অসদাচরণের জন্য উচ্চ আদালতের কোনো বিচারককে অপসারণের ক্ষেত্রে সংসদে দলীয় মতের বিপক্ষে ভোট দিতে কোনো সাংবিধানিক বাধা নেই বলে মনে করেন আইন কমিশনের চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক।
Published : 26 Apr 2016, 04:40 PM
তিনি বলছেন, এসব ক্ষেত্রে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের ‘ফ্লোর ক্রসিং’র বিধান প্রযোজ্য হবে না।
মন্ত্রিসভায় ‘বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট বিচারক (তদন্ত) আইন’এর খসড়া নীতিগত অনুমোদন পাওয়ার পরদিন ব্রিফিংয়ে এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে এই মত দেন সাবেক প্রধান বিচারপতি।
খসড়া আইন অনুযায়ী, কেউ সুপ্রিম কোর্টের কোনো বিচারকের বিরুদ্ধে জাতীয় সংসদের স্পিকারের কাছে লিখিত অভিযোগ করলে দশজন সংসদ সদস্যের একটি কমিটি তার প্রাথমিক সারবত্তা পর্যালোচনা করে দেখবে।
অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে সেই প্রতিবেদন পর্যালোচনার পর জাতীয় সংসদের রুদ্ধদ্বার বৈঠক হবে। সংসদ প্রয়োজন মনে করলে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি হবে। সংশ্লিষ্ট বিচারক আত্মপক্ষ সমর্থন করে কমিটির চেয়ারম্যানের কাছে লিখিত বক্তব্য দিতে পারবেন।
ওই কমিটি বিচারককে দোষী সাব্যস্ত করলে বিষয়টি সংসদে যাবে; দুই তৃতীয়াংশ এমপি ভোট দিয়ে সংশ্লিষ্ট বিচারককে অপসারণের সিদ্ধান্ত দিতে পারবেন। ওই প্রস্তাব রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হবে এবং তিনি ওই বিচারককে অপসারণ করবেন।
আইন কমিশনের ব্রিফিংয়ে এক সাংবাদিক জানতে চান, বিচারক অপসারণের ক্ষেত্রে কোনো সাংসদ দলের বিপক্ষে ভোট দিলে ‘ফ্লোর ক্রসিং’ হবে কি না।
জবাবে বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক বলেন, “আমারতো মনে হয়, হবে না। আর্টিকেল ৭০ এ রকম কিছু বলে নাই।”
কখন একজন সংসদ সদস্যের আসন শূন্য হয়ে যাবে, সেই বিধান রয়েছে বাংলাদেশের সংবিধানের এই অনুচ্ছেদে।
বাংলাদেশ সংবিধান: অনুচ্ছেদে ৭০
কোন নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরুপে মনোনীত হইয়া কোনো ব্যক্তি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হইলে তিনি যদি-
(ক) উক্ত দল হইতে পদত্যাগ করেন (resigns from that party)
অথবা,
(খ) সংসদে উক্ত দলের বিপক্ষে ভোটদান করেন (votes in Parliament against that party)
তাহা হইলে সংসদে তাহার আসন শূন্য হইবে, তবে তিনি সেই কারণে পরবর্তী কোনো নির্বাচনে সংসদ-সদস্য হইবার অযোগ্য হইবেন না।
ব্রিফিংয়ে সাবেক প্রধান বিচারপতির কাছে জানতে চাওয়া হয়- বিচারক অপসারণই কি তাহলে একমাত্র বিষয়, যেখানে দলের বিপক্ষে ভোট দিলে ‘ফ্লোর ক্রসিং’ এর বিধি প্রযোজ্য হবে না?
জবাবে খায়রুল হক বলেন, “এই বিষয় বলে নয়, আর্টিকেল ৭০ পড়ে দেখবেন, এই রকম কোনো ব্যাপারই নাই সেখানে।
“আর আর্টিকেল-৭০ তিন বার পরিবর্তন হয়েছে। এখন কিন্তু (পঞ্চদশ সংশোধনীতে) আবার মূল রূপে চলে গেছে। আমার একটা রায়ও আছে আর্টিকেল-৭০ নিয়ে। পারলে পড়ে নিবেন।”
২০১৪ সালে এক সাক্ষাৎকারে বিচারপতি খায়রুল হক বলেছিলেন, বর্তমান ৭০ অনুচ্ছেদ কেবল ‘দলের বিরুদ্ধে ভোট’, অর্থাৎ অনাস্থা প্রস্তাবের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে, কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় দলীয় মতোর বিরুদ্ধে যাওয়ার জন্য নয়।
সংসদে ভোটাভুটিতে কোনো বিচারককে অপসারণ করা হলে তিনি ওই সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে আদালতে যেতে পারবেন কি-না জানতে চাইলে খায়রুল হক বলেন, “আমাদের দেশের সবচেয়ে সোজা জিনিস হচ্ছে একটা মামলা দায়ের করা। চূড়ান্তভাবে কী হবে- সেটাতো কোর্ট বুঝবে, কাচারি বুঝবে। কাজেই মামলা করার কোনো বাধা থাকবে বলে মনে হয় না। কোন ভালো আইনজীবী- হি ক্যান মেইক আউট এনি পিটিশন।”
আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, কোনো বিচারকের বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন অভিযোগ করলে দুই বছরের জেল ও ৫ লাখ টাকা জরিমানা হতে পারে।
এ বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে বিচারপতি খায়রুল হক বলেন, “বিচারককে শাস্তি দেওয়া বা না দেওয়া এটা সংসদের এখতিয়ার। কিন্তু অভিযোগকারীর শাস্তি হবে তখনই, যদি দেখা যায় যে, পুরোপুরি একটা মিথ্যা অভিযোগ আনা হয়েছে।”
মিথ্যা অভিযোগের ক্ষেত্রেও আদালতের সব প্রক্রিয়া পার হতে হবে বলে মত দেন আইন কমিশনের চেয়ারম্যান।
সম্প্রতি দুই সংসদ সদস্যকে (দুই মন্ত্রী) যে বিচারকরা আদালত অবমাননার শাস্তি দিয়েছেন, সেই সাংসদের হাতে এই আইনের মাধ্যমে ‘অস্ত্র’ তুলে দেওয়া হচ্ছে কি-না, এমন প্রশ্নে বিচারপতি খায়রুল হক বলেন, এতোটা নেতিবাচক ভাবনার কোনো কারণ নাই।
“দুইজন সদস্য কোনো সিদ্ধান্ত নেবেন, তেমন তো নয়। দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাগবে। এখন সবাই যদি আমরা একসঙ্গে পাগল হয়ে যাই, তাহলে তো ঠিকই আছে, আমরাও (বাকিরা) সবাই পাগল হয়ে যাব।”
সাংসদদের হাতে এতে কোনো অস্ত্র তুলে দেওয়া ‘হচ্ছে না’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, “সংসদ সদস্যদের আপনারা এতোটা দায়িত্বহীন ভাববেন, তা আমি মানতে রাজি নই। আমাদের সংসদ সদস্যগণ, এদেশে যতো উন্নতি হয়েছে, এগুলো কিন্তু গণতন্ত্রের আমলেই হয়েছে। কোনো মার্শাল ল আমলে কিন্তু জিডিপি বাড়ে নাই।
“কোনো মার্শাল ল আমলে জনবান্ধব আইনও তৈরি হয়নি। কাজেই আমাদের রাজনীতিকদের খোঁটা দেওয়া একটা অভ্যাস হয়ে গেছে। দে আর নট দ্যাট ব্যাড। তারা কিন্তু দেশকে সামনে এগিয়েই নিয়ে যাচ্ছেন।”
সাবেক এই প্রধান বিচারপতি বলেন, ভুল সবারই থাকতে পারে, আর তা অস্বীকার করারও কোনো উপায় নেই।
“আমাদের সংসদ সদস্যদের সম্পর্কে যদি এতো রিজার্ভেশন থাকে, তাহলে কি সংসদ সদস্য আমরা বিদেশ থেকে নিয়ে আসব?”
সংসদ সদস্যদের ওপর নিজের ‘আস্থার কথা’ জানিয়ে অন্যদেরও আস্থা রাখার আহ্বান জানান খায়রুল হক।
বিচারক অপসারণে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার সংসদের হাতে যাওয়ায় সেখানে সরকারের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটার সুযোগ তৈরি হবে কি-না, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এটা নির্ভর করে কোন দেশ কতটুকু গণতান্ত্রিক তার ওপর।
“আপনার পরিবারে আপনি কতটুকু গণতন্ত্র মেইনটেইন করেন। আপনি নিজের কথা চিন্তা করেন, চোখ বন্ধ করে ভাবেন তো, কে আপনার পরিবার শাসন করে? ফিউডালিস্টিক দৃষ্টিভঙ্গিতো আমাদের বাঙালিদের আছে। এটা থেকে যতক্ষণ আমরা বেরিয়ে আসতে না পারছি, ততোক্ষণ হোঁচট খেতেই থাকব। তবে বেরিয়ে আসতে হবে।”