রিমান্ড আবেদনে বলা হয়, “গোপন সূত্রের মাধ্যমে জানতে পারি, আসামিদ্বয় কোটাবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ছাত্রদের কঠোর হস্তে দমন করার জন্য সরকারকে উসকানি প্রদান করে।”
Published : 22 Aug 2024, 04:18 PM
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় টঙ্গীতে গুলি করে পোশাক কর্মী হত্যার অভিযোগে উত্তরা পূর্ব থানার মামলায় বেসরকারি টেলিভিশন স্টেশন একাত্তর টেলিভিশনের সাবেক হেড অব নিউজ শাকিল আহমেদ ও সাবেক প্রিন্সিপাল করেসপনডেন্ট ফারজানা রূপাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য চার দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছে আদালত।
পুলিশের করা রিমান্ড আবেদনের শুনানি করে ঢাকার মহানগর হাকিম আহমেদ হুমায়ুন কবীর বৃহস্পতিবার এই আদেশ দেন।
দেশ ছেড়ে ফ্রান্সে যাওয়ার চেষ্টার সময় বুধবার ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গ্রেপ্তার করা হয় ৫১ বছর বয়সী শাকিল ও ৪৭ বছর বয়সী রূপাকে।
বৃহস্পতিবার তাদের আদালতে হাজির করে উত্তরা পূর্ব থানার মামলায় ১০ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের আবেদন করেন উত্তরা পূর্ব থানার এসআই মো. মোহাইমিনুর রহমান।
রাষ্ট্রপক্ষে প্রসিকিউশন পুলিশের পরিদর্শক আসাদুজ্জামান রিমান্ড আবেদন পড়ে শোনান। ওই আবেদনে বলা হয়, আন্দোলনের মধ্যে গুলিতে টঙ্গী এলাকার বেস্ট শার্টস গার্মেন্টের স্যাম্পল ম্যান মো. ফজলুল করিম (২৮) নিহতের ঘটনায় তার ভাই আনোয়ার হোসেন আয়নাল এ মামলা দায়ের করেন।
কারখানা বন্ধ থাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন ফজলুল। ৫ অগাস্ট তিনি উত্তরার জসিম উদ্দিন মোড়ের কাছে রাস্তার ওপর অবস্থান নিয়ে ছিলেন।
সেদিনের ঘটনার বিবরণ দিয়ে রিমান্ড আবেদনে বলা হয়, “বিকাল সাড়ে ৪টার সময় অত্র মামলার এজাহারে বর্ণিত আসামিদের নির্দেশে নির্দেশিত হইয়া আওয়ামী সন্ত্রাসী এবং অজ্ঞাতনামা আসামিরা দলবদ্ধভাবে একত্রিত হয়ে শটগান, পিস্তল, রিভলবারসহ অন্যান্য অস্ত্র দিয়া নির্বিচারে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের ওপর অতর্কিতভাবে গুলি চালায়।
“সেখানে বাদীর ভাইসহ অনেক ছাত্রজনতা গুলিবিদ্ধ হয়। বাদীর ভাইয়ের বুকের ডান পাশে সামান্য নিচে গুলি লাগলে তাৎক্ষণিকভাবে মাটিতে পড়ে যান। আন্দোলনে থাকা বাদীর আরেক ছোট ভাই মো. জিলানিসহ আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা দ্রুত তাকে চিকিৎসার জন্য কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি চাসপাতাল নিয়া যায়।”
সেখানে আইসিউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গভীর রাতে ফজলুলের মৃত্যু হয়। পরে বিনা ময়নাতদন্তে লাশের সৎকার করা হয়।
এ মামলায় শাকিল ও রূপার সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে রিমান্ড আবেদনে বলা হয়, “গোপন সূত্রের মাধ্যমে জানতে পারি, আসামিদ্বয় কোটাবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ছাত্রদের কঠোর হস্তে দমন করার জন্য সরকারকে উসকানি প্রদান করে। আসামিদের পুলিশ রিমান্ডে এনে নিবিড় ভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করলে উক্ত মামলার মূল রহস্য উদঘাটন করা যাবে।”
অন্যদিকে আসামিদের পক্ষে আইনজীবী মোল্লা জুলফিকার আলী রিমান্ডের বিরোধিতা করে জামিনের আবেদন করে দুই মিনিট কথা বলেন। এ সময় বিএনপিপন্থি ক্ষুব্ধ আইনজীবীদের বাধার মুখে পড়তে হয় তাকে।
বৃহস্পতিবার বিকাল ৩টার দিকে রূপা ও শাকিলকে এজলাসে তোলার সঙ্গে সঙ্গে বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা চোর চোর বলে তাদের গালি দিতে থাকেন। তারা স্লোগান দিতে থাকন– ‘শাকিল রূপার গালে গালে জুতা মারো তালে তালে।’
এ সময় কাঠগড়ায় দাঁড়ানো শাকিল রূপা বক্তব্য রাখার জন্য বিচারকের অনুমতি চাইলে হৈচৈ করে বাধা দেয়া হয়। বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা বলেন, তাদের তো আইনজীবী আছেন, তিনি বলুক।
এ সময় রাষ্ট্রপক্ষে আদালতের অনুমতি নিয়ে বিএনপিপন্থি জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ওমর ফারুক ফারুকী বলেন, “এদের কারণে অপ সাংবাদিকতায়, উসকানিতে শেখ হাসিনা এতটা স্বৈরাচারী হতে পেরেছে। টক শোর নামে একাত্তর টেলিভিশনে এরা সরকারের হয়ে উসকানিমূলক প্রশ্ন করত আলোচানায় আসা বিভন্ন লোকদের।
“কই অন্য সাংবাদিকদের তো কেউ কিছু বলছে না। তারাতো খারাপ সাংবাদিকতা করে না। এরা দুইজন স্বৈরাচারী হাসিনাকে আরো স্বৈরাচারী হতে সাহায্য করেছে।”
এ সময় ইরাকের সাদ্দাম হোসেনের পতনের সময়কার একটি ঘটনা তুলে ধরে ওমর ফারুক ফারুকী বলেন, “এদের ১০ দিনই রিমান্ড মঞ্জুর করা হোক।”
তিনি বলেন, “শেখ হাসিনা তো পালিযে গেলেন, এরাতো পালাতে পারলেন না। হাসিনাতো এদের বিদেশে নিলেন না।”
৮-১০ মিনিট শুনানি নিয়ে ১০ দিনের জায়গায় ৪ দিন রিমান্ড মঞ্জুর করা হলে আদেশ পাল্টে ১০ দিন করার জন্য হৈ চৈ করতে থাকেন আইনজীবীরা। পরে আদালত প্রত্যেককে ৪ দিনের রিমান্ডের আদেশ দিয়েই এজলাস ত্যাগ করেন।
রিমান্ড আদেশের পর পুলিশের বেষ্টনী ভেঙে রূপার হেলমেটে ঘুষি মারেন এক বিক্ষুদ্ধ আইনজীবী।
প্রবল গণআন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার পতনের পর গত ১০ অগাস্ট জাতীয় প্রেস ক্লাবের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদককে একটি চিঠি পাঠান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আব্দুল কাদের ও আবদুল হান্নান মাসুদ।
তাতে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সদস্য ৫০ জন সাংবাদিকের একটি তালিকা দিয়ে বলা হয়, এসব সাংবাদিক প্রতিনিয়ত পুলিশ ও আওয়ামী লীগকে মদদ এবং উসকানি দিয়েছেন। এভাবে তারা ছাত্রদের বিরুদ্ধে ‘মানবতাবিরোধী’ অপরাধে জড়িত ছিলেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষে এসব সাংবাদিককে সাংবাদিকতা অঙ্গনে নিষিদ্ধ করার দাবি তোলেন আব্দুল কাদের ও আবদুল হান্নান। ওই তালিকার ৫০ সাংবাদিকের মধ্যে শাকিল ও রূপার নাম আছে।
ওই তালিকা প্রকাশের আগেই গত ৮ অগাস্ট শাকিল ও রূপাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয় একাত্তর টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ। এ সাংবাদিক দম্পতির একটি কন্যা সন্তান রয়েছে।