস্তানায় সেনা কমান্ডোদের অভিযান চলার মধ্যে পাশের এলাকায় জোড়া বোমা বিস্ফোরণে র্যাবের গোয়েন্দা শাখার প্রধান, দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ সাতজন নিহত হন।
মনিরুল বলেন, “তাদের (র্যাব-পুলিশসহ সাতজন) হত্যাকাণ্ডের জন্য এরা দায়ী।
“তাদেরকে হত্যার যে তাৎক্ষণিক বিচার সেটি হয়ত ন্যাচারালি হয়ে গেছে। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল তাদের (জঙ্গি) ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলানো, সেটা আমরা পারেনি।”
জঙ্গিদের জীবিত উদ্ধারের চেষ্টা সফল না হওয়ার জন্য তাদের আত্মঘাতী প্রবণতার দিকে ইঙ্গিত করেন মনিরুল।
তিনি বলেন, “জীবিত ধরার ইচ্ছা ছিল, তাদের সারেন্ডার করতে বলা হয়েছিল। তারা সারেন্ডার না করে উল্টা আমাদেরকে.. আপনারা বিস্ফোরণের শব্দ শুনেছেন কাল অনেকবার, যখন আমরা তাদের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করেছি, তখন তারা ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। শক্তিশালী বিস্ফোরণের পর আমরা ভবনে ধোঁয়া উড়তে দেখেছি। তখন (শুক্রবার) ধারণা ছিল যে ভবনে আগুন ধরে গেছে।
“আজকে যখন আমরা নিশ্চিত হলাম যে তারা অভিযানে নিহত হয়েছে তখন আমার ভেতরে ঢুকলাম।”
অভিযান শুরুর পর শুক্রবার সকালে বেশ কিছুক্ষণ গুলি চলে। বাড়িটি থেকে ধোঁয়া উড়তেও দেখা গিয়েছিল। দুপুরে তিন দফা বিস্ফোরণের শব্দও পাওয়া যায়।
সিলেটের ঘটনার অভিজ্ঞতা নিয়ে ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে সতর্কতার সঙ্গে অভিযান চালানোর কারণে সময় লেগেছে বলে জানান পুলিশের এই কর্মকর্তা।
তিনি বলেন, “তারা বিভিন্ন জায়গায় এক্সপ্লোসিভ সেট করে রেখেছিল। প্রথম দিন পরশু এক মহিলা দুটি গ্রেনেড ছুড়ে মেরেছিল। একটি বিস্ফোরিত হয় এবং একটি ধানক্ষেতে পড়েছিল। সোয়াট সদস্যরা সতর্কতার সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছিল।”
শনিবার সকালে এই অভিযান শুরুর আগে মৌলভীবাজারের পুলিশ সুপার মো. শাহজালালও সাংবাদিকসহ সবাইকে সতর্ক থাকতে পরামর্শ দিয়েছিলেন।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সাংবাদিকসহ সবাইকে সতর্ক থাকার জন্য বলা হয়েছে। যে কোনো সময় যে কোনো ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।”
জেলা শহরের বিভিন্ন স্থানেও টহলের পাশাপাশি তল্লাশি চালাতে দেখা যায় পুলিশকে। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের প্রবেশ পত্র নিতে পুলিশি সহযোগিতায় বাড়ি থেকে বের হতে দেখা যায়।
অভিযান পরিচালনাকারীদের পাশাপাশি স্থানীয় বাসিন্দারাসহ সবার নিরাপত্তার খাতিয়ে সতর্কতার সঙ্গে অভিযান পরিচালনা করা হয় বলে জানান মনিরুল। কষ্ট স্বীকারের জন্য স্থানীয়দের ধন্যবাদও জানান তিনি।
১৪৪ ধারা জারি এবং গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে চালানো অভিযানের কারণে টানা চার দিন ধরে বিভিন্ন ভবনে যারা আটকা পড়েন, পৌরমেয়র ফয়জুর রহমান সকাল থেকে তাদের খোঁজখবরও নিচ্ছিলেন।
ফয়জুর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কেউ কোনো সমস্যার কথা বলেনি। তারা বলেছে, কোনো সমস্যা নেই। এখন পর্যন্ত তারা ভালো আছেন। তারা বলেছেন, তাদের আরও কষ্ট হলেও দেশ জঙ্গিমুক্ত হোক।”
অভিযান শেষের পর বড়হাট এলাকায় রাস্তাঘাটে আতঙ্ক কাটিয়ে চলাচল বেড়েছে মানুষের, বিভিন্ন বাড়ির দরজা-জানালাও খুলতে শুরু করেছে।
বাড়িটি এখনও ঘিরে আছে পুলিশ সদস্যরা। লাশগুলো হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।