“আশা নিয়ে কত ছেলে মেয়ে পরীক্ষা দিতে যাচ্ছে। যদি পরীক্ষা দিতে না পারে, তাহলে তো তরুণরা আশাহত হবে,” বলেন রেলের পাকশীর ডিআরএম।
Published : 06 Mar 2024, 10:50 PM
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চলের চেষ্টায় প্রশংসা ঝরছে।
একটি ট্রেনকে পরীক্ষার আগে আগে রাজশাহী পৌঁছে দিতে কর্মকর্তাদের আপ্রাণ চেষ্টার পর একশরও বেশি পরীক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নিতে পেরেছেন।
এই চেষ্টা করতে গিয়ে দুটি ট্রেনের যাত্রা বিলম্ব করতে হয়েছে, উল্টো পাশের একটি ট্রেনকে থামিয়ে তার ইঞ্জিন কেটে নিয়ে রাজশাহীগামী ট্রেনে যুক্ত করতে হয়েছে, একটি নির্ধারিত স্টেশনে যাত্রাবিরতি বাতিল করতে হয়েছে আর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অনির্ধারিত স্টেশনে যাত্রাবিরতি করা হয়েছে।
এখানেই শেষ নয়, ট্রেনটি নির্ধারিত সর্বোচ্চ গতিতে চলছে কি না, পুরো পথেই তা পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। লাইন ক্লিয়ার করতে নিতে হয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা।
রেলের একজন কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, তার চাকরি জীবনের ১৮ বছরে এমন ঘটনা কখনো ঘটেনি।
মঙ্গলবার ঢাকা থেকে রাজশাহীগামী ধূমকেতু এক্সপ্রেসে এই ঘটনা ঘটে।
ট্রেনটি এমনিতে ভোর ৬টায় ঢাকা থেকে ছাড়ে, পৌঁছে বেলা ১১টা ৪০ মিনিটে। কিন্তু সেদিন ট্রেনটি অনেক দেরিতে চলছিল।
সকাল ১১টায় হিসেব করে দেখা গেল, ট্রেনটি বিকেল ৩টা নাগাদ রাজশাহী পৌঁছবে। বিজ্ঞান অনুষদভুক্ত ‘সি’ ইউনিটে পরীক্ষা হওয়ার কথা বিকাল সাড়ে তিনটায়।
তাও কোনো ঝুঁকি না নিয়ে পরীক্ষার্থীদের কথা চিন্তা করে অন্য ট্রেনগুলোকে বসিয়ে দিয়ে এই ট্রেনটি চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেন কর্মকর্তারা।
কিন্তু বিপত্তি বাঁধে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া পার হয়ে। রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক অসীম কুমার তালুকদার ফেইসবুকে এক পোস্টে লেখেন, “ভাগ্য এতই খারাপ, লাহেড়ী মোহনপুর স্টেশনে এসে ধূমকেতুর ইঞ্জিন ফেইল করে, চাকা ঘুরছে না।”
সে সময় নীলফামারী থেকে ঢাকাগামী চিলাহাটি এক্সপ্রেস ট্রেনটি শরৎনগর স্টেশনে ছিল। সেই ট্রেনের ইঞ্জিন কেটে ধূমকেতু এক্সপ্রেসে যুক্ত করে ছাড়া হয় ট্রেন। কিন্তু এতে নষ্ট হয়ে যায় অনেকখানি সময়।
তখন হিসাব করে দেখা গেল ট্রেনটি পৌঁছবে বিকাল ৪টায়। ততক্ষণে পরীক্ষার আধা ঘণ্টা পেরিয়ে যাবে। আর রাজশাহী স্টেশন থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পৌঁছার সময় মিলিয়ে কেন্দ্রে বসাই হবে না।
তখন অসীম কুমার তালুকদার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য গোলাম সাব্বির সাত্তারের সঙ্গে ফোনে কথা বলে পরীক্ষার সময় পেছানোর অনুরোধ করেন। তিনিও ৪ বার ফোন করে ট্রেনের খবর নেন।
“ট্রেন সর্বোচ্চ অনুমোদিত গতিতে চলছে, দুশ্চিন্তা ছাড়ছে না। পরীক্ষার্থীদের পরীক্ষা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। উপায়ন্ত না দেখে আড়ানী স্টেশনের স্টপেজে ট্রেন না থামিয়ে থ্রু পাস করলাম। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় স্টেশনে ট্রেন থামিয়ে দিলাম বিকেল ৩টা ৩৮ মিনিটে। হলে ঢুকতে হবে ৪টার মধ্যে। ভিসি মহোদয়কে বিনীত অনুরোধ করলাম, ছেলেমেয়েদের হলে ঢোকার সুযোগ দেওয়ার জন্য। তিনি কথা রাখলেন এবং রেলওয়ের সবাইকে ধন্যবাদ দিলেন”, লেখেন রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক।
ট্রেনটি এভাবে টেনে নিয়ে যাওয়ার কাজে পাবনার পাকশী কন্ট্রোলে সার্বক্ষণিক মনিটরিং করেন বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপক (ডিআরএম) শাহ সুফি নূর মোহাম্মদ।
ধূমকেতুর দেরি যেসব কারণে
রেলের পাকশীর ডিআরএমের সঙ্গে এ নিয়ে বিস্তারিত কথা বলেছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।
এই কর্মকর্তা জানান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা উপলক্ষে ঢাকা-রাজশাহী রুটের চারটি ট্রেনেরই সাপ্তাহিক ছুটি বাতিল করা হয়। প্রতিটি ট্রেনে যুক্ত করা হয় বাড়তি কোচ। এ কারণে এই রুটে ট্রেনের সময়সূচিতে গড়বড় লেগে যায়।
তিনি বলেন, “ট্রেনে গোটা সপ্তাহে যে লেট হয়, সেটি সাপ্তাহিক ছুটিতে সমন্বয় করা হয়। কিন্তু এখানে সে সুযোগ ছিল না। আবার অতিরিক্ত কোচ যুক্ত হলে সেখানেও কিছু বাড়তি ব্যবস্থা নিতে হয়। ট্রেনে পানি দেওয়া থেকে শুরু করে নানা কাজ করতে হয়। সেটিও করা যায়নি।
“আবার রেল লাইন ভেঙে গিয়েছিল। ট্রেনের (ধূমকেতু এক্সপ্রেস) লোকোমেটিভ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। সব মিলিয়ে এই ঘটনাটি ঘটে।”
যেভাবে বাঁচানো হয় সময়
নূর মোহাম্মদ বলেন, “আমাদের উল্লাপাড়া থেকে রাজশাহী যেতে দুই ঘণ্টা সময় লাগে। সেটা এক ঘণ্টা ৩৮ মিনিটে পৌঁছে দিয়েছি।”
সেকি কীভাবে করেছেন? – তিনি বলেন, “চালককে বলেছি জোরে চালাবে। রেলে একটা অনুমোদিত সর্বোচ্চ গতি থাকে। আমরা কন্ট্রোল রুমে বসে সেটি ট্র্যাকিং করতে পারি। যখনই দেখেছি সেই গতির চেয়ে কমে গেছে, সঙ্গে সঙ্গে ফোন করে তাগাদা দিয়েছি।
“আবার লাইন ক্লিয়ার করতে হয়। সেটি সাধারণত হাতে হাতে করা হয়। কিন্তু এতে সময় নষ্ট হতো। তাই সেটি না করে মোবাইল ফোন দিয়ে করেছি। এভাবেই ২৮ মিনিট বাঁচাতে পেরেছি।”
তৃতীয় যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়, সেটি হলো যাত্রাবিরতির স্টেশন পাল্টে দেওয়া।
ধূমকেতু এক্সপ্রেসের রাজশাহী ইউনিভার্সিটি স্টেশনে যাত্রাবিরতি নেই। এর যাত্রাবিরতি আড়ানী স্টেশনে, যেটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেশ দূরের।
নূর মোহাম্মদ বলেন, “আড়ানী স্টেশনে স্টপেজ আছে, সেটি বাতিল করা হয়েছে। যাত্রীদের বলেছি তারা আব্দুলপুর, ইউনিভার্সিটি বা রাজশাহী স্টেশনে নামতে পারবেন। এরপর আমাদের অন্য কোনো ট্রেনে করে আড়ানীতে ফিরতে পারবেন। ছাত্রদের কথা জানিয়ে ট্রেনে সেই ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
“যাত্রীরা ১০ কিলোমিটার সড়ক পথে রান করেছেন। কিন্তু তারা প্রতিবাদ করেননি। তাদের অভিযোগ করার সুযোগ ছিল, কিন্তু তারা ছেলে মেয়েদের কথা ভেবে সহযোগিতা করেছেন।”
চিলাহাটি ট্রেনের যাত্রীদেরকেও ধন্যবাদ জানান এই রেল কর্মকর্তা। তিনি বলেন, “সেই ট্রেনের ইঞ্জিন কেটে নেওয়া হয়েছে। তারা বাধা দেয়নি। তাদেরও প্রশংসা করতে হয়। তারাও ধন্যবাদ পাওয়া যোগ্য।”
ছাত্রদের কথা বলার কারণেই কি এই ট্রেনের যাত্রীরাও বাধা দেননি? – নুর মোহাম্মদ বলেন, “তাদেরকে বলা হয়েছিল। তবে বললেও অনেক সময় মানুষ বুঝতে চায় না। নিজের স্বার্থ ছাড় দিতে চায় না। এখানে তারা ছাড় দিয়েছেন। এ জন্য শরৎনগর স্টেশনে এক ঘণ্টা সময় বাড়তি লেগেছে তাদের। তাদেরকেও ধন্যবাদ জানাই।”
তাড়না এবং ভয়
এমন পদক্ষেপ নেওয়ার পেছনে দুটো কারণের কথা বলেন রেলের পাকশীর ডিআরএম। তিনি বলেন, “আমাদের তাড়না ও ভীতি দুটোই কাজ করেছে।
“তাড়না বলতে এটা আবেগের বিষয়। আশা নিয়ে কত ছেলে মেয়ে পরীক্ষা দিতে যাচ্ছে। রাজশাহীতে এই সময়ে প্রতি বছরই অনেক ছেলেপুলে আসে। সেখানে থাকার জায়গা পাওয়াও কঠিন। এ কারণে অনেকে আগের রাতে বা অন্তিম মুহূর্তে আসে। যদি পরীক্ষা দিতে না পারে, তাহলে তো তরুণরা আশাহত হবে। এটা মেনে নেওয়া কঠিন।”
ভয় কীসের?- তিনি বললেন, “ভীতি হলো তারা যদি বিক্ষুব্ধ হয়ে যায়! অনেক সময় তাদেরকে উসকানি দেওয়া হয়। তখন বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারত।”
আপনি কি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন?- তিনি জবাব দিলেন, “না আমি বুয়েটের ছাত্র।”
এমন পদক্ষেপ কি আগেও নিয়েছেন কখনো?- তিনি বললেন, “সাধারণত নেওয়া হয় না।”
এই কর্মকর্তা রেলে যোগ দেন ২০০৬ সালে। এই ১৮ বছরের চাকরি জীবনে আগে কখনো এমন পদক্ষেপ নিতে হয়েছে কি না- এই প্রশ্নে বললেন, “প্রয়োজন হয়নি।”
তিনি জানান, অভিজ্ঞতা না থাকার কারণেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যখন বারবার সময় জানতে চেয়েছিল, তারা সুনির্দিষ্ট বলতে পারেননি। আনুমানিক ৪টার কথা বলেছিলেন।
তার ২২ মিনিট আগেই পৌঁছে দিতে পারায় তৃপ্ত বলেও জানান নুর মোহাম্মদ।
রেলওয়ে থেকে কোনো ধন্যবাদ কি পেয়েছেন?- পাকশীর ডিআরএম বললেন, “আমরা এটা প্রত্যাশাও করি না। এটা আমাদের জব। কাজটা করতে পেরেছি, তাতেই তৃপ্ত। আর আমাদের জবটাই থ্যাংকলেস। এটা নিয়ে আমরা ভাবি না।”
কত পরীক্ষার্থী পেলেন সুযোগ
বুধবার ঘটনাটি নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে আসেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার।
তিনি জানান, ধূমকেতু এক্সপ্রেসে থাকা আনুমানিক ১২৫ জন পরীক্ষার্থীকে তারা কেন্দ্রে প্রবেশের সুযোগ দিয়েছেন। তাদের প্রায় ২০ মিনিট মত দেরি হয়েছিল। তবে তাদেরকে অতিরিক্ত সময় দেয়া হয়নি।
উপাচার্য বলেন, “নিয়মানুযায়ী পরীক্ষা শুরুর ১৫ মিনিট পরে কেন্দ্রে কাউকে প্রবেশ করতে দেয়া হয় না। কিন্তু মানবিক দিক বিবেচনায় আমরা তাদেরকে কেন্দ্রে প্রবেশের সুযোগ দিয়েছি।”