ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, প্রোটোকল অনুযায়ী যৌথ নদী কমিশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে নদীর পানি প্রবাহের তথ্য নিয়মিত বিনিময় করে ভারত, ‘এবারও’ তাই করা হয়েছে।
Published : 26 Aug 2024, 10:26 PM
পদ্মার উজানে ফারাক্কা ব্যারেজের সব গেইট খুলে দেওয়ার কারণে বাংলাদেশে বন্যার শঙ্কা নিয়ে সংবাদমাধ্যমে যেসব প্রতিবেদন আসছে, সে বিষয়ে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল সোমবার রাতে এক বিবৃতিতে বলেন, “আমরা এমন কিছু ভুয়া ভিডিও, গুজব এবং আতঙ্ক জাগানিয়া তথ্য দেখতে পাচ্ছি, যা ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টির জন্য ছড়ানো হচ্ছে। এর বিপরীতে সঠিক তথ্য অবশ্যই প্রকাশিত হওয়া দরকার।”
বিবৃতিতে বলা হয়, “সংবাদমাধ্যমে ফারাক্কা ব্যারাজের গেটগুলো খুলে দেওয়ার খবর আমরা দেখেছি, যার ফলে ব্যারেজ দিয়ে এর স্বাভাবিক গতিপথে গঙ্গা/পদ্মা নদীতে ১১ লাখ কিউসেক পানি প্রবাহিত হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে।”
বিষয়টিকে বর্ষা মৌসুমের একটি ‘স্বাভাবিক ঘটনা’ হিসেবে বর্ণনা করে তিনি বলেছেন, উজানে গঙ্গা নদীর অববাহিকায় ভারি বৃষ্টিপাত হলে পানির প্রবাহ যখন বেড়ে যায়, তখন সব সময়ই ব্যারেজের গেইট খুলে দেওয়া হয়।
জয়সওয়াল বলছেন, “এটা বুঝতে হবে যে ফারাক্কা কেবল একটি ব্যারেজ, ড্যাম নয়। যখনই জলের স্তর ব্যারেজের স্তরে পৌঁছায়, যে পরিমাণ পানির প্রবাহই আসুক, তা বেরিয়ে যায়।
“এটা গঙ্গা/পদ্মা নদীর ওপর গেট বসিয়ে বানানো একটি কাঠামোমাত্র, যা এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যাতে মূল নদী থেকে ৪০ হাজার কিউসেক পানি প্রত্যাহার করে ফরাক্কা খালে নেওয়া যায়, আবার বাংলাদেশের দিকে জলপ্রবাহের ভারসাম্যও ঠিক থাকে।”
বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশের সঙ্গে প্রোটোকল অনুযায়ী যৌথ নদী কমিশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে নদীর পানি প্রবাহের তথ্য নিয়মিত বিনিময় করে ভারত, ‘এবারও’ তাই করা হয়েছে।
বাংলাদেশের ফেনী, কুমিল্লাসহ দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের বেশ কিছু জেলায় গত সপ্তাহে যখন নজিরবিহীন বন্যা শুরু হয়, তখনও ভারতকে দায়ী করে সমালোচনা হচ্ছিল ফেইসবুকে। ত্রিপুরায় ডাম্বুর জলবিদ্যুৎকেন্দ্রের জলকপাট খুলে দেওয়ায় বাংলাদেশ ভেসে যাচ্ছে– এমন অভিযোগে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ হয় সে সময়।
তবে ভারত দাবি করে, বিষয়টি তথ্যগতভাবে ‘সঠিক নয়’। ত্রিপুরার বিদ্যুৎমন্ত্রী রতন লাল নাথ দাবি করেন, গোমতী জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কোনো গেইট ‘খুলে দেওয়া হয়নি’।
এক সপ্তাহ না যেতেই বাংলাদেশে পশ্চিমে ভারতের ফারাক্কা ব্যারেজের ১০৯টি গেটের সবগুলোই খুলে দেওয়ার খবর আসে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে। স্বাভাবিকভাবেই বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তুমুল আলোচনা শুরু হয় এবং এর সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমেও বিভিন্ন প্রতিবেদন প্রকাশিত হতে থাকে।
ব্যারেজ কর্তৃপক্ষের বরাত দিয়ে ভারতের নিউজ এইট্টিনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, “বিহার ও ঝাড়খণ্ডে বিপুল পরিমাণ বৃষ্টি হওয়ায় এবং ফারাক্কা বাঁধ প্রকল্পের জলস্তর বৃদ্ধি হতেই সমস্ত গেট খুলে দেওয়া হয়েছে।”
জলস্তর বৃদ্ধি পওয়ায় ১১ লক্ষ কিউসেক পানি ছাড়ার তথ্য দিয়ে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমটি লিখেছে, “এই জল ছাড়ার ফলে গঙ্গা থেকে জল ঢুকছে বিভিন্ন গ্রামে ও মাঠে। প্লাবনের আশঙ্কা করছেন মুর্শিদাবাদের মানুষ। বিহার, ঝাড়খণ্ড-সহ গঙ্গার উচ্চ অববাহিকায় ব্যাপক বৃষ্টি হয়েছে। যার ফলে হুহু করে বাড়ছে গঙ্গার জলস্তর।”
হিমালয় থেকে উৎপন্ন গঙ্গা নদীর প্রধান শাখা চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে, সেখান থেকে নদীটির নাম হয়েছে পদ্মা।
বাংলাদেশের সীমান্ত থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার দূরে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলায় গঙ্গা নদীর ওপর ফারাক্কা ব্যারেজ পুরোপুরি চালু হয় ১৯৭৫ সালে। ২,২৪০ মিটার দীর্ঘ এ ব্যারেজের আপ স্ট্রিমে পানি ধারণ ক্ষমতা ২৬.২৪ মিটার এবং বিপৎসীমা ২২.২৫ মিটার।
পানি না ছাড়লে ফারাক্কা ব্যারেজ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি ছিল– এমন তথ্য দিয়ে নিউজ এইট্টিন লিখেছে, “তবে ফারাক্কা ব্যারেজ থেকে জল ছাড়ার কারণেই বাংলাদেশ প্লাবিত হচ্ছে বলেই দাবি করা হয়েছে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে।”
তবে বাংলাদেশে পদ্মা নদীতে এখনও তেমন কোনো প্রভাব দেখা যায়নি জানিয়ে রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মোকলেসুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সাধারণত বর্ষার সময় ফারাক্কা ব্যারেজের সব গেট খোলাই থাকে। কারণ গেইট খেলা না থাকলে তো আমরা এই পানি পেতাম না। তবে ভারতের দুটি রাজ্যে বন্যা পরিস্থিতি অবনতি হওয়ার ফারাক্কায় চাপ বেড়েছে।”
মোকলেসুর রহমান বলেন, “এটি স্বাভাবিক বন্যার পানি; পাহাড়ি ঢল নামেনি। ফলে বড় আশঙ্কার কিছু নেই।”
রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডের গেজ রিডার এনামুল হক জানান, পদ্মার রাজশাহী পয়েন্টে সোমবার সকাল ৬টায় পানির উচ্চতা ছিল ১৬ দশমিক ২৮ মিটার। সেটি বেড়ে সন্ধ্যা ৬টায় হয়েছে ১৬ দশমিক ৩০ মিটার। এই পয়েন্টে বিপৎসীমা ১৮ দশমিক ০৫ মিটার। অর্থাৎ, ওই সীমা ছাড়িয়ে গেলে বন্যা বলা যাবে।
“ফারাক্কা ব্যারেজের সবগুলো গেট খুলে দেওয়ার যে কথা শোনা যাচ্ছে, তার প্রভাব এখনো পদ্মায় পড়েনি। সেই পানি রাজশাহীতে আসতে সময় লাগবে। আগামীকাল থেকে তার প্রভাব বোঝা যেতে পারে।”
এনামুল হক বলেন, “ভারতে বন্যা বেশি হলে ফারাক্কা হয়ে বেশি পানি বাংলাদেশে প্রবেশ করবে এটাই স্বাভাবিক। পদ্মায় পানি বাড়লে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ ও বাংলাদেশের কয়েকটি জেলায় বন্যা হয়। বিশেষ করে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, কুষ্টিয়া, রাজবাড়ী ও মানিকগঞ্জসহ আশপাশের জেলাগুলোর নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হতে পারে।”
ফারাক্কা ব্যারেজ খুলে দেওয়ার বড় কোনো প্রভাব এখনই বাংলাদেশে পড়বে না বলে মনে করছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হানও।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলে, “ফারাক্কা ব্যারেজ খুলে দেওয়ায় পানি অনেক বাড়বে সেরকম কিছু এখনই দেখছি না। গঙ্গা অববাহিকায় নদীর পানি স্থিতিশীল আছে। আগামী পাঁচ দিনেও স্থিতিশীল থাকবে বলেই ধারণা করছি। এখানই পানি বিপৎসীমায় যাবার ঝুঁকি আপাতত নেই।”
ফারাক্কার গেট খুলে দেওয়ার বিষয়ে ভারত থেকে কোনো তথ্য দেওয়া হয়েছিল কি না– সেই প্রশ্নে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব নাজমুল আহসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেস, “ফারাক্কার যে গেটগুলো খুলে দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে, এগুলো আগে থেকেই খোলা ছিল, মুনসুনে সব বাঁধই এরকম খোলা থাকে। এক্ষেত্রে কোনো পূর্ব সতর্কতা দেওয়া হয় না। আমরা যেমন আমাদের তিস্তা ব্যারেজ খুলে দিই, তেমন অন্য ব্যারেজগুলোও খোলা থাকে। আমরা খোঁজ নিয়েছি রাজশাহীতে। ওখানে ওয়াটার লেভেল সেইমই আছে।”
পুরনো খবর