“আমরা সারারাত লাউঞ্জে কী করে কাটালাম তার দেখভাল করেনি বিমান,” বলেন এক যাত্রী।
Published : 22 Feb 2025, 12:41 AM
ঢাকা দুবাইয়ের পথে উড়াল দেওয়ার ঘণ্টা দুই পরই ভারতের নাগপুরে জরুরি অবতরণ করতে হয়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি বোয়িং-৭৭৭ উড়োজাহাজকে; এরপর দীর্ঘ বিরতি, অনিশ্চয়তা আর ভোগান্তি নিয়ে বিকল্প উড়োজাহাজে যাত্রীরা পৌঁছান গন্তব্যে।
দুবাইয়ে পৌঁছানোর পরই যাত্রীরা যেন দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন; তাদের কেউ কেউ ওই যাত্রায় দুর্ভোগের কথা তুলে ধরে উষ্মা প্রকাশ করেন।
বুধবার রাত ৮টা ৫৩ মিনিটে ঢাকা থেকে রওনা হয় বিমানের ফ্লাইট বিজি-৩৪৭। রাত প্রায় পৌনে ১১টায় মাঝ আকাশে ক্যাপ্টেন একটি ‘টেকনিক্যাল সিগন্যাল’ পেলে কাছাকাছি ভারতের নাগপুর এয়ারপোর্টে জরুরি অবতরণ করেন। এরপর আটকা পড়া ৩৯৫ যাত্রীকে গন্তব্যে পৌঁছে দিতে ঢাকা থেকে আরেকটি বোয়িং-৭৭৭ বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১২টার পর নাগপুরে পৌঁছায়। সেই উড়োজাহাজ বৃহস্পতিবার রাতে দুবাইয়ে পৌঁছায়।
ওই ফ্লাইটের যাত্রী মৌলভীবাজারের জুবায়ের আহমদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নাগপুর এয়ারপোর্টে নামার পর থেকে যাত্রীরা হয়রানির শিকার হয়। যাত্রীদের সবাইকে ছয়টি বাসে করে নিয়ে এয়ারপোর্টের এক প্রান্তে আটকে রাখা হয়। প্রতিটি বাসে আট-দশ জন যাত্রী ছাড়া বাকি যাত্রীদের দাঁড়িয়ে সময় কাটাতে হয়। কাউকে বাস থেকে নামতে দেওয়া হয়নি। কেউ বাথরুমে যেতে চাইলেও তাকে যেতে দেওয়া হয়নি।
“দুই ঘণ্টা পর বাস আমাদের এয়ারপোর্ট টার্মিনালে নিয়ে যায়। এরপর আমরা সারা রাত লাউঞ্জে কী করে কাটালাম তার দেখভাল করেনি বিমান। সকাল ১০টার দিকে আমাদের বিমানের পক্ষ থেকে ব্রেকফাস্ট দেওয়া হয়।”
জুবায়ের বলেন, “বেলা সাড়ে ১২টার দিকে বাংলাদেশ থেকে আমাদের জন্য বিকল্প ফ্লাইটটি আসে। বিকাল ৩টার দিকে আমরা ফ্লাইটে উঠি। বিমান টেক অফ করার সময় জানানো হয় যে, রানওয়ের জরুরি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আড়াই ঘণ্টা পর বিমান উড্ডয়ন করতে পারবে। এতে বিশেষ করে বিমানে থাকা শিশু, মহিলা ও বয়স্ক যাত্রীদের দুর্ভোগের শেষ থাকে না।”
তিনি বলেছেন, মৌলভীবাজার থেকে বুধবার সকাল ৯টায় তিনি ঢাকার বাস ধরেছিলেন। এই যাত্রায় ৩৬ ঘণ্টা পর দুবাই পৌঁছাতে সক্ষম হন।
ফেইসবুকে মাছরাঙা টেলিভিশনের প্রকাশ করা এক ভিডিওতে দেখা যায়, এক নারী যাত্রী বিমানকর্মীদের বলছেন, “আমাদের কি জান-মালের কোনো মূল্য নাই। এটা কি হচ্ছে… কাল থেকে আজ পর্যন্ত আমাদের কোনো খোঁজ খবর নিচ্ছে না বাংলাদেশ বিমান।”
কথা বলতে বলতে সে নারীকে কাঁদতে দেখা যায়। তিনি বলেছিলেন, সাড়ে ৮টায় ফ্লাইট ছাড়ার কথা, ৯টা, ৯টা ৪০ এ বিমান ছাড়ার পর এখানে আইসা, নাগপুরে ল্যান্ড করছে। বলছে ওয়েদারের সমস্যা, কোনো ওয়েদারের সমস্যা না। আগুন জ্বলছে। তারপর এখানে ল্যান্ড করছে। তারপর কোনো খোঁজ নাই। বিমানের যাত্রীরা অসুস্থ্য, কেন দুই ঘণ্টা লেট করবে।”
সে নারী বলছিলেন, “আমরা কি মানুষ না, আমরা প্রবাসী, তাই বলে প্রবাসীদের সঙ্গে এ রকমটা হবে।… বাংলাদেশ সরকারের কোনো কর্তৃত্ব নাই।… আমাদের পরিবারের সঙ্গেও যোগাযোগ করতে পারছি না। এখানেও না, ওখানেও না।”
ঢাকা চেম্বার অব কমার্সের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি রাজীব হাসান চৌধুরী একই ফ্লাইটের যাত্রী ছিলেন। ভারতের নাগপুরে উড়োজাহাজের জরুরি অবতরণকে তিনি ‘অগ্নিপরীক্ষা’ হিসেবে বর্ণনা করেন।
রাজীব বলেন, “ঢাকা থেকে উড্ডয়ন ও নাগপুর অগ্নিপরীক্ষার পর অবশেষে ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে দুবাই পৌঁছাতে পেরে নিজেকে ভাগ্যবান মনে হচ্ছে। বুধবার রাতে আমরা ঢাকা ছাড়ি। উড়াল দেওয়ার আড়াই ঘণ্টা পর বিমানের কার্গো কেবিনে অ্যালার্ম বাজায় বিমানকে জরুরি অবতরণ করতে হয় নাগপুরে।
“আমার স্ত্রী, মা, বোন যারপরনাই উদ্বেগে পড়ে যান। সবার দোয়ায় আল্লাহর রহমতে কোনো বিপদ হয়নি।”
পরিবারের পাঁচ সদস্য নিয়ে বিমানের ওই ফ্লাইটের যাত্রী হয়েছিলেন মোহাম্মদ রাকিব শুভ। উড়োজাহাজে এমন অভিজ্ঞতা তার আগে হয়নি জানিয়ে বলেন, “নাগপুরের আকাশে যখন ইমার্জেন্সি ল্যান্ডিংয়ের ঘোষণা এল, তখন যাত্রীদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়। কিন্তু নাগপুর এয়ারপোর্টে বিমানের স্বাভাবিক ল্যান্ডিং হয়।
“যদিও এয়ারপোর্টে ফায়ার সার্ভিস অ্যাম্বুলেন্স তৈরি ছিল এবং সব ধরনের সতর্কতামূলক প্রস্তুতি রাখা হয়েছিল, এ ধরনের পরিস্থিতিতে আগে কখনও পড়িনি।”
উড়োজাহাজে অ্যালার্ম ও জরুরি অবতরণের বিষয়ে বিমানের দুবাই রিজিওনাল ম্যানেজার সাকিয়া সুলতানা বলেন, “বিমান থেকে জানানো হয়, উড়োজাহাজের কার্গো কেবিন থেকে ফায়ার অ্যালার্ম আসায় জরুরি অবতরণের সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল। উদ্ধারকারী উড়োজাহাজটি বৃ্হস্পতিবার রাতে দুবাই ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে যাত্রীদের নিয়ে নিরাপদে অবতরণ করে।”
যাত্রীরা ভোগান্তির অভিযোগ করলেও বৃহস্পতিবার বিমানের জনসংযোগ বিভাগের মহাব্যবস্থাপক বোসরা ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডট্কমকে বলেন, “নাগপুর এয়ারপোর্টে সকল যাত্রীকে অত্যন্ত সুচারুরূপে সবধরনের সাপোর্ট দেওয়া হয়। আটকা পড়া যাত্রীদের গন্তব্যে পৌঁছে দিতে ঢাকা থেকে আরেকটি বোয়িং-৭৭৭ নাগপুরে পৌঁছায়। পরে সেই উড়োজাহাজ যাত্রীদের নিয়ে দুবাইয়ের উদ্দেশে রওনা দেয়।”
যাত্রীদের সাময়িক অসুবিধার জন্য এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে দুঃখ প্রকাশ করে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স।
এর আগে ২০২৪ সালের ৭ সেপ্টেম্বর রাতে দুবাই থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেয় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি উড়োজাহাজ। কিন্তু উইন্ডস্ক্রিনে ফাটল দেখা দেওয়ায় ২ ঘণ্টার মধ্যে ২৪৪ যাত্রী নিয়ে সেটি দুবাই ফিরে আসে।
একই বছরের ২১ জানুয়ারি ঢাকা থেকে সৌদি আরবের পথে রওনা দেওয়ার পর উইন্ডশিল্ডে ফাটল দেখা দেয় উড়োজাহাজে। ওই যাত্রায় ২৯৭ আরোহী নিয়ে শাহজালাল বিমান বন্দরে ফিরে আসে বোয়িং ৭৮৭-৯ মডেলের উড়োজাহাজ।
আরও পড়ুন-
যান্ত্রিক জটিলতা: নাগপুরে জরুরি অবতরণ করল বিমান