বিমান বলছে, ভারতের স্থানীয় বিধিনিষেধ এবং নাগপুর বিমানবন্দরের সীমাবদ্ধতার কারণে যাত্রীদের ভোগান্তিতে পড়তে হয়।
Published : 23 Feb 2025, 10:04 PM
ভারতের নাগপুরে জরুরি অবতরণ করা ফ্লাইটের যাত্রীদের ‘সবরকম সহযোগিতা’ করার কথা দাবি করা হলেও সংবাদমাধ্যমে প্রকৃত চিত্র উঠে আসার পর ব্যর্থতা স্বীকার করে নিয়েছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স।
তবে ওই ব্যর্থতার জন্য নাগপুর বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের ‘সীমাবদ্ধতা’ এবং কিছু ক্ষেত্রে ‘অসহযোগিতাকে’ দায়ী করেছে বিমান।
ঘটনার চারদিন পর রোববার পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বিমানের পক্ষ থেকে বলা হয়, ভারতের স্থানীয় বিধিনিষেধ এবং নাগপুর বিমানবন্দরের সীমাবদ্ধতার কারণে যাত্রীদের ভোগান্তিতে পড়তে হয়, যা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষের ‘নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল’।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ভারতীয় কর্তৃপক্ষ যাত্রীদের অস্থায়ী ল্যান্ডিং পারমিট না দেওয়ায় তাদের কোনো হোটেলেও নেওয়া যায়নি। পরদিন দুপুর দেড়টা থেকে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য নাগপুর বিমানবন্দর বন্ধ হয়ে যাওয়ায় উদ্ধারকারী উড়োজাহাজটি যথাসময়ে যাত্রীদের নিয়ে দুবাইয়ের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যেতে পারেনি।
গত ১৯ ফেব্রুয়ারি বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের দুবাইগামী একটি বোয়িং ৭৭৭ যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে ভারতের মহারাষ্ট্র রাজ্যের নাগপুরের ‘ড. বাবা সাহেব আমবেদকার’ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে জরুরি অবতরণ করে।
পরদিন বিমানের পক্ষ থেকে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বলা হয়, সব যাত্রী ও ক্রু সুস্থ আছেন এবং যাত্রীদের ‘অত্যন্ত সুচারুরূপে সবধরনের সাপোর্ট’ দেওয়া হয়েছে।
বিমানের আরেকটি ফ্লাইটে তাদের দুবাই পাঠানোর কথাও বলা হয় বিমানের সেই সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে।
কিন্তু যাত্রীরা দুবাই পৌঁছে বিমানের ভেতরের ভোগান্তির চিত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করা শুরু করলে পরিস্থিতি পাল্টে যায়। বিশেষ করে যাত্রী দুর্ভোগের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, যা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে বিমান।
রোববার বিমানের পক্ষ থেকে বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে ওই ঘটনা নিয়ে আনুষ্ঠানিক ব্যাখ্যা দেওয়া হয়। সেখানে যাত্রী দুর্ভোগের জন্য নাগপুর বিমানবন্দরের ‘সীমাবদ্ধতা ও অসহযোগিতাকে’ দায়ী করার পাশাপাশি ভিডিও প্রকাশ করা দুই যাত্রীর বিরুদ্ধে ‘উসকানি’ দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বিমানের ঢাকা-দুবাই রুটের ফ্লাইট বিজি ৩৪৭ ঢাকা থেকে ১৯ ফেব্রুয়ারি রাত ৮টা ৪০ মিনিটে যাত্রা শুরু করে। ওই বোয়িং ৭৭৭ উড়োজাহাজে দুইজন পাইলট, ১০ জন কেবিন ক্রু এবং ৩৯৬ জন যাত্রীর পাশাপাশি ২২ টন কার্গো ছিল।
যাত্রাপথে ভারতের মহারাষ্ট্র প্রদেশের নাগপুর শহর অতিক্রম করার সময় ক্যাপ্টেন পেছনের কার্গো কম্পার্টমেন্ট থেকে ককপিটে ফায়ার অ্যালার্ম পান। সে সময় যাত্রীদের রাতের খাবার দেওয়া হচ্ছিল।
বিমান বলছে, ফ্লাইটের পাইলট-ইন-কমান্ড তখন ‘নিয়ম অনুযায়ী’ পদক্ষেপ নেন এবং উড়োজাহাজ পরিচালনার দিক নির্দেশানুযায়ী বাংলাদেশ সময় রাত ১১ ২৭ মিনিটে নিরাপদে নাগপুর বিমানবন্দরে অবতরণ করেন।
তার আগে পাইলট ‘যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে নাগপুরে অবতরণের’ সিদ্ধান্তটি ইন-ফ্লাইট অ্যানাউন্সের মাধ্যমে যাত্রীদের জানিয়ে দেন বলে বিমানের ভাষ্য।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ফ্লাইটটি নাগপুরে অবতরণের পর যাত্রীদের উড়োজাহাজ থেকে নামিয়ে নেওয়া হয়। যাত্রী ও ক্রুসহ ৪০৮ জনকে বিমানবন্দরে যাত্রীদের জন্য ব্যবহৃত কয়েকটি বাসে করে উড়োজাহাজ থেকে আনুমানিক আধা কিলোমিটার দূরে নিয়ে যাওয়া হয়।
“বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ এক ঘণ্টা ২০ মিনিটের বেশি সময় ওই ৪০৮ জনকে বিমানবন্দর টার্মিনালে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেয়নি। এ সময় পানি এবং টয়লেট সুবিধার জন্য যাত্রীরা বার বার অনুরোধ করার পরেও ভারতের নাগপুর বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ নিরাপত্তা অনুমতির আনুষ্ঠানিকতার প্রসঙ্গ তুলে তাদের টার্মিনালে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া থেকে বিরত থাকে।
“এতে সব যাত্রী, বিশেষভাবে বৃদ্ধ এবং নারী যাত্রীরা সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে পড়েন। পরবর্তীতে রাত ১টায় টার্মিনালে যাত্রীদের লাউঞ্জে নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়।”
ঘটনার ধারাবাহিকতা তুলে ধরে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “নাগপুর বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষকে ই-মেইল এর মাধ্যমে যাত্রীদের সকালের নাশতা ও দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা নিতে ঢাকা থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয় এবং সেইসাথে আশ্বস্ত করা হয় যে, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স যাত্রীদের সকল বিষয়ের যাবতীয় খরচ বহন করবে।
“নাগপুর কর্তৃপক্ষ জানায়, এই বিপুল সংখ্যক খাবার তৈরির জন্য তাদের তিন থেকে চার ঘণ্টা সময় প্রয়োজন। বোয়িং ৭৭৭ এর মত এত বড় আকারের যাত্রীবাহী উড়োজাহাজ ওই বিমানবন্দরে নিয়মিত চলাচল করে না। বিমানের যাত্রীদের হোটেলে পাঠানের জন্য অনুরোধ করা হলে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ যাত্রীদের অস্থায়ী ল্যান্ডিং পারমিট দিতে অপরাগতা জানায়। এ কারণে বাধ্য হয়ে যাত্রীদের টার্মিনালেই থাকতে হয়।”
যাত্রীদের দেখাশোনা করার জন্য দিল্লিতে বিমানের দায়িত্বপ্রাপ্ত স্টেশন ম্যানেজার পরদিন সকাল সোয়া ৯টার দিকে নাগপুরে পৌঁছালেও তাকে ভেতরে যেতে অনেকক্ষণ ‘অপেক্ষা করতে হয়’ বলে বিমানের ভাষ্য।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “অনুমানিক ভোর ৩টার দিকে যাত্রীদেরকে পানি সরবরাহ করা হয়। সকাল ৭টার দিকে পানি ও চা দেওয়া হয় এবং সকাল সাড়ে ১০টায় নাশতা পরিবেশন করা হয়। নাগপুরে ক্যাটারিং-এর সীমিত সক্ষমতা থাকার কারণে নাস্তা দিতে সময় বেশি লেগেছে।”
উদ্ধারকারী উড়োজাহাজ ছাড়া নিয়েও জটিলতা
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ওই উড়োজাহাজের সকল কার্গোতে ফায়ার এক্সটিংগুইশার ব্যবহৃত হওয়ায় সেটি দিয়ে যাত্রীদের দুবাইয়ে নিয়ে যাওয়া ‘সম্ভব না’ বলে মতামত দেয় বিমানের ইঞ্জিনিয়ারিং টিম। সে অনুযায়ী বিমান ঢাকা অপারেশন্স কন্ট্রোল উদ্ধারকারী ফ্লাইটের পরিকল্পনা নেয়।
ভারতের প্রয়োজনীয় অনুমতি পাওয়ার পর ২০ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সময় সকাল ১০টা ২৮ মিনিটে উদ্ধারকারী ফ্লাইট যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশ সময় দুপুর ১২টা ৪৯ মিনিটে নাগপুরে অবতরণ নামে।
“তবে নাগপুর বিমানবন্দরের রানওয়ে রক্ষণাবেক্ষণ কাজের জন্য দুপুর দেড়টা থেকে বন্ধ রাখা হবে এটা জেনে উদ্ধারকারী ফ্লাইটটির ক্যাপ্টেন অবতরণের পরপরই অপেক্ষমাণ যাত্রীদের উড়োজাহাজে বসতে এবং দ্রুততম সময়ের মধ্যে যাত্রীদের ব্যাগেজবহনকারী কন্টেনারগুলো ফ্লাইটে লোড করার নির্দেশনা দেন। যাত্রীরা উড়োজাহাজে বসলেও নাগপুর একটি আঞ্চলিক বিমানবন্দর হওয়ায় বৃহদাকার উড়োজাহাজের ব্যাগেজ কন্টেইনার লোড করার জন্য শুধুমাত্র একটি যন্ত্র এবং অপর্যাপ্ত কন্টেইনার ট্রলির কারণে কল্পনাতীত সময়ক্ষেপণের পর কন্টেইনার লোডিং শেষ হয়।
“এরই মধ্যে রানওয়ে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বিমানবন্দর বন্ধ হয়ে যায়। এরপর আবার বাংলাদেশের বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের অনুরোধে বিকাল ৫টা ৪২ মিনিটে উদ্ধারকারী ফ্লাইটটি নাগপুর থেকে দুবাইয়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে এবং নিরাপদে দুবাইতে অবতরণ করে।”
বিমান বলছে, নাগপুর বিমানবন্দরে অপেক্ষাকালীন সময়ে যাত্রীদের দুপুরের খাবার উড়োজাহাজের ভেতরে পরিবেশন করা হয়। উড্ডয়নের পর যাত্রীদের জন্য রাতের খাবারও দেওয়া হয়।
দুর্ভোগের কারণ নিয়ে বিমানের ভাষ্য
জরুরি অবতরণের পর বিমান কর্তৃপক্ষ যাত্রী দুর্ভোগের সম্ভাব্য ছয়টি কারণ চিহ্নিত করেছে।
# ভারতের নাগপুর একটি আঞ্চলিক বিমানবন্দর। এই বিমানবন্দরের ধারণ ক্ষমতা সীমিত।
# নাগপুর বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের নিরাপত্তা অনুমতির দীর্ঘসূত্রতার কারণে যাত্রীদের টার্মিনালে না নিয়ে বহু সময় বাসে অবস্থান করতে হয়। যার কারণে পানি এবং টয়লেটের ব্যবস্থা থেকে যাত্রীরা বঞ্চিত হন।
# নাগপুর বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ বিমানের ওই যাত্রীদের অস্থায়ী অবতরণের অনুমতি দিতে অস্বীকৃতি জানায়। ফলে বাধ্য হয়ে বিমান যাত্রীদেরকে হোটেলে না পাঠিয়ে টার্মিনালে অপেক্ষমাণ রাখতে হয়।
# ভারতের নাগপুর বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ ৩৯৬ জন যাত্রীর খাবার প্রস্তুতে অন্যান্য বিমানবন্দরের তুলনায় বেশি সময় নেয়।
# ভারতের নাগপুর বিমানবন্দরের গ্রাউন্ড সাপোর্ট ইকুইপমেন্টের স্বল্পতার জন্য যাত্রীদের ব্যাগেজবাহী কন্টেইনার লোডিং এ দীর্ঘ সময় লাগে। ফলে বিমানবন্দর বন্ধের আগে উদ্ধারকারী উড়োজাহাজটি টেক অফ করতে (উড়তে) পারেনি।
# টার্মিনালের ভেতরে যাত্রী লাউঞ্জে বিমানের দিল্লির স্টেশন ম্যানেজারের ঢোকার পাস ইস্যুর ক্ষেত্রেও নাগপুর বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ কালক্ষেপণ করায় যাত্রীদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখা সম্ভব হয়নি।
সামাজিক মাধ্যমে প্রচার নিয়ে ভাষ্য
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিমানের বিরুদ্ধে ‘প্রপাগান্ডা’ চালানো হচ্ছে অভিযোগ করে প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এর প্রতিবাদ জানিয়েছে বিমান।
সেখানে বলা হয়, “উড়োজাহাজের ভেতরে ভিডিও ধারণ নিষিদ্ধ থাকার পরও নাগপুরে উদ্ভূত পরিস্থিতিকে ব্যবহার করে বর্তমান সরকার এবং বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সকে বিব্রত করার জন্য একজন নারী এবং একজন পুরুষ যাত্রী ওই ফ্লাইটের ভেতরেই সাধারণ যাত্রীদের উদ্দেশ্যে উসকানিমূলক বক্তব্য দেন। এরপর তারা ভিডিও ধারণ করে সোশাল মিডিয়াসহ বিভিন্ন মাধ্যমে তা প্রচার করেন।
“ওই দুই যাত্রী ফ্লাইটে ক্রমাগত উসকানিমূলক বক্তব্য দিলেও অন্য যাত্রীরা তাদের কথায় কর্ণপাত করেননি এবং ধৈর্য্য নিয়ে ফ্লাইটে অবস্থান করে কর্মরত ক্রুদের সহযোগিতা করেন।”
‘ধৈর্য্য ধারণকারী’ যাত্রীদের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞাতা প্রকাশ কারর পাশাপাশি দুই যাত্রীর ‘প্রপাগান্ডার তীব্র প্রতিবাদ’ জানানো হয়েছে বিমানের বিজ্ঞপ্তিতে।
সেখানে বলা হয়, “সর্বোপরি নিয়ন্ত্রণ বর্হিভূত পরিস্থিতির কারণে সম্মানিত যাত্রীদের সাথে সংঘটিত অসুবিধাগুলোর জন্য বিমান কর্তৃপক্ষ গভীরভাবে দুঃখ প্রকাশ করছে।”
পুরনো খবর-
যান্ত্রিক জটিলতা: নাগপুরে জরুরি অবতরণ করল বিমান
নাগপুরে জরুরি অবতরণ: বিমান যাত্রীদের 'আতঙ্ক আর ভোগান্তির' দুবাই যাত্রা