তিন দিনের অভিযানে সিলেটের দক্ষিণ সুরমায় জঙ্গি আস্তানার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে সেনাবাহিনীর কমান্ডো দল; সেখানে চারটি লাশ পাওয়ার কথা জানিয়েছে তারা।
Published : 27 Mar 2017, 07:46 PM
‘আতিয়া মহল’ নামে পাঁচতলা ওই ভবনের কাছে পাঠানপাড়া মসজিদের কাছে সোমবার সন্ধ্যায় সাংবাদিকদের সামনে ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’র সর্বশেষ অবস্থা জানান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ ফখরুল আহসান।
ওই বাড়িতে তিন পুরুষ ও এক নারী জঙ্গির থাকার তথ্য পুলিশের কাছ থেকে পেয়েছিলেন জানিয়ে তিনি বলেছেন, তারা যে চারটি লাশ পেয়েছেন, তার মধ্যেও তিনজন পুরুষ ও একজন নারী।
ভেতরে অবস্থানরত সম্ভাব্য সব জঙ্গি নিহত হলেও তারা বাড়িটিতে ব্যাপক বিস্ফোরক মজুদ করে রেখেছিল জানিয়ে ব্রিগেডিয়ার ফখরুল বলেন, অভিযান এখনও শেষ হয়নি।
পুলিশ ও র্যাব ঘিরে রাখার একদিন পর শনিবার সকালে সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডো ব্যাটালিয়নের অভিযান শুরুর পর সামরিক গোয়েন্দা পরিদপ্তরের পরিচালক ফখরুলই প্রতিদিন নিয়মিত সাংবাদিকদের ব্রিফ করে আসছেন।
সোমবার সকাল থেকে থেমে থেমে গুলি ও বিস্ফোরণ এবং দেয়াল ভেঙে বাড়িতে কমান্ডোদের অভিযানের পর সন্ধ্যায় সাংবাদিকদের সামনে উপস্থিত হয়েই তিনি অভিযান শেষের কাছাকাছি বলে ইঙ্গিত দেন।
সেনা সদর দপ্তরের কর্মকর্তা ফখরুল বলেন, “দুঃসাহসিক অভিযানের জন্য আমরা সকলেই গর্বিত। আপনারও গর্ববোধ করতে পারেন। দেশবাসীর দোয়ায় এখন পর্যন্ত কোনো ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই খুব সুন্দর, সফলভাবে অভিযানটা চলেছে।”
একই সময় ঢাকার কমলাপুরে এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেন, “আমি যতটুকু জানি, অভিযান প্রায় শেষের দিকে, যে কোনো সময় শেষ হতে পারে।”
পাঁচ তলা ওই ভবনের নিচ তলায় চারটি লাশ পাওয়ার কথা জানিয়ে ব্রিগেডিয়ার ফখরুল বলেন, “পুলিশের যে গোয়েন্দা তথ্য পেয়েছিলাম, মোটামুটি তথ্য ছিল যে এখানে চারজন জঙ্গি আছে। এটাও তথ্য ছিল যে তিনজন পুরুষ ও একজন মহিলা। যে ডেডবডি আমরা পেয়েছি তার মধ্যে তিনজন পুরুষ, একজন মহিলা।”
দুটি লাশ পুলিশের কাছে তুলে দেওয়া হলেও বাকি দুটি এখনও ওই বাড়ির ভেতরেই রয়েছে।
ব্রিগেডিয়ার ফখরুল বলেন, “বাকি দুটো ডেডবডির মধ্যে সুইসাইড ভেস্ট লাগানো আছে। যে অবস্থায় আছে, তাদেরকে ওইখান থেকে বের করাটা খুব ঝুঁকিপূর্ণ। এই ডেডবডিগুলো কীভাবে বের করব, সেজন্য আমরা পরিকল্পনা করছি।”
আগের দিনই দুই জঙ্গির নিহত হওয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেছিলেন, “দুজনকে দৌড়ানো অবস্থায় দেখে আমাদের কমান্ডোরা ফায়ার করে। তারা পড়ে যাওয়ার পর একজন সুইসাইড ভেস্ট বিস্ফোরণ ঘটায়।”
এই আস্তানায় জঙ্গিদের শীর্ষ কোনো নেতা থাকতে পারেন বলে ধারণার কথা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামালও জানিয়েছিলেন।
নিহতদের মধ্যে তেমন কেউ রয়েছে কি না- প্রশ্ন করা হলে সেনা কর্মকর্তা ফখরুল বলেন, তা পুলিশ ও র্যাব দেখে নিশ্চিত করতে পারবে।
তবে তিনি বলেন, “যে চারজন এখানে ছিল, তারা ওয়েল ট্রেইন্ডড। তাদেরকে খুঁজে বের করে যে নিষ্ক্রিয় করা হল বা হত্যা করা হলো, তা সেনাবাহিনীর জন্য বিশাল বড় সফলতা।”
চারজনের বাইরে আর কারও থাকার সম্ভাবনা রয়েছে কি না-এই প্রশ্নে তিনি বলেন, “চারজনের বিষয়ে আমরা জানতাম, চারটা ডেডবডি আমরা পেয়েছি। যতটুকু ধারণা হচ্ছে, এখানে জীবিত আর কেউ নাই। তবে কেউ হঠাৎ করে থেকেও যেতে পারে।”
নিচ তলার একটি ফ্ল্যাটেই কাউছার আলী ও মর্জিনা বেগম নামে এক দম্পতি তিন মাস আগে ওঠেন বলে জানান বাড়ির মালিক উস্তার আলী। ওই দম্পতিকে জঙ্গি বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। অভিযান শুরুর পর প্রথম দিন পুলিশের আহ্বানে তাদের সাড়াও দেখা গিয়েছিল।
ওই বাড়িটির নানা স্থানে বিস্ফোরক স্থাপন করে জঙ্গিরা তা দুর্গম করে তুলেছিল বলে আগের দিনই জানিয়েছিলেন ব্রিগেডিয়ার ফখরুল। সেজন্য অভিযানটি ঝুঁকিপূর্ণও বলেছিলেন তিনি।
সোমবার তিনি বলেন, “সার্বিক যে অবস্থাটা দেখলাম, যে একটা রুমের ভেতরে একটা ডেডবটি, তার পাশেই ছড়ানো ছিটানো আইইডি লাগানো রয়েছে।
“পুরো বিল্ডিংটায় যে পরিমাণ এক্সপ্লোসিভ আছে এগুলো যদি বিস্ফোরণ হয় তাহলে এই বিল্ডিংয়ের অংশ বিশেষ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। যে অবস্থায় আছে, এটা খুব ঝুঁকিপূর্ণ এবং সতর্কতার সঙ্গে কাজ করতে হচ্ছে।”
দুপুরের পর ধোঁয়া ওড়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এখানে যে পরিমাণ ফায়ারিং হয়েছে, গ্রেনেড চার্জ করা হয়েছে, ভেতরে বাসিন্দাদের লেপ-কাঁথায় আগুন ধরাটা অস্বাভাবিক কিছু না। যে কোনোভাবে আগুন লাগতেই পারে। আমরা আগুন নিভিয়েছি।”
অভিযান শেষ হয়নি জানিয়ে ব্রিগেডিয়ার ফখরুল বলেন, “এই অপারেশনে আরও হয়ত কিছু সময় লাগতে পারে। আমাদের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা বাকি কাজটুকু এগিয়ে নিয়ে যাব।”
অভিযান শেষে উস্তার আলীর মালিকানাধীন এই বাড়িটি সেনবাহিনী পুলিশের কাছে হস্তান্তর করবে বলে জানান এই সেনা কর্মকর্তা।
গত বৃহস্পতিবার গভীর রাতে জঙ্গি আস্তানা সন্দেহে শিববাড়ি পাঠানপাড়ার ওই ভবন ঘিরে ফেলে পুলিশ। পরে আসে কাউন্টার টেররিজম ইউনিট ও সোয়াট। অভিযানের প্রস্তুতি শুরু করে সোয়াট এর নাম দিয়েছিল ‘অপারেশন স্প্রিং রেইন’। কিন্তু অবস্থা বেগতিক দেখে তারা পিছু হটে বলে সেনা কর্মকর্তারা জানান।
প্যারা কমান্ডো ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল ইমরুল হাসানের নেতৃত্বে সেনাঅভিযানের নাম বদলে হয় ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’।
দক্ষিণ সুরমা উপজেলার শিববাড়ি এলাকা ঘিরে গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে সেনা অভিযান শুরুর পরপরই ওই ভবনটি থেকে ৭৮ জনকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়।
গতবছর জুলাইয়ে গুলশান হামলার পর ডজনখানেক জঙ্গি আস্তানায় আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর অভিযান দেখেছে বাংলাদেশ। তার কোনোটিই এত দীর্ঘ হয়নি। গুলশান হামলার পর হলি আর্টিজান বেকারি ঘটনা ছাড়া আর কোনো অভিযানে সেনাবাহিনীকেও দেখা যায়নি।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, “অভিযান যাতে সুষ্ঠুভাবে হয় এবং প্রাণহানি কম হয়, এজন্য প্যারাকমান্ডোদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।”
আস্তানা ঘিরে সেনা কমান্ডোদের অভিযানের মধ্যেই শনিবার সন্ধ্যায় আতিয়া মহল থেকে এক কিলোমিটারের মধ্যে এক জায়গায় দুই দফা বিস্ফোরণে দুই পুলিশ সদস্যসহ ছয়জন নিহত হন।
গুলশান হামলার পর বেশ কয়েক মাস টানা অভিযানে জঙ্গি তৎপরতা স্তিমিত হয়ে পড়েছিল। তবে সম্প্রতি গাজীপুরে জঙ্গি নেতা মুফতি হান্নানকে প্রিজন ভ্যান থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টার মধ্য দিয়ে আবার প্রকাশ্য তৎপরতা দেখা যায় তাদের।
এরপর চট্টগ্রামের মিরসরাই ও সীতাকুণ্ডে অভিযানের মধ্যে গত সপ্তাহে ঢাকায় র্যাবের ব্যারাকে আত্মঘাতী হামলা চালান এক জঙ্গি। এরপর সিলেটে অভিযানের মধ্যে শাহজালাল বিমানবন্দর পুলিশ বক্সে বিস্ফোরণে নিহত হন আরেকজন।
ওই দুটি ঘটনার পর সিলেটে অভিযানের মধ্যে বোমার হামলার দায় স্বীকার করে আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠী আইএসের নামে বার্তা এসেছে ইন্টারনেটে।
তবে আগের মতোই সরকারের পক্ষ থেকে তা নাকচ করে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশে আইএসের কোনো তৎপরতা নেই। দেশীয় জঙ্গিরাই এসব হামলায় জড়িত।