“শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ট্রেনিং ম্যানুয়াল শেষ করেছি, আমরা খুব শিগগিরই তাদের প্রশিক্ষণ দেব,” বলছেন এনসিটিবি চেয়ারম্যান।
Published : 22 Feb 2024, 12:23 AM
দিনাজপুর সদর উপজেলার বেলবাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ১২৩ শিক্ষার্থীর মধ্যে ৩০ জনই বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর সদস্য। এই ৩০ জনের আবার বেশির ভাগই সাঁওতাল।
স্কুলে ঢুকেই এই শিশুদের পড়তে হয় ‘ভাষাগত সংকটে’। সংখ্যায় তারা এক-চতুর্থাংশ হলেও সেখানে তাদের ভাষায় পড়াবার মত কোনো শিক্ষক নেই। ফলে বাংলাভাষী শিক্ষার্থীদের যখন জানার পরিধি বাড়তে থাকে, তখন ‘না বোঝার দুনিয়া’ এই শিশুদের হতাশায় ফেলে, বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ার কারণও হয়।
স্কুলটির প্রধান শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমীন বলছেন, শুরুতে নৃগোষ্ঠীর শিশুরা নিজেদের ভাষায় কথা বলে, যা শিক্ষকরা বোঝেন না। আবার শিক্ষকদের বলা বাংলাও তারা তেমন বুঝতে পারে না।
“শিশু শ্রেণি থেকেই ওরা সমস্যায় পড়ে যায়। নিজেদের প্রয়োজন বোঝাতে পারে না এই সাঁওতাল ও অন্য নৃগোষ্ঠীর শিশুরা। ফলে পাঠেও তেমন মনোযোগ দিতে পারে না।”
সাবিনা বলেন, “ওরা বাংলা শিখে তো স্কুলে আসে না। প্রথম বছরটা যুদ্ধ করে ওদের বাংলা শিখতে হয়।
“অনেক শিশু হতাশ হয়ে যায়, অনেকে ক্লাসে আসে না। আমরা আবার তাদের সাথে যোগাযোগ করে ফিরিয়ে আনি।”
ভাষার এ সংকট কাটিয়েই পড়াশোনা চালিয়ে দিনাজপুরের লাপোল কড়া এখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। তার ভাষ্য, এ পর্যায়ে আসতে তাকে রীতিমতো ‘ভাষার সঙ্গে যুদ্ধ’ করতে হয়েছে।
“যখন স্কুলে ভর্তি হই, তখন আমরা দেখি সবাই বাংলায় কথা বলে। সেটা তো আমরা বুঝি না। তখন এক প্রকার যুদ্ধ করে ভাষাটা শিখতে হয়। ভাষা শিখতেই প্রায় এক বছর সময় চলে যায়। তবু কি খুব ভালো শিখতে পারি?”
এ কারণে আদিবাসী শিশুরা পড়াশোনায় আগ্রহ হারাচ্ছে মন্তব্য করে লাপোল বলেন, “কয়েকটি আদিবাসী ভাষায় পাঠ্যবই আছে। সাদরি বলে যে ভাষাটিতে বই হয়েছে, সেটি আমরা ভালোই বুঝতে পারি, কিন্তু আমাদের নিজেদের ভাষায় বই থাকলে বাচ্চাদের জন্য সহজ হত।”
বাংলাদেশের সবচেয়ে কম জনসংখ্যার নৃগোষ্ঠীর একটি ‘কড়া’; সর্বসাকুল্যে টিকে থাকা ২৮টি কড়া পরিবারের মধ্যে ২৪টির ৯৪ জন মানুষ বাস করে দিনাজপুরের বিরল উপজেলার ঝিনাইকুড়ি গ্রামে।
আর বাকি চারটি পরিবারের ১১ জন নারী-পুরুষ ও শিশুর বাস দিনাজপুরেরই সদর উপজেলার আউলিয়াপুর ইউনিয়নের ঘুঘুডাঙ্গা গ্রামে।
লাপোলের বাড়ি ঝিনাইকুড়িতে। নিজেদের ভাষার লিখিত রূপ না থাকায় শিক্ষাগ্রহণে তাদের সমস্যা বহু পুরনো।
২০২২ সালের জনশুমারি অনুযায়ী, দেশে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী রয়েছে ৫০টি, যাদের সদস্য সাড়ে ১৬ লাখের কিছু বেশি, অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার ১ শতাংশ।
অবশ্য জাতীয় আদিবাসী পরিষদের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক মানিক সরেন মনে করেন, নৃ-গোষ্ঠীর সংখ্যা এবং শুমারির জনসংখ্যার অনুপাতে ‘শুভঙ্করের ফাঁকি’ রয়েছে।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের তথ্য বলছে, বাংলাদেশের এই নৃগোষ্ঠীগুলোর ১৪টি ভাষা বিপন্ন অবস্থায় রয়েছে।
অবশ্য আদিবাসী অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলোর দাবি, এ সংখ্যা আরও বেশি।
ধুঁকতে থাকা এই ভাষাগুলো টিকিয়ে রাখতে আশা দেখিয়েছিল ২০১০ সালের শিক্ষানীতি; যেখানে আদিবাসীদের মাতৃভাষায় শিক্ষাব্যবস্থা করাকে সরকার প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্য হিসেবে নিয়েছিল।
গত ১৪ বছরে এ লক্ষ্য পূরণে অগ্রগতি হয়েছে সামান্যই। শিক্ষানীতি প্রণয়নের সাত বছর পর ২০১৭ সালে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো ও সাদরি জাতিগোষ্ঠীর ভাষায় পাঠ্যবই পায় শিশুরা। পরের ৭ বছরে পাঠ্যক্রমে নতুন আর কোনো ভাষা যুক্ত করা যায়নি।
প্রাক-প্রাথমিক থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত যে পাঁচ ভাষার জাতিগোষ্ঠীর শিশুরা পড়তে পারছে, তাতেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না, এমনটিই বলছেন শিক্ষক-অভিভাবকরা।
নেত্রকোণার বারমারী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ডলি ম্রং বলছেন, নিজেদের ভাষায় পাঠ্যবই থাকলেও শিক্ষক না থাকায় বাংলাতেই পড়তে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের।
“এখানে গারো শিক্ষার্থী আছে, পাঠ্যবই আছে। কিন্তু বোঝানোর জন্য গারো ভাষায় শিক্ষক নেই। থাকলে পাঠ্যবইটা কাজে আসত। কারণ শিক্ষক বাংলায় পড়াচ্ছে, সে কারণে বাচ্চারা উপকার পাচ্ছে না।”
গারো এই শিক্ষক বলেন, গারো ভাষার পাঠ্যবইয়ে যে ভাষাগত রূপ ব্যবহার হয়েছে, তা তিনি নিজেই বুঝতে পারেন না।
“এটি আমাদের খাঁটি ‘আচিক’ ভাষায় লেখা। কিন্তু আমরা তো আঞ্চলিকতায় অভ্যস্ত। সে কারণে আদি শুদ্ধ এই ভাষাটা আমরাই বুঝতে পারি না। তাহলে বাচ্চারা বুঝবে কীভাবে? পাঠ্যবই লেখায় বিষয়গুলো বিবেচনা করা উচিত ছিল।”
এসব সমস্যা এড়াতে পারছে না তিন পার্বত্য জেলার শিক্ষার্থীরাও, যেখানে বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর সবচেয়ে বেশি মানুষের বাস।
খাগড়াছড়ির কাকড়াছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি উশৈমং মারমা বলেন, তার স্কুলের সব শিক্ষার্থীই মারমা জনগোষ্ঠীর। নিজেদের ভাষায় পাঠ্যবই ও শিক্ষক থাকলেও শিশুদের শিক্ষা ঠিক পথে এগোচ্ছে না।
এর কারণ হিসেবে তিনি সামনে আনছেন- নিজেদের ভাষার লিখিত রূপ সম্পর্কে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সদস্যদের ধারণা কম থাকাকে। তাদের বেশিরভাগই মায়ের ভাষায় কথা বলতে পারলেও লিখতে কিংবা পড়তে পারেন না।
উশৈমং মারমা বলেন, “বাচ্চারা পড়তে গিয়ে নানা সংকটে পড়ে। সরকার মারমা ভাষায় বই দিলেও মারমা শিক্ষকরাই এই বই ভালোভাবে পড়তে বা লিখতে জানেন না। তারা কিছু কিছু পারেন।
“কারণ তাদের মধ্যে আঞ্চলিকতা আছে। অনেকে শিক্ষক বলতে পারলেও মারমা ভাষায় লিখতে পারেন না। ফলে বইয়ের সুফল শতভাগ পাচ্ছে না বাচ্চারা।”
উশৈমং মারমার মেয়ে প্রাথমিক শেষ করে এ বছর ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ছে। এই অভিভাবক জানান, ভাষাগত জটিলতার কারণে প্রাথমিকে তার মেয়ে মারমা ভাষায় পড়লেও লেখার ক্ষেত্রে বাংলা ভাষাকেই বেছে নিয়েছে।
সংকট অনেক, উদ্যোগ সীমিত
পাঁচটি ভাষায় পাঠ্যবই তৈরি ছাড়া আদিবাসী শিক্ষার্থীদের ভাষাগত সংকট নিরসনে সরকারি কার্যক্রম দেখা যায়নি।
তবে দেশের কোথাও কোথাও বেসরকারি উদ্যোগের খবর মিলছে। এর মধ্যে দিনাজপুর সদরের আটটি ইউনিয়নের ১৮টি স্কুলে গ্রাম বিকাশ কেন্দ্র নামের একটি সংগঠন প্রাক-প্রাথমিকের শিশুদের জন্য একজন করে শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছে। এই শিক্ষকরা শিশুদের স্কুলে উপস্থিতি নিশ্চিত করার পাশাপাশি আদিবাসী শিশুদের নিজস্ব ভাষায় বুঝিয়ে পড়ান।
সরকারি এই স্কুলগুলোতে বাংলা ছাড়া অন্য কোনো ভাষা জানেন, এমন শিক্ষক নেই।
এসব স্কুলের একটি পূর্ব খোশালপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গ্রাম বিকাশ কেন্দ্রের শিক্ষক মমতা কর্মকার বলেন, দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত ক্লাসে শিক্ষক যা পড়ান, সেটি বাচ্চাদের নিজেদের ভাষায় বুঝিয়ে দেওয়া হয়। আবার বাচ্চাদের ভাষাও শিক্ষকদের বুঝিয়ে দেন তিনি।
“ভাষাগত সমস্যার কারণে আগে এসব বাচ্চার মধ্যে ভয় কাজ করত। এখন তারা সবার সঙ্গে সহজে মিশতে পারছে, শিখতে পারছে।”
গ্রাম বিকাশ কেন্দ্রের প্রধান সমন্বয়কারী শ্যামল কান্তি সিংহ রায় সংস্থাটির এক সমীক্ষা তুলে ধরে বলেন, তাদের তৎপরতায় বাংলা ভাষা না বোঝার কারণে স্কুল থেকে ঝরে পড়া শিশু কমেছে, উত্তীর্ণ শিক্ষার্থী বাড়ছে। বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর শিশুদের স্কুলে যাওয়ার হারও বেড়েছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী লাপোল কড়া বলেন, তিনি নিজে যে সংকটে পড়েছিলেন, কড়া ভাষার শিশুদের তা থেকে মুক্ত করতে স্কুলে থাকতেই ব্যক্তিগত উদ্যোগে নিজেদের ভাষায় পাঠ্যপুস্তকের পড়া বুঝিয়ে দিতেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য গ্রাম ছাড়ার পরে তিনি আশ্রয় পেয়েছিলেন দিনাজপুরের ‘ভাবনা’ নামের একটি সংগঠনে। সেখানে আসার পর তিনি বুঝতে পারছিলেন, গ্রামের ছেলেমেয়েরা পিছিয়ে পড়ছে পড়াশোনায়। তাই ভাবনার কাছে সহায়তা চান একটি ‘বিকল্প পাঠশালা’ তৈরি করে দেওয়ার।
ভাবনার উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ‘কড়া পাঠশালা’য় পড়ছে ২১ জন শিক্ষার্থী, যাদের কেউ কেউ স্কুলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে, কেউবা ইতোমধ্যে স্কুলে যায়।
লাপোল বলেন, “এর মাধ্যমে বাচ্চারা তাদের ভাষায় পাঠ্যপুস্তক বুঝে নিতে পারছে, বাংলা ভাষাও শিখছে। একটু বড় ক্লাসের শিক্ষার্থীদের জন্য অংক, ইংরেজির শিক্ষা দেওয়া হয়। এখন তারা সমস্যা কম ফেইস করছে।”
বিলুপ্তির ঝুঁকিতে পড়া কড়া ভাষা নিয়ে লাপোলের আক্ষেপ, “ভাষাটা নিয়ে কাজ করলে এটি বাঁচত।”
ভাবনার প্রধান নির্বাহী মুস্তাফিজুর রহমান রূপম বলেন, “ভাষার সমস্যায় ওরা স্কুল বিমুখ হয়ে পড়ে, সেই সঙ্গে অভাব তো আছেই। কড়া পাঠশালায় শিক্ষকরা ওঁরাও জাতির, তারা সাদরিতে কথা বলেন এবং কড়াদের ভাষাটা ভালোভাবে জানেন।
“তারা- যে শিশুরা প্রাতিষ্ঠানিক স্কুলে যাবে, তাদের সঙ্গে মিশে পাঠটা ভালো করে বুঝিয়ে দেন, যেন বাংলায় পড়তে গিয়ে স্কুল থেকে না পালায়। যারা স্কুলে যাচ্ছে, তারা যেন আরো ভালো করে, সেই চেষ্টাও করা হয়।”
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার চাকরি ছেড়ে বান্দরবানের লামার চম্পাঝিরি গ্রামে পাওমাং বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছেন রূপা দত্ত। তিনি জানান, ২০১১ সাল থেকে চম্পাঝিরি গ্রামের মানুষ একটা অনিয়মিত স্কুল পরিচালনা করে আসছিল। ২০১৩ সালে রূপা ও তার বন্ধুরা মিলে একটি নিয়মিত স্কুলে রূপান্তর করেন। বর্তমানে এই স্কুলের শিক্ষার্থী এখন ১১৬ জন, যাদের ৯৫ শতাংশই ম্রো। এছাড়া চাকমা, বাঙালি, ত্রিপুরা ও খুমি শিক্ষার্থী রয়েছে স্কুলটিতে। তাদের প্রায় সবাই ‘পাওমাং শিশুসদন’ নামে স্কুলটির আবাসিক শিক্ষার্থী।
ভাষাগত প্রতিবন্ধকতার কারণে এসব শিশু পিছিয়ে রয়েছে জানিয়ে রূপা দত্ত বলেন, “পড়াতে গিয়ে আমি দেখছি, বাংলায় লেখাটা আদিবাসী বাচ্চাদের কাছে সহজবোধ্য নয়। ওরা অধিকাংশই মুখস্থ করে লেখে। কিন্তু সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর লিখতে গিয়েই ওরা বিপদে পড়ে যায়। কারণ ওরা তো বাংলাটা খুব ভালো করে পারে না।
“প্রচলিত শব্দের বাইরের শব্দ সে বোঝে না। আর সরকারের যে পাঁচটি ভাষার বই রয়েছে, সেগুলো পড়ানোর শিক্ষক এখানে নেই। কারণ মারমা, চাকমা বা ম্রো শিক্ষকরা নিজেদের ভাষা পড়তে পারেন, লিখতে পারেন না বেশির ভাগ। আবার একই স্কুলে যখন কয়েকটি ভাষার বাচ্চারা পড়ে, তখন একজন শিক্ষকের পক্ষে তো পড়ানো সম্ভব নয়।”
শিক্ষার্থীরা ‘না বুঝে’ পড়ার কারণে আনন্দ পায় না এবং অনেক ক্ষেত্রেই ঝরে পড়ে বলে রূপার ভাষ্য।
“ঝরেপড়ার সাথে আর্থিক অস্বচ্ছলতারও একটা ব্যাপার আছে। পাহাড়ে বিদ্যালয়ের দুর্গমতাও ঝরে পড়ার অন্যতম কারণ হয়ে থাকে। প্রাথমিক-পর্যায় থেকেই পাহাড়ি শিক্ষার্থীদের হোস্টেলে থেকে পড়তে হয়। পাওমাং স্কুলের প্রায় সবাই আবাসিক শিক্ষার্থী। কারণ কয়েকটা পাহাড়ি গ্রাম মিলিয়ে একটা স্কুল থাকে। সেক্ষেত্রে হোস্টেলের জন্য আলাদা দেড় থেকে দুই হাজার টাকা লেগে যায়। এর জোগান দেওয়া অনেকের পক্ষেই সম্ভব হয়ে ওঠে না।”
সমাধান কোথায়?
দিনাজপুরের বেলবাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমীনের পরামর্শ, সরকারকে পরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে।
“আমার স্কুলে প্রধানত সাঁওতালসহ বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর বাচ্চা আছে, কিন্তু শিক্ষক নাই। বাঙালি শিক্ষকরা তাদের সঙ্গে তাদের ভাষায় যোগাযোগ করতে পারেন না। আবার অনেক স্কুলে যেখানে আদিবাসী শিক্ষক আছেন, শিক্ষার্থী নাই। সেজন্য যেসব স্কুলে ওই আদিবাসী শিক্ষার্থী আছে, সেখানে তাদের শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া গেলে শিক্ষার্থীরা উপকৃত হবে। কারণ মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের অধিকার তাদের রয়েছে।”
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ফারহা তানজীম তিতিল আদিবাসীদের নিয়ে বিভিন্ন কাজ করেছেন। হাজং শিশুদের ভাষা শিক্ষা এবং নিজ ভাষায় শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ নিয়ে মাঠ পর্যায়ে তার একটি কাজ রয়েছে।
আদিবাসী নেভিগেটরে প্রকাশিত গবেষণার তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, বাংলাদেশে ৪০ শতাংশ হাজং শিশু প্রাথমিক পর্যায়ের পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা ভালোভাবে সমাপ্ত করতে পারে না এবং ঝরে পড়ে।
“যার অন্যতম কারণ হাজংদের মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের সুযোগ না থাকা। অন্যান্য কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে দারিদ্র্য, অসচেতনতা, দূরবর্তী স্কুল এবং নিরাপত্তাহীনতা।”
পাঁচটি নৃগোষ্ঠীর পাঠ্যবই তৈরিতে নেতৃত্ব দেওয়া ভাষাবিজ্ঞানী অধ্যাপক সৌরভ শিকদার বলছেন, বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীকে মাতৃভাষায় পড়ানোর পুরো প্রক্রিয়া শেষ না হওয়ায় সংকট রয়ে গেছে। এক্ষেত্রে সরকারের কার্যক্রমে গাফলতি দেখছেন তিনি।
সৌরভ বলেন, “অন্য ভাষার বই আসছে না, আরও পাঁচটি ভাষার বই করার কাজ এগিয়ে রয়েছে। কয়েকটি ধাপে এটি সম্পন্ন হবে। পাঠ্যবই তৈরি, ওই ভাষার শিক্ষক নিয়োগ, তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া- এসব প্রক্রিয়া যখন হবে, তখন সেটি শিক্ষার্থীদের কাজে আসবে।
“পাঠ্যপুস্তক তৈরি হয়েছে, সরকার মনে করছে তাদের কাজ শেষ। বাকি কাজ প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং এনসিটিবি করবে। মন্ত্রণালয়কে শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। আমি-আপনি তো তাদের পড়াতে পারব না। এই সব জাতিগোষ্ঠীর কোন ভাষায় কত শিশু রয়েছে, সে পরিসংখ্যান নিয়ে ওই পরিমাণ শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে প্রশিক্ষণ দিতে হবে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের এই অধ্যাপক বলেন, “আমি এ বিষয়ে ন্যাশনাল কমিটি, টেকনিক্যাল কমিটি ও বাস্তবায়ন কমিটি- তিনটাতেই সদস্য ছিলাম। দুই বছর ধরে কোনো কমিটির মিটিং ডাকা হয় না।
“আমরা হাতেগোনা কয়েকজন মূল প্ল্যান করেছি, আলাপ করেছি ব্যাপারটা নিয়ে। অথচ আমরা কিছুই জানি না, কিন্তু কতগুলো কাজ নিজে নিজেই হচ্ছে। তার মানে সমন্বয়ের অভাব আছে।”
‘বাংলাদেশের নৃভাষাবৈজ্ঞানিক সমীক্ষা’ পরিচালনাকারী সৌরভ শিকদার মনে করেন, এই জাতিগোষ্ঠীগুলোর মাতৃভাষায় পড়ার কার্যক্রম না এগুনোর পেছনে নিজেদেরও দায় রয়েছে।
এই অধ্যাপক বলেন, “শিশুরা বলা ও বুঝতে পারাটা নিজের পরিবেশ থেকে স্বাভাবিকভাবেই শিখে ফেলে। কিন্তু লিখতে বা পড়তে গেলে শিখতে হবে। এক্ষেত্রে তো বাংলা ভাষার শিশুরাও সমস্যায় পড়ে, স্কুলে গিয়ে শিখে।
“কেন মাতৃভাষায় পড়া জরুরি, সেটা ওই নৃগোষ্ঠীর জনগণকে বোঝাতে হবে। তারা মনে করে, বাংলা বা ইংরেজি পড়লে বাচ্চা চাকরি পাবে, ভবিষ্যৎ ভালো হবে। চাকমা বা গারো ভাষা শিখে কী লাভ? তাদের ভুল ধারণা রয়েছে যে, মাতৃভাষায় পড়লে বাংলা-ইংরেজি জানবে না। অথচ তৃতীয় শ্রেণি থেকেই তারা সেগুলো পড়বে। মাতৃভাষা না জানলে ভাষার ভিত্তি, জ্ঞানের বুনিয়াদ হয় না-এটা তো তারা জানে না। এটা জানাতে হবে, এগুলো সরকারের দায়িত্ব।”
যা বলছে এনসিটিবি
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম বলেন, যে পাঁচটি ভাষায় বই দেওয়া হয়েছে, সেই অভিজ্ঞতা সুখকর নয়।
“সেগুলো আমরা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে চাই। আরও ৫ ভাষায় বই করলে সেটি যদি মুখ থুবড়ে পড়ে, তাহলে তো লাভ নাই। তাই আমরা বুঝে-শুনে আগাচ্ছি। আমরা গত পরশুদিন তাদের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য ট্রেনিং ম্যানুয়াল শেষ করেছি।
“আমরা খুব শিগগিরই তাদের প্রশিক্ষণ দেব। এর আগেও তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। প্রশিক্ষণ দিয়ে দেখব তাদের উন্নয়ন হয় কি না। শুধু শুধু সরকারের টাকা নষ্ট করা হচ্ছে। শুধু সরকারই করবে, স্ব স্ব জাতিগোষ্ঠীর তাদের দিক থেকে কোন উদ্যোগ থাকবে না, তা নয়।”
শিক্ষক সংকটের কথা স্বীকার করে অধ্যাপক ফরহাদ বলেন, “অনেক ভাষার লিপির সংকট রয়েছে, কোন লিপিতে পাঠ্যপুস্তক তৈরি করা হবে, সেই তর্কের অবসান ঘটানো যায়নি। তাদের নিয়ে আমরা কাজ করছি।
“১৩ দিন তাদের নিয়ে পাঠ্যবই আমরা পরিমার্জন করেছি। সরকার কিন্তু করেই যাচ্ছে। কিন্তু স্ব স্ব ভাষাগোষ্ঠীর নেতাদের দায়িত্ব নিতে হবে তাদের ভাষা টিকিয়ে রাখার।”