স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ঠিক আগ মুহূর্তে বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার লক্ষ্যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর যোগসাজশে বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে ফাঁসিতে ঝুললেন তৎকালীন আলবদর বাহিনীর প্রধান আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ।
Published : 22 Nov 2015, 01:18 AM
একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঢাকার মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে ক্যাম্প বসিয়ে স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণ দিত।
জামায়াতের ইসলামীর তৎকালীন ছাত্র সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল মুজাহিদ নিয়মিতভাবে ওই ক্যাম্পে যাতায়াত করতেন।
তিনি ঊর্ধ্বতন সেনা অফিসারের সঙ্গে স্বাধীনতাবিরোধী নানা অপরাধের পরামর্শ ও ষড়যন্ত্র করতেন। এ ধরনের ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়েই ১০ ডিসেম্বর থেকে বুদ্ধিজীবী নিধনসহ গণহত্যার মতো ঘটনা সংঘটিত হয়।
যুদ্ধাপরাধে ট্রাইব্যুনালে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী বিরুদ্ধেও বুদ্ধিজীবী হত্যার অভিযোগ প্রমাণিত। রায়ের বিরুদ্ধে ইসলামী ছাত্র সংঘের তৎকালীন সভাপতি নিজামীর আপিল উচ্চ আদালতে শুনানির পর্যায়ে রয়েছে।
তবে এই অপরাধের দায়ে তার সেকেন্ড ইন কমান্ডকেই প্রথম ফাঁসিতে ঝুলতে হল। এর মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরে বিচার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে প্রথম কোনো যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি কার্যকর হল।
অথচ মুজাহিদ ২০০৭ সালের অক্টোবরে আইন সংস্কার নিয়ে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংলাপ শেষে দাবি করেছিলেন, দেশে কোনো স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি নেই; যুদ্ধাপরাধীও নেই।
মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত আন্তজাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে ২০১২ সালের ২১ জুন মুজাহিদের বিচার শুরু হয়।
পরের বছর ১৭ জুলাই প্রসিকিউশনের আনা সাতটি অভিযোগের মধ্যে পাঁচটিতে মুজাহিদকে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল।
এই রায়ের বিরুদ্ধে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেলের আপিল আংশিক মঞ্জুর করে ১৬ জুন আপিল বিভাগ চারটি অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে। এর মধ্যে শুধু মৃত্যুদণ্ডাদেশ পুর্নবিবেচনা চেয়ে মুজাহিদের করা আবেদন বুধবার খারিজ করে দেয় আপিল বিভাগ।
প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা ও আপিল বেঞ্চের অন্য তিন বিচারকের দেওয়া রায়ে বলা হয়, আপিল শুনানির পর দেওয়া রায়ে কোনো ত্রুটি বিচারকদের নজরে আসেনি। সুতরাং দণ্ড পুনর্বিবেচনার কোনো কারণও তারা খুঁজে পাননি।
দণ্ড কার্যকরের আগে এই যুদ্ধাপরাধীর শেষ আইনি সুযোগ ছিল রিভিউ আবেদন। তা খারিজের মধ্য দিয়ে আইনি লড়াইয়ের পরিসমাপ্তি হয়।
প্রাণরক্ষার সর্বশেষ চেষ্টা হিসেবে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদনও শনিবার রাতে নাকচ হয়ে গেলে রোববার প্রথম প্রহরে মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকর হয়।
রায়ে সর্বোচ্চ আদালত বলেছে, একাত্তরের পাশবিক নিষ্ঠুরতার জন্য তৎকালীন আল বদর বাহিনীর প্রধান নেতার মৃত্যুদণ্ডই ন্যায়বিচার।
“এটা ঠাণ্ডা মাথার হিংস্রতা। তার উসকানিতে সংগঠিত এই ধরনের বর্বর, ভয়াবহ, নিষ্ঠুর অপরাধ কেবল হিটলারের গ্যাস চেম্বারে গণহত্যার সঙ্গেই তুলনা করা যায়। পুরো পৃথিবী আল বদর বাহিনীর এই নিষ্ঠুরতা ও গণহত্যা দেখেছে।
“আমরা যদি অপরাধ সংগঠনের ধরন, ব্যবহৃত অস্ত্র, অপরাধের নির্মমতা, নিহত মানুষের সংখ্যা, ঘটনার শিকার ব্যক্তিদের অসহায়ত্বের দিকে দৃষ্টি দেই, তাহলে একটা উপসংহারই আমরা কেবল টানতে পারি, যাতে ট্রাইব্যুনাল পৌঁছেছিলেন। সেটা হচ্ছে- নবজাতক এক জাতির ভবিষ্যতকে সুনির্দিষ্ট ছকে ঠাণ্ডা মাথায় পঙ্গু করে দেওয়ার মতলবেই বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়।”
রায়ে আরও বলা হয়, “এই অপরাধের ধরন, মাত্রা এবং সংগঠনের পদ্ধতি বিবেচনায় নিয়ে যথাযথ দণ্ড দেওয়া আদালতের কর্তব্য। ভয়াবহ নিষ্ঠুরতায় এবং পশুর মত করে বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকাণ্ড সংগঠন অপরাধীদের বিকৃত চরিত্রই ফুটিয়ে তোলে। এই ধরনের নিষ্ঠুরতা ও প্রমাণ পাওয়ার পর অপরাধী সর্বোচ্চ দণ্ড না পেলে সেটা ন্যায়বিচারের উপহাস হয়ে যাবে।’
প্রসিকিউশনের আনা সাত অভিযোগের মধ্যে ১, ৬ ও ৭ নম্বর অভিযোগে মুজাহিদকে দোষী সাব্যস্ত করে ফাঁসির আদেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল। ৫ নম্বর অভিযোগে যাবজ্জীবন ও ৩ নম্বর অভিযোগে তার পাঁচ বছরের কারাদণ্ড হয়।
আপিল বিভাগের চূড়ান্ত রায়ে মুজাহিদকে দোষী সাব্যস্ত করে সর্বোচ্চ সাজার আদেশ বহাল রাখা হয় বুদ্ধিজীবী হত্যার ষষ্ঠ অভিযোগে। আর ৭ নম্বর অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল মুজাহিদকে মৃত্যুদণ্ড দিলেও আপিল বিভাগ তার সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়।
৭ নম্বর অভিযোগে বলা হয়, একাত্তরের ১৩ মে মুজাহিদের নির্দেশে রাজাকার বাহিনী ফরিদপুরের কোতোয়ালি থানার বকচর গ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা চালিয়ে বীরেন্দ্র সাহা, নৃপেন সাহা, শানু সাহা, জগবন্ধু মিত্র, জলাধর মিত্র, সত্য রঞ্জন দাশ, নরদবন্ধু মিত্র, প্রফুল্ল মিত্র, উপেন সাহাকে তুলে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে। একই সময়ে রাজাকাররা সুনীল কুমার সাহার কন্যা ঝর্ণা রানীকে ধর্ষণ করে এবং হিন্দুদের বসতঘরে লুটপাট চালিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। এছাড়া অনীল সাহা নামে একজনকে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়।
মামলার পঞ্চম অভিযোগে মুজাহিদকে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড চূড়ান্ত বিচারেও বহাল রাখে সর্বোচ্চ আদালত।
এই অভিযোগে বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সুরকার আলতাফ মাহমুদ, গেরিলা যাদ্ধা জহিরউদ্দিন জালাল ওরফে বিচ্ছু জালাল, শহীদজননী জাহানারা ইমামের ছেলে শাফি ইমাম রুমি, বদিউজ্জামান, আবদুল হালিম চৌধুরী জুয়েল ও মাগফার আহমেদ চৌধুরী আজাদসহ কয়েকজনকে আটক করে ঢাকার নাখালপাড়ায় পুরনো এমপি হোস্টেলে রাখা হয়। ৩০ অগাস্ট রাত ৮টার দিকে পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সেক্রেটারি মুজাহিদ ও সভাপতি মতিউর রহমান নিজামী সেখানে গিয়ে এক সেনা কর্মকর্তাকে পরামর্শ দেন, রাষ্ট্রপতির সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আগেই তাদের হত্যা করতে হবে। এ সিদ্ধান্তের পর সহযোগীদের নিয়ে মুজাহিদ আর্মি ক্যাম্পে আটকদের অমানসিক নির্যাতন করেন এবং জালাল ছাড়া বাকিদের হত্যা করা হয়।
তৃতীয় অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া পাঁচ বছরের কারাদণ্ডও বহাল রেখেছে আপিল বিভাগ।
৩ নম্বর অভিযোগে বলা হয়, একাত্তরের জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে ফরিদপুর শহরের খাবাসপুর মসজিদের সামনে থেকে রাজাকাররা ফরিদপুর জেলার কোতোয়ালি থানার গোয়ালচামট (রথখোলার) এলাকার মৃত রমেশ চন্দ্র নাথের ছেলে রণজিৎ নাথ ওরফে বাবু নাথকে আটক করে। ফরিদপুর পুরনো সার্কিট হাউসে মুজাহিদের উপস্থিতিতে পাকিস্তানি সেনা বাহিনীর মেজর আকরাম কোরাইশীর কাছে তাকে হস্তান্তর করা হয়। সেখানে নির্যাতনের পর মুজাহিদের নির্দেশে তাকে হত্যা করার উদ্দেশে বিহারি ক্যাম্পের উত্তর পাশে আব্দুর রশিদের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে বাবু নাথ সেদিন জানালার শিক ভেঙে পালিয়ে জীবন বাঁচান বলে ট্রাইব্যুনালে দেওয়া সাক্ষ্যে জানান।
প্রসিকিউশনের আনা এক নম্বর অভিযোগে জামায়াত নেতা মুজাহিদকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ফাঁসির রায় দিলেও চূড়ান্ত বিচারে আপিল বিভাগ তাকে খালাস দিয়েছে।
এই অভিযোগে বলা হয়, পাকিস্তানের বাঙালি সহযোগীদের বিরুদ্ধে একটি দৈনিকে প্রবন্ধ লেখার অপরাধে ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর চামেলীবাগের বাসা থেকে অস্ত্রের মুখে অপহরণ করা হয় ইত্তেফাকের সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনকে। পরে তাকে হত্যা করা হয়।
মামলার দ্বিতীয় ও চতুর্থ অভিযোগে মুজাহিদের সংশ্লিষ্টতা প্রসিকিউশন প্রমাণ করতে না পারায় ট্রাইব্যুনালে তাকে খালাস দেয়। রাষ্ট্রপক্ষ আপিল শুনানিতে আপিল না করায় এ দুই অভিযোগ বিবেচনায় নেয়নি সর্বোচ্চ আদালত।
এর মধ্যে দ্বিতীয় অভিযোগে বলা হয়, একাত্তরের মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে ফরিদপুরের চরভদ্রাসন থানায় বৈদ্যডাঙ্গি, মাঝিডাঙ্গি ও বালাডাঙ্গি গ্রামে হিন্দুদের প্রায় সাড়ে তিনশ বাড়ি পুড়িয়ে দেয় পাকিস্তানি সেনা ও তাদের দোসররা। হামলাকারীদের গুলিতে ৫০ থেকে ৬০ জন নর-নারী নিহত হন। ওই ঘটনায় ফরিদপুর শহরের হামিদ মাওলানা ছাড়াও ৮/১০ জন অবাঙালি অংশ নেন।
চতুর্থ অভিযোগে বলা হয়, একাত্তরের ২৬ জুলাই আলফাডাঙ্গা থেকে স্থানীয় রাজাকাররা মো. আবু ইউসুফ ওরফে পাখিকে মুক্তিযোদ্ধা সন্দেহে আটক করে ফরিদপুর স্টেডিয়ামে আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে আটক রাখে। সেখানে মুজাহিদের কাছ থেকে পাখির বিষয়ে জানতে পেরে তার ওপর নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় পাকিস্তানি সেনারা। প্রায় এক মাস ৩ দিন নির্যাতনে পাখির বুক ও পিঠের হাড় ভেঙে যায়।