হত্যা মামলার বিচার আপিল বিভাগে শুনানির জন্য থাকলেও বিস্ফোরক মামলা এখনও সাক্ষ্যগ্রহণেই আটকে আছে।
Published : 25 Feb 2023, 10:00 AM
চৌদ্দ বছর গড়িয়ে গেলেও বিডিআর বিদ্রোহের সময় পিলখানায় সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের বিচার এখনও পুরোপুরি শেষ হয়নি।
এই ঘটনার হত্যা মামলার বিচার আপিল বিভাগে শুনানির জন্য থাকলেও বিস্ফোরক মামলা এখনও সাক্ষ্যগ্রহণেই আটকে আছে বিচারিক আদালতে।
সীমান্ত রক্ষা বাহিনীর সদরদপ্তর ঢাকার পিলখানায় ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারির সকালটা আচমকা এক বিদ্রোহের সূত্র ধরে রক্তারক্তিতে রূপ নিয়েছিল।
দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আলোড়ন তোলা ওই ঘটনায় প্রাণ হারান ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন।
বিডিআরের দরবার হল থেকে সূচনা হওয়া ওই বিদ্রোহের ইতি ঘটে নানা ঘটন-অঘটনের মধ্য দিয়ে পরদিন। পিলখানায় বিদ্রোহের মধ্যেই দেশের বিভিন্ন স্থানে জওয়ানরাও বিদ্রোহ করে।
সেই বিদ্রোহের পর সীমান্ত রক্ষা বাহিনী বিডিআরের নাম বদলে যায়, পরিবর্তন আসে পোশাকেও। এ বাহিনীর নাম এখন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ বা বিজিবি।
বিদ্রোহের বিচার বিজিবির আদালতে হলেও হত্যাকাণ্ডের মামলা বিচারের জন্য আসে প্রচলিত আদালতে।
এই ঘটনায় দুটি ফৌজদারি মামলা করা হয়। এর একটি ছিল হত্যা মামলা, অন্যটি বিস্ফোরক আইনের মামলা।
খুনের মামলায় ৮৫০ জনের বিচার শেষ হয় ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর। এতে ১৫২ জনের ফাঁসি, ১৬০ জনের যাবজ্জীবন ও ২৫৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। খালাস পান ২৭৮ জন।
২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর সেই মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের রায়ও হয়ে যায় হাই কোর্টে।
বিদ্রোহের অপরাধে দণ্ডিত হন ৬ হাজার জওয়ান
পিলখানা হত্যা: ১৩৯ আসামির মৃত্যুদণ্ড, ১৮৫ জনের যাবজ্জীবন
পিলখানা হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে কী, কারণ খুঁজতে পরামর্শ হাই কোর্টের
অন্যদিকে বিস্ফোরক মামলায় ৮৩৪ জন আসামির বিরুদ্ধে বিচারকাজ শুরু হয়েছিল ২০১০ সালে। কিন্তু মাঝপথে বিস্ফোরক মামলার কার্যক্রম এক প্রকার স্থগিত রেখে শুধু হত্যা মামলার সাক্ষ্য উপস্থাপন করে রাষ্ট্রপক্ষ। যে কারণে এই মামলার বিচার ঝুলে যায়।
বিস্ফোরক আইনে হওয়া মামলাটির বিচার চলছে ঢাকার এক নম্বর মহানগর বিশেষ ট্রাইব্যুনালে। বিচারক মো. আছাদুজ্জামান বকশীবাজারে কারা অধিদপ্তরের মাঠে এজলাসে বসে এ বিচারকাজ পরিচালনা করছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাষ্ট্রপক্ষের ১ হাজার ৩৪৫ জন সাক্ষীর মধ্যে এ পর্যন্ত সাক্ষ্য দিয়েছেন ২৫৭ জন। গত এক বছরে ৪৭ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ হয়েছে। আগামী ২৭ ও ২৮ ফেব্রুয়ারি এই মামলায় পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য আছে।
হত্যা মামলায় খালাস বা সাজাভোগ শেষে বিস্ফোরক মামলার কারণে মুক্তি আটকে আছেন ৪৬৮ বিডিআর সদস্যের।
আসামিপক্ষের অভিযোগ, মামলাটি নিষ্পত্তিতে যথাযথ তৎপরতা নেই রাষ্ট্রপক্ষের। তাই বিচার শেষ হতে দেরি হচ্ছে।
আসামিপক্ষের অন্যতম আইনজীবী ফারুক আহাম্মদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সাক্ষ্যগ্রহণের সংখ্যা আগের চেয়ে কিছুটা বেড়েছে। তবে সেটা কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে নয়।
“বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় ২৭৮ জন আসামি হত্যা মামলায় খালাস পান। এছাড়া স্বল্পমেয়াদে সাজা ভোগ করে আরও ১৯০ আসামি মুক্তির অপেক্ষায় আছেন। তাই এই ৪৬৮ জন আসামি মূল মামলায় খালাস বা সাজাভোগ করেও মুক্তি পাচ্ছেন না।”
বিস্ফোরক মামলায় জামিন নামঞ্জুরের আদেশও পাচ্ছেন না অভিযোগ করে এই আইনজীবী বলেন, “তাই আমরা হাই কোর্টেও যেতে পারছি না। আমরা চাই, এসব আসামিকে বিস্ফোরক মামলায় হয় জামিন দেওয়া হোক অথবা মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তি করা হোক।”
আসামিপক্ষের এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বিশেষ পাবলিক প্রসিকিউটর মোশাররফ হোসেন কাজল।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, কোভিড মহামারীর কারণে দীর্ঘদিন আদালত বন্ধ ছিল। আদালত খোলার পর রাষ্ট্রপক্ষে নিয়মিত সাক্ষী হাজির করা হচ্ছে।
অভিযোগপত্রে ১ হাজার ৩৪৫ জন সাক্ষী থাকলেও সবার সাক্ষ্য নেওয়ার প্রয়োজন হবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, “যারা সাক্ষ্য দিতে আসবেন, তাদের জবানবন্দি নিয়েই বিচার শেষ করা হবে। আশা করছি, এ বছরের মধ্যেই বিচারকাজ শেষ হবে।”
স্মরণে সেই দিন
রক্তাক্ত সেই দিনটি স্মরণে বিজিবি ও সেনা সদর নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। ওই ঘটনার পরের বছর থেকে প্রতি বছর দিনটি পালন করা হয়।
বিজিবি সদর দপ্তর সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, সেনাবাহিনীর ব্যবস্থাপনায় শনিবার সকাল ৯টায় বনানী সামরিক কবরস্থানে রাষ্ট্রপতির প্রতিনিধি, প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তিন বাহিনীর প্রধান (সম্মিলিতভাবে), স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব ও বিজিবি মহাপরিচালক (একত্রে) স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন।
দিনের বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্যে পিলখানার বিজিবি সদর দপ্তরসহ সব অঞ্চল, প্রতিষ্ঠান, সেক্টর ও ইউনিটের ব্যবস্থাপনায় কোরআন তেলওয়াত, বিজিবির সব মসজিদ এবং বিওপি পর্যায়ে দোয়া ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হবে।
এদিন বিজিবির সব স্থাপনায় বাহিনীর রেজিমেন্টাল পতাকা অর্ধনমিত থাকবে। সব সদস্যরা কালো ব্যাজ পরবেন।
সেদিন যা ঘটেছিল
২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সকাল ৯টার পরপরই পিলখানা বিডিআর সদরদপ্তরে গুলির শব্দ পাওয়া যেতে থাকে। বিডিআর সপ্তাহ চলার কারণে প্রথমে অনেকেই ভাবছিলেন, কোনো কর্মসূচি চলছে। কিন্তু কিছু সময় পর জানা যায়- বিদ্রোহ হয়েছে; পিলখানার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে জওয়ানরা।
বিদ্রোহের পর সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন বাহিনীর প্রধানরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে বসেন। এরই মধ্যে পিলখানার চারদিকে সেনাবাহিনী ভারী অস্ত্র নিয়ে অবস্থান নেয়। এদিকে পিলখানার পর দেশের বিভিন্ন জেলায় বিডিআর দপ্তরে বিদ্রোহের খবর আসতে থাকে।
এক পর্যায়ে সরকারের পক্ষ থেকে বিদ্রোহীদের সঙ্গে শুরু হয় আলোচনা। তৎকালীন স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক, হুইপ মির্জা আজম ও সাংসদ শেখ ফজলে নূর তাপস এ আলোচনার নেতৃত্ব দেন।
বিকালে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও বিদ্রোহীদের আলোচনা হয়। পরে পিলখানার প্রধান ফটকের পাশের একটি রেস্তোরাঁয় আলোচনায় অংশ নেন কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীসহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন।
গভীর রাতে তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন পিলখানায় গেলে বিদ্রোহীরা তার কাছে অস্ত্র সমর্পণ করেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বেরিয়ে আসার সময় বিদ্রোহীদের হাতে জিম্মি কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা এবং তাদের পরিবারকে সঙ্গে করে নিয়ে আসেন। তারা মুক্ত হন।
কিন্তু এরপরও পিলখানা বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে থাকতে দেখা যায়। এক পর্যায়ে ২৬ ফেব্রুয়ারি বিকাল থেকে পিলখানা শূন্য হয়ে পড়লে পুলিশ ও সেনাবাহিনী পিলখানার নিয়ন্ত্রণ নেয়। অবসান ঘটে প্রায় ৩৩ ঘণ্টার বিদ্রোহের।
বিদ্রোহের প্রথম দিন দুপুরে কামরাঙ্গীরচর বেড়িবাঁধের কাছে ম্যানহোলের মুখে দুই বিডিআর কর্মকর্তার লাশ পাওয়া গেলে হৈ চৈ পড়ে যায়। বোঝা যায়, ভেতরে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।
বিদ্রোহ অবসানের পরদিন পিলখানায় পাওয়া যায় একাধিক গণকবর। সেখানে পাওয়া যায় বিডিআরের তৎকালীন মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদ, তার স্ত্রীসহ সেনা কর্মকর্তাদের লাশ।