অবরোধে বিভিন্ন সড়কে যান চলাচল বন্ধ থাকায় ভোগান্তিতে পড়েছে মানুষ।
Published : 10 Jul 2024, 12:12 PM
সরকারি চাকরির সব গ্রেডে সকল প্রকার ‘অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক’ কোটা বাতিল করে সংবিধানে উল্লেখিত অনগ্রসর গোষ্ঠীর জন্য কোটাকে ন্যূনতম মাত্রায় এনে সংসদে আইন পাস করে কোটাপদ্ধতি সংস্কারের এক দফা দাবিতে সারা দেশে সড়ক অবরোধের ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি নিয়ে রাস্তায় নেমেছে শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা।
বুধবার সকাল সাড়ে ১০টা থেকে আন্দোলনকারীরা নিজেদের দাবি সম্বলিত প্ল্যাকার্ড নিয়ে ঢাকার সায়েন্স ল্যাব মোড়, অ্যালিফেন্ট রোড, শাহবাগ, হাই কোর্টের কাছে মৎস্য ভবন মোড়, হানিফ ফ্লাইওভারের নিমতলী, বাংলা মোটর, ফার্মগেইট, আগারগাঁও এবং মহাখালীর আমতলীতসহ বিভিন্ন স্থান অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন।
মিরপুর রোড, কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, এয়ারপোর্ট রোড, রামপুরা- বাড্ডা রোড শহর রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলো বন্ধ থাকায় যান চলাচল একরকম বন্ধ হয়ে যায়। ফার্মগেইটে এক্সপ্রেসওয়ে থেকে নামার মুখ, জিরো পয়েন্টের মত গুরুত্বপূর্ণ সংযোগগুলো অবরুদ্ধ করে রাখেন আন্দোলনকারীরা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করায় যান চলাচল বিঘ্নিত হচ্ছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ করে দিয়েছেন। ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলপথ অবরোধ করেছেন। দুপুরে ঢাকার কারওয়ানবাজারেও রেলপথ আটকে দেওয় হয়।
এই অবরোধের ঘোষণায় অনেক যানবাহন বের না হওয়ায় বুধবার সকাল থেকেই রাজধানীর প্রধান সড়কগুলোতে যানবাহন চলাচল ছিল স্বাভাবিকের তুলনায় কম। ব্যক্তিগত গাড়ির পাশাপাশি এয়ারপোর্ট, মহাখালী, রামপুরা, মতিঝিল, মোহাম্মদপুরসহ অন্যান্য রুটের বাসও কম দেখা গেছে।
ফলে সকালে বাস না পেয়ে অফিসগামী যাত্রীদের ভোগান্তিতে পড়তে হয়। আবার ব্যক্তিগত গাড়ি এবং বাইকে করে যারা অফিস গেছেন, তারা ফাঁকা রাস্তার সুফল পেয়েছেন।
বেলা সাড়ে ১০টার পর আন্দোলনকারীরা রাস্তায় নামতে শুরু করে। এরপর শাহবাগ, সায়েন্স ল্যাবরেটরি, গুলিস্তানসহ আশপাশের এলাকার সড়কে যানজট শুরু হয়।
মৎস্যভবনের কাছে অবস্থান নেওয়া শিক্ষার্থী আমিনুর রহমান রুবেল বলেন, “আমাদের যৌক্তিক দাবির জন্য আমরা অবস্থান নিয়েছে। জরুরি সেবা ছাড়া কোনো যানবাহন আমরা চলতে দেব না। আমরা কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটাব না। কাউকে ঘটাতেও দেব না।”
এর আগে রবি ও সোমবার চার দফা দাবিতে সংক্ষপ্তি সময়ের জন্য ‘বাংলা ব্লকেড’ পালন করে আন্দোলনকারীরা। ওই দুই দিনও ঢাকার বিভিন্ন সড়কে যানজটে ভুগতে হয় মানুষকে।
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে এক সংবাদ সম্মেলনে চার দফা দাবিতে এক দফা দাবিতে নামিয়ে আনেন তারা। তাদের দাবি হল- ‘সকল গ্রেডে সকল প্রকার অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা বাতিল করে সংবিধানে উল্লেখিত অনগ্রসর গোষ্ঠীর জন্য কোটাকে ন্যূনতম পর্যায়ে এনে সংসদে আইন পাস করে কোটা পদ্ধতিকে সংশোধন করতে হবে৷’
এই দাবিতে বুধবার সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সারাদেশে বাংলা ব্লকেড কর্মসূচির ঘোষণা আসে ওই সংবাদ সম্মেলনে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে সংবাদ সম্মেলন আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম কর্মসূচির ঘোষণা দিয়ে বলেন, রেলপথ ও সড়কপথ এই অবরোধের অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
অবরোধ চিত্র
সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সায়েন্স ল্যাব মোড় অবরোধ করেন ঢাকা ও ইডেন মহিলা কলেজের শিক্ষার্থীরা। তাতে আজিমপুর- মিরপুর সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ভোগান্তিতে পড়েন এই রাস্তা দিয়ে চলাচলকারীরা।
বেলা পৌনে ১২টার দিকে শাহবাগ মোড়ে জড়ো হয়ে রাজধানীর অন্যতম গুরুত্পূর্ণ এই সড়ক অবরোধ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। সময়ের সঙ্গে তাদের উপস্থিতি বাড়তে থাকলে শাহবাগ মোড়ের চারপাশের রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়।
শাহবাগে আন্দোলনকারীদের একটি অংশ কাছেই হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল ও বাংলামোটরের দিকে ছড়িয়ে পড়েন।
এর আগে সকাল ১০টার আগে থেকেই আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারের সামনে জড়ো হতে থাকেন।
গ্রন্থাগারের সামনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম বলেন, “হাই কোর্ট আজকে ২০১৮ সালে পরিপত্র বহালের আদেশ দিলেও আমরা রাজপথ ছাড়ব না। কারণ আজকে শুধু স্টে অর্ডার হবে। এটা কিন্তু পূর্ণাঙ্গ রায় নয়। পূর্ণাঙ্গ রায় ২০১৮ সালের পরিপত্র আবারও বাতিল হয়ে যেতে পারে।
"আমরা আমাদের এক দফা দাবিতে বলেছি, সকল গ্রেডে যৌক্তিভাবে কোটা সংস্কার করতে হবে। ২০১৮ সালের পরিপত্র শুধু প্রথম ও দ্বিতীয় গ্রেডে কোটা বাতিল করা হয়েছিল। আমরা চাই, সকল গ্রেডে কোটা বাতিল হোক। সেখানে প্রতিবন্ধী ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য ৫ শতাংশ কোটা বহাল রাখা যেতে পারে।”
বেলা ১১টার দিকে গ্রন্থাগারের সামনে থেকে আন্দোলনকারীরা মিছিল বের করেন। ওই মিছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল ও সড়ক ঘুরে শাহবাগে এসে অবস্থান নেয়।
বিক্ষোভ কর্মসূচিতে শিক্ষার্থীরা 'হাই কোর্ট না শাহবাগ, শাহবাগ, শাহবাগ', '১৮ এর হাতিয়ার গর্জে উঠুক আরেকবার,' 'কোটা না মেধা, মেধা মেধা', 'সারা বাংলায় খবর দে, কোটা প্রথার কবর দে', '১৮ এর পরিপত্র পুনর্বহাল করতে হবে', 'সংবিধানের মূল কথা সুযোগের সমতা', 'কোটা প্রথা নিপাত যাক, মেধাবীরা মুক্তি পাক' বলে স্লোগান দিতে থাকেন।
একই সময়ে রাজধানী গুলিস্তানের জিরো পয়েন্ট অবরোধ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি সুফিয়া কামাল হল,শহীদুল্লাহ্ হল ও ফজলুল হক মুসিলম হলের শিক্ষার্থীরা।
সড়কে গাড়ি নেই, বিপদে নগরবাসী
মিরপুরের কালশী মোড়ে বাসের অপেক্ষায় থাকা হাফসা আক্তার জানান, বাড্ডার অফিসে যেতে গাড়ির জন্য 'হয়রান’ হতে হচ্ছে তাকে।
"অনেকক্ষণ পর বাস এলেও এত যাত্রী, উঠতে পারি নাই। সিএনজিও অনেক টাকা চাচ্ছে। কীভাবে অফিসে যাব, বুঝতে পারছি না।"
মহাখালীর আমতলীর অফিসে যেতে সকালে মিরপুরে বাসের জন্য ২০ মিনিট অপেক্ষা করেছিলেন বেসরকারি চাকরিজীবী কাজী রাশেক-উর-রহমান।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, "রাস্তায় গাড়ির জন্য বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়েছে। কিন্তু গাড়ি কম থাকায় রাস্তায় ফাঁকা ছিল।
নাহিদ আলম নামে একজন ভাড়ার প্রাইভেট কার চালক বলেছেন, সকাল ৭টায় বের হয়ে তিনি দুটো মাত্র ট্রিপ দিতে পেরেছেন। সকালে মোহাম্মদপুর থেকে মতিঝিল এরপর মতিঝিল থেকে বনানী যান। বনানী থেকে ফেরার পথেই সাড়ে ১১টার দিকে যানজটে পড়েন।
তিনি বলেন, “গাড়ির জন্য সিএনজি পাওয়া যাইতাছে না। আর প্রতিটা পাম্পে লম্বা লাইন। তার উপ্রে এই যানজটে আটকা থাইকা সব গ্যাস পুড়তাছে। আইজ মনে হয় রাস্তায় গ্যাস শেষ হয়্যা যাইব।”
ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে বেলা পৌনে ১২টার দিকে জানানো হয়, কোটা আন্দোলনকারীরা সায়েন্স ল্যাবরেটরির মোড়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিমতলী এলাকা এবং মহাখালীর আমতলী এলাকায় রাস্তা বন্ধ করে রেখেছে। এছাড়া আরও কয়েকটি জায়গায় তারা নেমেছে বলে খবর আসছে।
ঢাকার সড়কে দায়িত্ব পালন করা ট্রাফিক সদস্যরা জানান, বুধবার সকাল ১০টার আগে থেকেই রাস্তায় যান চলাচল কমে যায়।
বাংলামোটরে কর্তব্যরত বোরহানউদ্দীন নামে এক ট্রাফিক সদস্য ১১টার দিকে বলেছেন রাস্তা স্বাভাবিক রয়েছে। তবে তার হিসেবে অন্য দিনগুলোতে সকালে এর চেয়ে বেশি যানবাহন চলাচল করে।
বৈশাখী পরিবহনের হেলপার আল আমিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তাদের বলে দেওয়া হয়েছে সকাল ১০টার মধ্যেই ট্রিপ গুছিয়ে ফেলতে।
“সকাল ১১টা পর্যন্ত তারা রাস্তা ফাঁকাই পাইছি। এখন সাভারের দিকে চলে যাব।”
ঢাকার প্রবেশমুখ
দক্ষিণাঞ্চলের সিলেট, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, ফেণি, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী ও মুন্সিগঞ্জ, বরিশাল রুটের প্রবেশ দুয়ার রাজধানীর যাত্রাবাড়ি-গুলিস্তানে গণপরিবহনের চলাচল স্বাভাবিকের চেয় কম দেখা গেছে।
নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদ, সাইনবোর্ড, চিটাগাঙ রোড, রায়েরবাগ, শনির আখাড়া ও কেরানীগঞজ, পোস্তগোলা, শ্রীনগর, মুন্সিগঞ্জ থেকে চাকরি এবং ব্যাবসার কাজে প্রতিদিনি ঢাকায় আসা যাত্রী চাপ কম দেখা গেছে। সড়কে গাড়িও ছিল কম।
চাপ না থাকায় কোনো ধরনের অপেক্ষা করা ছাড়াই গুলিস্তান-যাত্রাবাড়ী মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারে চলাচলের সময় টোল প্লাজা অতিক্রম করেছে পরিবহনগুলো।
মতিঝিলের পুঁজিবাজার, ব্যাংক পাড়া ও সরকারি-বেসরকারি অফিসগামীদের বড় একটি অংশ এই পথে চলাচল করে।
জাবেদ আক্তার নামের এক ব্যাংকার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শনির-আখাড়া মতিঝিল রুটের হিমালয় বাসে আসার সময়ে ফ্লাইওভারে কোনো প্রকার জ্যাম দেখিনি। বাসা থেকে ২০ মিনিটে চলে আসছি মতিঝিল। অফিস আওয়ারের এই এই টাইমে আসতে ৪৫ মিনিটের মত সময় লাগে সাধারণত।’’
এ সড়কে পরিবহন চাপ কম থাকায় নির্দিষ্ট সময়ের ২৫ মিনিট আগেই মতিঝিল অফিসে পৌঁছানোর কথা জানিয়েছেন আক্তারুজ্জামান।
রাজধানীর অফিসপাড়া মতিঝিল এলাকায় গাড়ির সংখ্যা স্বাভাবিকের চেয়ে কম দেখা গেছে বেলা ১০টা নাগাদ।
যাত্রাবাড়ী-গাবতলি রুটে চলাচলকারী গাবতলি লিংক পরিবহনের চালক আজিজুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্যাসেঞ্জার একটু কমই। গাড়িও অনেক ড্রাইভার নামায়নি। স্টুডেন্টদের আন্দোলনতোম কী তে কী হয়, একটু বেলা কইরা সবাই গাড়ি নামাব। গাড়ি বাইর না করলে খাবো কী?’’