যুদ্ধকালীন চট্টগ্রামের ত্রাস সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া ফাঁসির রায় বহাল থাকবে কি-না, তা জানা যাবে বুধবার।
Published : 28 Jul 2015, 06:26 PM
প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বাধীন চার সদস্যের আপিল বিভাগ সকাল ৯টার পর এই রায় ঘোষণা করবেন।
আপিল বেঞ্চের অন্য তিন সদস্য হলেন- বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী।
দুই পক্ষের শুনানি শেষে গত ৭ জুলাই আপিল বেঞ্চ রায়ের জন্য দিন ঠিক করে দেয়। সে অনুযায়ী আপিল বিভাগের বুধবারের কার্যতালিকায় রায়ের জন্য এ মামলা রাখা হয়েছে এক নম্বর ক্রমিকে।
২০১০ সালে যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরুর পর এটি আপিল আদালতে আসা পঞ্চম মামলা, যার চূড়ান্ত রায় হতে যাচ্ছে। ওই বছর ১৬ ডিসেম্বর গ্রেপ্তার সাকা চৌধুরী আছেন গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে।
রাউজানে কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের মালিক নূতন চন্দ্র সিংহকে হত্যা, সুলতানপুর ও ঊনসত্তরপাড়ায় হিন্দু বসতিতে গণহত্যা এবং হাটহাজারীর এক আওয়ামী লীগ নেতা ও তার ছেলেকে অপহরণ করে খুনের দায়ে ২০১৩ সালের ১ অক্টোবর সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসির রায় দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।
প্রসিকিউশনের আনা ২৩টি অভিযোগের মধ্যে নয়টি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে বলে বিচারিক আদালতের রায়ে বলা হয়।
ট্রাইব্যুনালের ওই রায় আপিলেও বহাল থাকবে বলে আশা করছেন অ্যার্টনি জেনারেল মাহবুবে আলম।
চূড়ান্ত রায়ের আগের দিন মঙ্গলবার তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “শুধু আমি না, আমার মত যারা স্বাধীনতার সময় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যারা স্বাধীনতার পক্ষের লোক এবং আপামর জনসাধারণ- সবাই এটাই চাইবেন, যে ট্রাইব্যুনাল যে সাজা দিয়েছেন সেটিই বহাল থাকে।”
অন্যদিকে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, “আমরা উভয়পক্ষই লিখিত বক্তব্য দিয়েছি। আশা করি আমাদের যে সাক্ষ্য-প্রমাণ রয়েছে তা বিচার বিবেচনা করে আদালত আসামিকে দণ্ড থেকে অব্যাহতি দেবেন।”
যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর এই রায়ের আগে ষড়যন্ত্রের সন্দেহ প্রকাশ করে গত কয়েকদিন ধরে শাহবাগে কর্মসূচি পালন করে আসছে গণজাগরণ মঞ্চ।
রায়ের আগের দিন একই ধরনের এক কর্মসূচিতে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ফাঁসির রায় না হলে জনগণ তা মেনে নেবে না।
এই ধরনের কর্মসূচিকে আদালতের উপর চাপ সৃষ্টির প্রয়াস হিসেবে দেখছেন সালাউদ্দিন কাদেরের আইনজীবী খন্দকার মাহবুব।
অন্যদিকে অ্যাটর্নি জেনারেল তা উড়িয়ে দিয়ে বলছেন, ন্যায় বিচারের দাবিতে সাধারণ মানুষের রাস্তায় নেমে আসার নজির সারা বিশ্বেই রয়েছে।
এর আগে আসা চারটি আপিলের রায়ের মধ্যে দুটিতে জামায়াতের দুই সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লা ও মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে।
আপিল বিভাগের আরেক রায়ে জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তবে সেই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত না হওয়ায় রিভিউ নিষ্পত্তি হয়নি।
সর্বশেষ রায়ে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া মৃত্যুদণ্ডাদেশই আপিল আদালত বহাল রেখেছে।
এছাড়া আপিল শুনানি চলার মধ্যেই মুক্তিযুদ্ধকালীন জামায়াত আমির গোলাম আযম ও বিএনপির সাবেক মন্ত্রী আবদুল আলীমের মৃত্যু হয়।
ট্রাইব্যুনালের রায়
রাউজানের কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের মালিক নূতন চন্দ্র সিংহকে হত্যা, সুলতানপুর ও ঊনসত্তরপাড়ায় হিন্দু বসতিতে গণহত্যা এবং হাটহাজারীর এক আওয়ামী লীগ নেতা ও তার ছেলেকে অপহরণ করে খুনের দায়ে ২০১৩ সালের ১ অক্টোবর সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসির রায় দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।
সালাউদ্দিন কাদেরের বিরুদ্ধে এ মামলায় প্রসিকিউশন যে ২৩টি অভিযোগ এনেছিল, তার মধ্যে নয়টি (২ থেকে ৮, ১৭ ও ১৮ নম্বর অভিযোগ) সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে বলে ট্রাইব্যুনালের রায়ে বলা হয়।
এর মধ্যে ৩ নম্বর অভিযোগে রাউজানের কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের মালিক নূতন চন্দ্র সিংহকে হত্যা; ৫ নম্বর অভিযোগে সুলতানপুর এবং ৬ নম্বর অভিযোগে ঊনসত্তরপাড়ায় হিন্দু বসতিতে গণহত্যা; ৮ নম্বর অভিযোগে হাটহাজারীর এক আওয়ামী লীগ নেতা ও তার ছেলেকে অপহরণ করে খুনের দায়ে বিএনপির এই সাবেক সাংসদকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
২, ৪ ও ৭ নম্বর অভিযোগে হত্যা, গণহত্যার পরিকল্পনা সহযোগিতা এবং লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও দেশান্তরে বাধ্য করার ঘটনায় সালাউদ্দিন কাদেরের সিংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হয়েছে বলে রায়ে জানায় ট্রাইব্যুনাল। প্রতিটি অভিযোগে তাকে দেওয়া হয় ২০ বছর করে কারাদণ্ড।
১৭ ও ১৮ নম্বর অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় অপহরণ ও নির্যাতনের দায়ে সালাউদ্দিন কাদেরকে ট্রাইব্যুনাল পাঁচ বছর করে কারাদণ্ড দেয়।
প্রসিকিউশন ১, ১০, ১১, ১২, ১৪, ১৯, ২০ ও ২৩ নম্বর অভিযোগ প্রমাণ করতে না পারায় এসব অভিযোগ থেকে আসামিকে খালাস দেওয়া হয়।
৯, ১৩, ১৫, ১৬, ২১ ও ২২ নম্বর অভিযোগে দুটি গণহ্যতাসহ বেশ কিছু অপহরণ ও নির্যাতনের ঘটনায় প্রসিকিউশন সালাউদ্দিন কাদেরের জড়িত থাকার কথা বললেও কোনো সাক্ষী হাজির করতে না পারায় ওই রায়ে এসব অভিযোগের মূল্যায়ন করা হয়নি।
মামলার ইতিবৃত্ত
হরতালে গাড়ি পোড়ানোর একটি মামলায় ২০১০ সালে বিজয় দিবসের সকালে সালাউদ্দিন কাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয় ১৯ ডিসেম্বর। ২০১২ সালের ৪ এপ্রিল অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে তার বিচার শুরু করে ট্রাইব্যুনাল।
ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের পক্ষে এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মো. নূরুল ইসলামসহ মোট ৪১ জন সাক্ষ্য দেন। তদন্ত কর্মকর্তার কাছে দেওয়া আরও চার জনের জবানবন্দি সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা হয়। অন্যদিকে সালাউদ্দিন কাদেরের পক্ষে সাফাই সাক্ষ্য দেন তিনি নিজেসহ মোট চারজন।
২০১৩ সালের ১ অক্টোবর ট্রাইব্যুনাল মৃত্যুদণ্ডের রায় দিলে এর ২৮ দিনের মাথায় আপিল করেন মুসলিম লীগ নেতা ফজলুল কাদের চৌধুরীর ছেলে সাকা চৌধুরী।
১৬ জুন আপিল শুনানি শুরুর পর ত্রয়োদশতম দিনে ৭ জুলাই দুই পক্ষের শুনানি শেষ হয়। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে অংশ নেন অ্যার্টনি জেনারেল মাহবুবে আলম। সঙ্গে ছিলেন অতিরিক্ত অ্যার্টনি জেনারেল মোমতাজ উদ্দিন ফকির, ডেপুটি অ্যার্টনি জেনারেল একরামুল হক ও সহকারী অ্যার্টনি জেনারেল বশির আহমেদ।
সাকা চৌধুরীর পক্ষে শুনানি করেন খন্দকার মাহবুব হোসেন ও আইনজীবী এস এম শাহজাহান। সঙ্গে ছিলেন ব্যারিস্টার তানভীর আহমেদ আল-আমিন।
দুই পক্ষের যুক্তি
আপিল আদালতে যুক্তিতর্কের শুনানি শেষে আসামিপক্ষের আইনজীবী খন্দকার মাহবুব বলেন, “একাত্তর সালের ১৩ এপ্রিল থেকে ঘটনার কথা বলেছে রাষ্ট্রপক্ষ। আমরা বলেছি সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ২৯ মার্চ ঢাকা থেকে পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটিতে চলে যান। এ সংক্রান্ত সার্টিফিকেট দিয়েছি।
“তবে প্রসিকিউশন বলেছে, উনি দেশে ছিলেন। উনার ওপর হামলা হয়েছে, গাড়ির চালক মারা গেছে। আমরা বলেছি চালকের পরিবারের পক্ষ থেকে সাক্ষী আনা হোক- কোথায় গাড়ি কি গাড়ি... চালকের নামও নেই।”
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সেদিন বলেন, “সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলছে উনি দেশে ছিলেন না। এটা গ্রহণযোগ্য নয়; এটা মিথ্যা। সবশেষে তার আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছেন দণ্ড কমাতে। এটাতেও আমরা আপত্তি জানিয়েছি।”
এ মামলায় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ও শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য সালেহ উদ্দিনের সাক্ষ্য দেওয়ার কথা তুলে ধরে মাহবুবে আলম বলেন, “তাদের মতো বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষাবিদরা কি মিথ্যা সাক্ষ্য দেবে নাকি? অবশ্যই সালাউদ্দিন কাদের দেশে ছিলেন। নির্যাতিত হয়েছেন যারা, তারাও বলেছেন।”
বিতর্কের সঙ্গে বসবাস
বিএনপির বর্তমান স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর জন্ম ১৯৪৯ সালের ১৩ মার্চ চট্টগ্রামের রাউজান থানার গহিরা গ্রামে। তার বাবা মুসলিম লীগ নেতা ফজলুল কাদের চৌধুরী এক সময় পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের স্পিকারও হয়েছিলেন।
সালাউদ্দিন কাদেরের রাজনীতির শুরুও মুসলিম লীগ থেকেই। পরে জাতীয় পার্টি ও এনডিপি হয়ে তিনি বিএনপিতে আসেন।
একাত্তরের অপরাধের জন্য বিতর্কিত এই রাজনীতিবিদ ১৯৭৯ সালে মুসলিম লীগ থেকে রাউজানের সাংসদ নির্বাচিত হন। সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের সময়ে তিনি জাতীয় পার্টিতে যোগ দেন এবং কার্যত এর মধ্যে দিয়েই মূল ধারার রাজনীতিতে তার পুনর্বাসন ঘটে।
১৯৮৬ সালে জাতীয় পার্টির টিকেটে নির্বাচন করে নিজের এলাকা রাউজান থেকে সাংসদ নির্বাচিত হন সাকা। কিন্তু পরে দল থেকে বহিষ্কৃত হন। এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালে তিনি নির্বাচন করেন নিজের গঠন করা দল এনডিপি থেকে। আবারও তিনি রাউজানের এমপি হন।
এর কিছুদিন পর এনডিপি বিএনপির সঙ্গে একীভূত হয় এবং ১৯৯৬ সালে বিএনপির টিকেটে সাংসদ নির্বাচিত হন সালাউদ্দিন। পরের নির্বাচনে ২০০১ সালে তিনি সাংসদ নির্বাচিত হন চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া থেকে।
বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে মন্ত্রীর মর্যাদায় প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টার দায়িত্বও তিনি পালন করেন।
এর আগে সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদের শাসনামলে ত্রাণ ও পুনর্বাসন, গৃহায়ণ ওগণপূর্ত এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন সা কা চৌধুরী।
সর্বশেষ ২০০৮ সালের র্নিবাচনে রাঙ্গুনিয়া ও ফটিকছড়ি থেকে অংশ নেন সাকা। রাঙ্গুনিয়াতে হেরে গেলেও ফটিকছড়ি, অর্থাৎ চট্টগ্রাম-২ আসন থেকে বিএনপির সাংসদ নির্বাচিত হন তিনি।
তিনি সাংসদ থাকা অবস্থায় ট্রাইব্যুনালে যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসির রায় আসে।
ফজলুল কাদের (ফকা) চৌধুরীর চার ছেলের মধ্যে সাকা চৌধুরীই সবার বড়। তার সেজ ভাই গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক। তিনিও একসময় সাংসদ ছিলেন।
বাকি দুই ভাইয়ের মধ্যে সাইফুদ্দিন কাদের চৌধুরী মারা গেছেন। আর জামাল উদ্দিন কাদের চৌধুরী একজন ব্যবসায়ী।
গত দুই দশকে সাকা চৌধুরী বার বার সংবাদপত্রের শিরোনামে এসেছেন তার চটকদার, ‘ঔদ্ধত্যপূর্ণ’ এবং কখনো কখনো ‘অশালীন’ মন্তব্যের কারণে।
আত্মীয়তা ও পারিবারিক রাজনৈতিক ইতিহাসের সূত্রে আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার ফলে নানা নাটকীয় ঘটনার জন্ম দেওয়ার পাশাপাশি আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে ‘অশালীন’ মন্তব্য করে আলোচনা ও নিন্দা কুড়ান তিনি।
বিএনপিতে থেকেও দলীয় প্রধান খালেদা জিয়া ও তার ছেলে তারেক রহমানকে নিয়ে মন্তব্য করে সমালোচিত হন দলের ভেতেরেই।
নবম সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় সা কা চৌধুরী শিক্ষাগত যোগ্যতা ‘নেই’ উল্লেখ করলে ‘অসত্য তথ্য’ দেওয়ার কারণে পরে তার সদস্য পদ খারিজের উদ্যোগ নেয় নির্বাচন কমিশন। তবে ‘আইনি সীমাবদ্ধতার’ কারণে বিষয়টি আর এগোয়নি।