“সেটা সংসদ সদস্য আনারের না অন্য কিছু, তা ডিএনএ পরীক্ষা না করে তা নিশ্চিত হওয়া যাবে না,” বলেন ডিএমপি কমিশনার।
Published : 28 May 2024, 08:48 PM
কলকাতার যে অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সে বাংলাদেশের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার ‘খুন হয়েছেন’ বলা হচ্ছে, তার সেপটিক ট্যাংক থেকে কিছু মাংসের টুকরো উদ্ধার করার কথা জানিয়েছে পুলিশ।
ঢাকার পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমান মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ভারতে অবস্থানরত ডিবির কর্মকর্তাদের সঙ্গে তার এ বিষয়ে কথা হয়েছে।
“সেখানে সঞ্জিভা গার্ডেনসের সেপটিক ট্যাংকের মধ্যে কিছু মাংস পাওয়া গেছে। সেটা সংসদ সদস্য আনারের না অন্য কিছু, তা ডিএনএ পরীক্ষা না করে তা নিশ্চিত হওয়া যাবে না।”
এদিকে ঢাকার তিনটি টেলিভিশনকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে সঞ্জিভা গার্ডেনসের একজন মালি সিদ্ধেশ্বর মণ্ডল বলছেন, একটি ম্যানহোল চেম্বার থেকে অনেকখানি মাংস উদ্ধার করতে দেখেছেন তিনি। পরিমাণে তা হতে পারে তিন থেকে চার কেজি।
হাতের দুই আঙুল দিয়ে দেখিয়ে তিনি বলছেন, টুকরোগুলো ছোট ছোট, তার ভাষায় ‘পাকোড়া কাট’।
যা বললেন মালি
বাংলাদেশের ৭১ টিভিতে প্রচারিত সাক্ষাতকারে সঞ্জিভা গার্ডেনসের মালি সিদ্ধেশ্বর মণ্ডল বলেন, “যাকে খুন করা হয়েছে, তাকে ছোট ছোট পিস করে টয়লেটের প্যানের মধ্যে দিয়ে ফ্ল্যাশ করে দেওয়া হয়েছে। সেই মাংসটা পাইপের মধ্য দিয়ে সেপটিক ট্যাংকে গিয়ে জমা হয়। সেখান থেকে যিনি মাংসগুলো
উঠিয়েছেন তিনি ভূষণ শিকারী, আমাদেরই বোনাই (বোনজামাই) হন। তিনি সেপটিক ট্যাংক পরিষ্কারের কাজ করেন।”
জানতে চাইলে সিদ্ধেশ্বর মণ্ডল বলেন, “ওপরে ওঠানো মাংসের পরিমাণ হবে তিন থেকে চার কিলো। এগুলো জলের মধ্যে ছিল, কোনো পলিথিনে প্যাঁচানো ছিল না। পিসগুলো ছোট ছোট কিমা করা হয়েছে একেকটা পাকোড়ার সাইজের।”
তিনি বলেন, “আমি নিজে ছবি তুলতে গিয়েছে আমাকে মানা করেছে। জলে সব ধুয়ে গেছে মাংস সাদা রং হয়ে গেছে। গন্ধ সেরকম নেই, আমার গা গোলাচ্ছিল বলে চলে এসেছি।”
সিদ্ধেশ্বর বলছেন, সঞ্জিভা গার্ডেনসে প্রতিটি ভবনের জন্য আলাদা আলাদা সেপটিক ট্যাংক রয়েছে। প্রতিটি সেপ্টিক ট্যাংকের ঢাকনা রয়েছে পার্কিং লটে। ঢাকনা খুলে ওই মাংসগুলো উদ্ধার করা হয়।
সিদ্ধেশ্বরের ভাষ্য, “মানুষের মাংস না হলে ওখানে এতোগুলো মাংস আসবে কোত্থেকে। ওগুলো তো আবার ওঠাচ্ছেও। এটাই এমপির মাংস, না হলে ওঠাবে কেন? পুলিশ সেগুলো তুলে বিছিয়ে রাখছে।”
পূর্বাপর
ঝিনাইদহ-৪ আসনের তিনবারের সংসদ সদস্য আনার কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। গত ১১ মে তিনি চিকিৎসার জন্য ভারতে যান। প্রথমে কলকাতার বরাহনগরে তার বন্ধু স্বর্ণ ব্যবসায়ী গোপাল বিশ্বাসের বাড়িতে ওঠেন। কিন্তু সেখান থেকে বেরিয়ে নিখোঁজ হন।
এরপর স্থানীয় থানায় জিডি করেন গোপাল বিশ্বাস। তদন্ত শুরু হয় দুই দেশে। ২২ মে সকালে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে খবর আসে, নিউ টাউনের এক বাড়িতে খুন হয়েছেন এমপি আনার। এর পরেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ভারতের পুলিশের বরাত দিয়ে হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে ভারতীয় পুলিশের দেওয়া তথ্যে বাংলাদেশে তিনজনকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ। পরে তাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডেও নেওয়া হয়।
ওই তিনজন হলেন- আমানুল্লা সাঈদ ওরফে শিমুল ভুঁইয়া ওরফে শিহাব ওরফে ফজল মোহাম্মদ ভুঁইয়া (৫৬), তানভীর ভুঁইয়া (৩০) ও সেলেস্টি রহমান (২২)।
পুলিশ বলছে, এমপি আনার হত্যার ‘হোতা’ তার বাল্যবন্ধু ও ঝিনাইদহের যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী আখতারুজ্জামান ওরফে শাহিন মিয়া। আর হত্যাকাণ্ডটি বাস্তবায়ন করেছেন চরমপন্থি নেতা আমানুল্লা ওরফে শিমুল। আনার কলকাতায় যাওয়ার পরদিন বৈঠক করার জন্য আখতারুজ্জামান শাহীনের ভাড়া বাসায় যান। সেখানেই আসামিরা তাকে হত্যা করে।
গ্রেপ্তার তিনজনকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের পর ডিবি কর্মকর্তা হারুন অর রশীদ গত ২৪ মে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, সংসদ সদস্যকে হত্যার পর শরীরের বিভিন্ন অংশ টুকরো করে হলুদ লাগিয়ে ছিটিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে গ্রেপ্তার তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে তারা জানতে পেরেছেন। ফলে লাশ উদ্ধার করা কঠিন।
তদন্তের এক পর্যায়ে জিহাদ হাওলাদার নামের এক কসাইকে গ্রেপ্তার করে পশ্চিমবঙ্গের সিআইডি। তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী তাকে নিয়ে কয়েকটি খাল, জঙ্গলে ব্যপক তল্লাশি চালিয়েও আনারের লাশের হদিস মেলাতে পারেনি কলকাতা পুলিশ।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়, ২৪ বছর বয়সী জিহাদ হাওলাদার বাংলাদেশের খুলনার বাসিন্দা। অবৈধভাবে ভারতে অনুপ্রবেশ করেছিলেন তিনি। আনারকে ‘খুনে’র প্রায় দুই মাস আগে অভিযুক্তরা জিহাদকে মুম্বাই থেকে কলকাতায় নিয়ে আসেন।
জিজ্ঞাসাবাদে সিআইডিকে জিহাদ বলেছেন, আখতারুজ্জামানের নির্দেশেই তিনি ‘সব কাজ’ করেছেন। আরও চার জন বাংলাদেশি এই কাজে সাহায্য করেছেন।
ভারতীয় গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল বাংলাদেশে এসে ২৪ মে ঢাকায় গ্রেপ্তার তিনজনকের জিজ্ঞাসাবাদ করে যান। এরপর ২৫ মে কলকাতায় যান হারুন অর রশীদসহ ডিবির তিন কর্মকর্তা।
তারাও কসাই জিহাদকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন এবং তাকে নিয়ে সঞ্জিভা গার্ডেনসে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।
সোমবার দুপুরে সঞ্জিভা গার্ডেনস থেকে বেরিয়ে হারুন কলকাতায় সংবাদকর্মীদের বলেন, “এই সেই স্থান যেখানে আমাদের সংসদ সদস্যকে হত্যা করা হয়েছে, তার দেহ টুকরো টুকরো করার পর গায়েব করে ফেলা হয়েছে। এমন পরিকল্পিত নৃশংস হত্যাকাণ্ড আমি আমার জীবনে দেখিনি।”
গণমাধ্যমে অজ্ঞাত সূত্রের বরাত দিয়ে আনার ও শাহীনের দ্বন্দ্বের কারণ ‘স্বর্ণ চোরাচালান’ বলা হলেও এ বিষয়ে মুখ খুলছে না পুলিশ। আবার কীসের ব্যবসা নিয়ে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব, তা নিয়েও কোনো ধারণা দিচ্ছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। যদিও খুন হওয়ার আগে পরে ‘কী কী ঘটেছে’ তার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।
কলকাতায় ওই হত্যাকাণ্ডের মাস খানেক আগেই ঢাকার গুলশান ও বসুন্ধরার বাসায় বসে খুনের ছক আঁটা হয় বলে হারুনের ভাষ্য।
তবে দুই দেশের পুলিশ এখনও আখতারুজ্জামানের নাগাল পায়নি। তিনি কাঠমান্ডু থেকে দুবাই হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেছেন বলে পুলিশের ধারণা।