ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় পুরুষের পাশাপাশি দায়িত্বে আসা নারীরা দায়িত্ব পালনে পরিপক্কতার প্রমাণ দিয়েই এগিয়ে যেতে চান।
Published : 02 Feb 2016, 06:50 PM
ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় পুরুষের পাশাপাশি এগিয়ে আসছেন নারীরাও।
রাজধানীর রাস্তায় এমন দৃশ্য নতুন হলেও দায়িত্ব পালনে পরিপক্কতার প্রমাণ দিয়েই এগিয়ে যেতে চান এই নারী কর্মীরা।
তারা বলছেন, সব জায়গায় নারীরা সফল হতে পারলে ট্রাফিকে কেন নয়?
মঙ্গলবার সকালে রাজধানীর বাংলা মোটর ক্রসিংয়ে নিজের ট্রাফিক পুলিশ সার্জেন্ট হিসেবে যোগ দেওয়ার অভিজ্ঞতার কথা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন শাহানা আক্তার।
“নারীরা দায়িত্ব পালন করার সময় অনেক সাধারণ মানুষ কৌতূহলী হয়ে তাকিয়ে থাকেন। কারও গাড়ির কাগজপত্র দেখতে চাইলে শান্তভাবে কাগজ বের করে দেয় লোকজন। তারা আন্তরিকভাবে নারী সার্জেন্টদের সহায়তা করছেন।”
৬ জানুয়ারি থেকে সার্জেন্ট বাংলা মোটর, শান্তিনগর ও রূপসীবাংলা ক্রসিংয়ে দায়িত্ব পালন করে আসছেন শাহানা।
বাংলা মোটর এলাকায় ভিআইপিদের বেশ চলাচল; তাই এখানে দায়িত্ব পালনেও সতর্ক থাকতে হয় বলে জানান রাজশাহী কলেজ থেকে হিসাব বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর করা শাহানা আক্তার।
“সব বিষয়েই খুব সতর্ক থাকতে হয়। অনেক সময় নারীরা পথে পরিবহন থেকে নামার সময় পড়ে যায়, তখন তাদের সাহায্য করারও সুযোগ হয়।”
পুলিশ বাহিনীতে নারী সার্জেন্ট নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০১৪ সালে। ১ হাজার ৮৩৭ জন আবেদনকারীর মধ্যে ৪৬ জন নারী প্রার্থী আবেদন করেছিল ওই দফায়। তার মধ্য থেকে ২৮ জনকে বেছে নেওয়া হয়।
রাজশাহীর সারদায় বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমিতে প্রশিক্ষণ শেষ করে হাইওয়ে পুলিশ দুই জন, রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে দুই জন এবং খুলনা মেট্রোতে দুই জন নারী দায়িত্ব পালন করছেন। বাকি ২২ জন নিয়োগ পেয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশে।
দায়িত্ব পালনে আসার পর থেকে এই কদিনে অগ্রজরা অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ শেখাচ্ছেন বলে জানান রাজশাহীর মেয়ে শাহানা।
তিনি বলেন, “সবাই যদি আইন মানেন তাহলে শহরের ট্রাফিক জ্যাম দূর করা সম্ভব। আমরাও চেষ্টা করছি সাধ্যমতো নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে দায়িত্ব পালন করতে।”
“বাবা পুলিশে ছিলেন বলে ছোট থেকেই পুলিশের পোশাকের প্রতি একটা আকর্ষণ ছিল, দুর্বলতা ছিল, ভালবাসাও ছিল। ছোটবেলা থেকেই তাই পুলিশে যোগ দেওয়ার স্বপ্ন দেখেছি। বাবাই এ চাকরিতে যোগ দিতে সবচেয়ে বেশি প্রেরণা দেন। মা প্রথমে ভেবেছিলেন আমি এই পদে কাজ করতে পারব কিনা, পরে বাবা তাকে আশ্বস্ত করেছিলেন।”
রূপসী বাংলা মোড়ে কথা হয় একই ব্যাচে ট্রাফিক পুলিশে যোগ দেওয়া সার্জেন্ট রোজী আক্তারের সঙ্গে। টাঙ্গাইল সরকারি কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে পড়াশোনা শেষ করার পর এই পদে যোগ দিয়েছেন তিনি।
“২০১৫ সালে প্রথম যখন দেখলাম পুলিশে নারী সার্জেন্ট নেবে, তখন আবেদন করলাম। পরিবারের অনেকে প্রথমে চায়নি ট্রাফিকে যোগ দেই। তারপর ধীরে ধীরে সবাইকে বুঝিয়ে চাকরিতে যোগ দিয়েছিলাম।”
রোজীর সঙ্গে কথা বলার ফাঁকে তার দুই ব্যাচমেট কাজী সজীবুল ইসলাম ও মো. আসাদুজ্জামানও সেখানে ছিলেন।
আসাদুজ্জামান বলেন, “ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্বটা অনেক চ্যালেঞ্জের বলে মনে হচ্ছে। তবে দায়িত্ব পালন করতে গেলে কিছু সমস্যাও তৈরি হয়। বিশেষ করে সারাক্ষণ রাস্তায় থাকলে ধুলোবালি লাগে, পথে টয়লেট না থাকায় অনেক সময় সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়।”
পাশে দাঁড়ানো রোজী আক্তার বলেন, “সামনের চ্যালেঞ্জ মোবাবেলা করতে হবে নারীদের। চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে তারা প্রমাণ করবে তারা যোগ্য। সমস্যাকে বড় করে না দেখে কীভাবে সমস্যার পথ খুঁজে বের করা যায় সেই চেষ্টাটাই সবাই মিলে করা উচিত।”
তিনি জানান, তারা শিক্ষানবীশ হিসেবে প্রতিদিন একবেলা করে ডিউটি করছেন। তাদের আরেক ব্যাচমেট ময়নার ডিউটি বিকেলে শান্তিনগর এলাকায়।
সহকর্মীদের মূল্যায়ন করে সেখানে দায়িত্বপ্রাপ্ত ট্রাফিক পুলিশ সার্জেন্ট মাহবুব আলম বলেন, “নারী সার্জেন্টরা অত্যন্ত দায়িত্বশীলতা নিয়ে তাদের কাজ শিখতে চাইছে। কীভাবে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা করতে হবে, লোকজনের সঙ্গে ব্যবহার করতে হবে সেটি তাদের প্রতিদিনই বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে।”
মতিঝিল ডিভিশনের ২৪ তলা পুলিশ বক্সের সামনে দায়িত্ব পালন করছেন ট্রাফিক সার্জেন্ট পান্না আক্তার।
কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “খুব অবাক হয়ে অনেকে তাকিয়ে থাকে। প্রথমদিকে কিছুটা সংকোচ লাগতো। এখন আর ওই মানুষগুলোর দিকে তাকাই না। নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে থাকি। অনেকে জানতে চান, নারী হিসেবে আমরা কোন র্যাঙ্কে দায়িত্ব পালন করছি। ওই মানুষগুলোকে বলি, আমরা সার্জেন্ট, পুরুষরা যেমন আমরাও সেই র্যাঙ্কেই আছি।”
“অনেকে অবাক হয়ে প্রশ্ন করে আপনারা কি পারবেন? আমরা তাদের বলি- মেয়েরা সব জায়গাতেই সফলভাবে কাজ করছে, এগিয়ে যাচ্ছে। ট্রাফিক সার্জেন্ট হিসেবে আমরাও সফলভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারব।”
নেত্রকোনার মেয়ে পান্না ময়মনসিংহের আনন্দ মোহন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে সমাজকর্মে স্নাতকোত্তর শেষ করে সার্জেন্ট পদে যোগ দিয়েছেন।
“ছোটবেলা থেকেই অ্যাডভেঞ্চার ভালবাসি, চ্যালেঞ্জ নিতে ভালবাসি। তাই ট্রাফিকে যোগ দিয়েছি,” পান্নার সোজাসাপটা জবাব।
ট্রাফিক পুলিশের গুলশান ডিভিশনের সহকারী কমিশনার নুসরাত জাহান মুক্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গুলশান ডিভিশনে তিন জন শিক্ষানবীশ ট্রাফিক সার্জেন্ট কাজ করছেন। তারা হলেন, হ্যাপী, মোরশেদা ও রাবেয়া। তারা এখনও শিক্ষানবীশ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। মাঝে মাঝে গাড়ি থামিয়ে কাগজপত্র দেখছেন।”
ট্রাফিকেরে নারী সার্জেন্টদের মনোভাব যথেষ্ট ইতিবাচক বলেও জানান তিনি।
মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) খন্দকার গোলাম ফারুক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নারী সার্জেন্টরা অত্যন্ত ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে তাদের দায়িত্ব পালন করছেন। তারা দায়িত্বে নিজেদের সক্ষমতার পরিচয় দেবেন বলে আশা রাখি।”